আমাদের আজকের কাহিনীর মূল নায়ক একজন অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট, যিনি শখের বশে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতেন। এছাড়া লেখালেখি করাও ছিলো তার পছন্দনীয় বিষয়। ১৮৬৬ সাল থেকে মাঝে মাঝেই মিশর ভ্রমণে যেতেন তিনি। ওহ, নায়কের নামই তো বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তার নাম থমাস ডগলাস মারে।
১৮৯০ সালের কথা। দুজন সহকর্মীকে নিয়ে মিশরে গিয়েছিলেন মারে। সেইবার স্থানীয় এক লোকের সাথে দেখা হয় তাদের। লোকটি তাদেরকে চমৎকার নকশা করা একটি মমির বাক্সের সন্ধান দেয় (মমি না কিন্তু)। বলা হয় যে, বাক্সটি ১৮৮০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে মাটির তলা থেকে খুঁড়ে পাওয়া গেছে। বাক্সটির গায়ে খোঁদাই করা হায়ারোগ্লিফ থেকে জানা যায় যে, এর ভেতরে থাকা নারী এককালে মিশরীয় দেবতা আমুন-রা’র মন্দিরের উচ্চ পর্যায়ের যাজিকা ছিলেন।
তিনজনই বাক্সটি পছন্দ করেছিলো, কিন্তু কিনতে পারবে কেবলমাত্র একজন। এজন্য ঠিক হলো লটারি করা হবে। যে জিতবে, সে-ই কিনতে পারবে চমৎকার নকশা করা সেই মমির বাক্সটি। লটারিতে ভাগ্য মারের প্রতিই সুপ্রসন্ন হলো। এরপর আর দেরি না করে সেদিন সন্ধ্যায়ই বাক্সটি প্যাকেট করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। হায়, মারে যদি জানতেন এই সুপ্রসন্ন ভাগ্য আসলে তার জন্য মারাত্মক দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে যাচ্ছে, তাহলেও কি তিনি বাক্সটি কিনতেন?
কয়েকদিন পরের কথা। বাক্সটি পাঠিয়ে দিলেও মারে তখনও রয়ে গিয়েছিলেন মিশরেই। নীল নদের তীরে নিজের শটগান দিয়ে হাঁস শিকার করছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত তার হাতেই শটগানটিতে বিষ্ফোরণ ঘটে যায়! খারাপ আবহাওয়ার জন্য থেবস থেকে কায়রোতে ফিরে আসতে তার লেগে যায় দশ দিন সময়। ততদিনে তার ক্ষতস্থানটিতে গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়ায় সেই হাতটি কেটে ফেলতে হয়।
কিছুদিন পরই কায়রো থেকে লন্ডনের পথে রওয়ানা দেন মারে এবং তার সহকর্মীরা। দুঃখজনকভাবে পথিমধ্যে মারা যান একজন সহকর্মী। ওদিকে মমির বাক্সটি পাঠানোর দায়িত্বে নিয়োজিত দুজন শ্রমিক এক বছরের মাঝে মারা গিয়েছিলো। কথিত আছে, তারা নাকি বাক্সটিকে যথাযথ সম্মানের সাথে আনা-নেয়া করে নি! আবার আরেক শ্রমিক বাক্সটি নিয়ে মজা করে কিছু কথা বলেছিলো। মৃত্যুর কালো থাবা নেমে এসেছিলো তার উপরেও।
কিছুদিন পর ৩৪ পোর্টল্যান্ড প্লেসে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন মারে। দেখতে পেলেন মমির বাক্সটি খোলা। সেদিন বাক্সটি দেখে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন তিনি। কেনার সময় উপরের নারীর প্রতিকৃতি যতটা সুন্দর লাগছিলো, সেদিন যেন ততটা লাগছিলো না। বরং এর মাঝে সেদিন অমঙ্গলের অশুভ ছায়াই যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন তিনি।
বেশ কিছুদিন পরের কথা। এক সাংবাদিক দেখা করতে এলেন মারের সাথে। মমির বাক্সটি দেখে ভালো লেগে যায় তার। তাই মারের কাছে তিনি অনুমতি চান সেটি কিছুদিন নিজের বাসায় নিয়ে রাখার জন্য। মারে সানন্দে রাজি হয়ে যান। মমির বাক্সটি বাসা থেকে যাওয়ায় তিনিও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু এরপরই সেই সাংবাদিকের জীবনে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। তার মা সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান, যে লোকটির সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তিনি তা ভেঙে দেন, তার পোষা কুকুরটি পাগল হয়ে যায় এবং তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন যে, মমির বাক্সটিই হয়তো তার এত দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। বাক্সটি তাই আবারো মারের কাছে ফেরত দেন তিনি।
মারে বাক্সটি নিজের কাছে বেশিদিন রাখার সাহস করলেন না। তিনি সেটি তার বন্ধু আর্থার এফ. হুইলারকে দিয়ে দিলেন। এরপর হুইলারের জীবনেও ঘটতে শুরু করে বিভিন্ন দুঃখজনক ঘটনা। কিছুদিন পরই মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে তিনি সেটি তার এক বিবাহিতা বোনের কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন।
একদিন হুইলারের সেই বোন বাক্সটি নিয়ে বেকার স্ট্রীটে এক দোকানে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু নেগেটিভ থেকে ছবিটি ডেভেলপ করার পর দেখা গেলো যে, সেখানে এক মিশরীয় মহিলা কেমন এক অমঙ্গলের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে! দেখলেই যে কারো পিলে চমকে যেতে বাধ্য। মহিলাটি সেখানে কিভাবে এলো তা কেউই বলতে পারে নি। কয়েক সপ্তাহ পর অদ্ভুতভাবে সেই ছবিটির ফটোগ্রাফার পরপারে পাড়ি জমান।
মহিলাটির জীবনেও তখন নানাবিধ সমস্যা ঘটছিলো প্রতিনিয়ত। তাই তিনি বাক্সটি আর নিজের কাছে রাখার সাহস পেলেন না। মারের সাথে দেখা করে নিজের সকল দুর্ভাগ্যের কথা খুলে বললেন তিনি। মারেও আর বাক্সটি নিজের কাছে রাখতে চাইছিলেন না। তাই তিনি মহিলাকে পরামর্শ দিলেন যেভাবেই হোক বাক্সটি থেকে নিষ্কৃতি পেতে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে প্রস্তাব দিলে তারা তা সাদরে গ্রহণ করে এবং বাক্সটি নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। এক মিশর বিশেষজ্ঞ এ আদান-প্রদানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। বাক্সটির গায়ে থাকা হায়ারোগ্লিফ নিয়ে ভালো করে পড়তে তিনি সেটি নিজের বাসায় নিয়েছিলেন। এর কিছুদিনের মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সেই বিশেষজ্ঞ। তার বাড়ির চাকরের কাছ থেকে জানা যায় যে, বাক্সটি বাড়িতে আনার পর থেকেই তিনি রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারতেন না।
যে লোকটি মমির বাক্সটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নিয়ে এসেছিলো, সে মারা যায় এক সপ্তাহের মাঝেই। চারদিকে তখন গুজব ছড়াতে শুরু করে যে, যে লোকই মমির বাক্সটির ছবি তুলতে বা স্কেচ করতে চেষ্টা করেছে, সে-ই মারা পড়েছে অপঘাতে। এক লোক বাক্সটির ছবি তুলে আগের মতোই ভয়ঙ্কর এক নারীর ছবি দেখতে পায়। সে ছবিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মিশরীয় ও অ্যাসিরীয় পুরাকীর্তিসমূহের রক্ষক স্যার আর্নেস্ট ওয়ালিস বাজের হাতে তুলে দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করে!
বাজ আগেই মমির বাক্সটি নিয়ে ঘটে যাওয়া নানা দুর্ঘটনা নিয়ে কাহিনীগুলো শুনেছিলেন। এছাড়া মিউজিয়ামে কাজ করা বিভিন্ন কর্মীও অভিযোগ জানাতে লাগলো যে, তারা বাক্সটির ভেতর থেকে হাতুড়ি পেটানো এবং কারো কর্কশ কন্ঠে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন বাজ। তিনি ভাবলেন, মমিটির আত্মা হয়তো মিউজিয়ামে তার অবস্থান ও উপস্থাপন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তাই তিনি জাঁকজমকপূর্ণ ডিসপ্লে কেসে মমির বাক্সটি রাখার ব্যবস্থা করলেন। এরপরই সেই অশরীরী শব্দগুলো একেবারেই চলে যায়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে রাতের বেলায় কাজ করা বিভিন্ন কর্মী মাঝেমাঝেই টুকটাক ভৌতিক শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। মমির বাক্স থেকে নিস্তার পেলেও দুর্ভাগ্য মারের পিছু ছাড়ে নি। নানাবিধ দুর্দশায় জর্জরিত হয়ে ১৯১২ সালে মারা যান তিনি।
এতক্ষণ ধরে যারা উপরের কাহিনীটি পড়লেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। তবে আধুনিক যুগে বসবাস করে মমি নিয়ে এমন অদ্ভুত কাহিনী হজম করতে যে কারোরই কষ্ট হবার কথা। এখন তাহলে এই কাহিনী কতটুকু সত্য তা যাচাই করতেই বসা যাক।
মমির বাক্স কেনার ঘটনায় মারেকে আমরা দেখতে পাই একজন দুঃসাহসী ব্যক্তি হিসেবে। অন্যদিকে দুর্ঘটনাগুলোর বর্ণনা এমনভাবে উঠে এসেছে যে, সেগুলোতে তাকে প্রত্যক্ষদর্শী বলেই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে তিনি এ দুটোর কোনোটাই ছিলেন না!
১৮৮৯ সালের দিকে পরিচিত বেশ কিছু মানুষের দেখাদেখি মারেও অতিপ্রাকৃত জিনিস নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দেন। মৃত আত্মাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বেশ উদগ্রীব। কিন্তু একটা সময় গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, এসব আসলে পন্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই না।
মারে একবার এক ইংরেজ মহিলার গল্প (সত্য কাহিনী না) শুনেছিলেন যিনি কিনা মিশর থেকে একটি মমি কিনে এনে নিজের বাসার ড্রয়িং রুমে রেখেছিলেন। পরদিন সকালে সেই রুমের সকল জিনিসই ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় পড়ে ছিলো। এরপর মমিটি আরেক রুমে নিয়ে গেলে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। পরদিন তিনি মমিটি চিলেকোঠায় রেখেছিলেন। সেদিন রাতভর সিঁড়ি দিয়ে কারো ওঠানামার শব্দ পাওয়া গেছে, জ্বলা-নেভা করেছে বিদ্যুৎ বাতিগুলোও। পরদিন সকালে বাড়ির প্রতিটি চাকরই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। গল্পটা ছিলো মোটামুটি এমনই।
আর্থার এফ. হুইলারের পক্ষে ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে মমির বাক্সটি দান করেছিলেন লন্ডনের হল্যান্ড পার্কের বাসিন্দা মিসেস ওয়ারউইক হান্ট। এরপরই ডগলাস মারে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন তাদের মিশরীয় রুমে মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য। তার সাথে ছিলেন সহকর্মী ডব্লিউ টি স্টিড। এই স্টিডই প্রথম মমির ‘অভিশাপ’ নিয়ে কাহিনী ফেঁদেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, মারেকে সেই কাজটি করবার অনুমতিই দেয় নি ব্রিটিশ মিউজিয়াম। কিন্তু কে শোনে কার কথা? পত্রিকাগুলো মারের সেই মৃত আত্মার সাথে যোগাযোগের প্রচেষ্টা, একটু আগেই উল্লেখ করা ইংরেজ মহিলার কাহিনী, মমির বাক্স আর ডগলাস মারেকে যুক্ত করে চমৎকার এক ভৌতিক গল্প ছেপে বসে। ধারণা করা হয় যে, এটি এসেছিলো স্টিডের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়গুলোতে তাই কিছু না করেও, কিছু না ঘটিয়েও সবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে মমির বাক্সটি যার নায়ক হয়ে থেকে যান ডগলাস মারে।
অর্থাৎ বোঝা গেলো যে, এতক্ষণ ধরে ডগলাস মারেকে নিয়ে চমৎকার যে ভৌতিক কাহিনীটি আপনি বাস্তব ভেবে পড়ে এসেছেন, তা আসলে পুরোপুরিই কাল্পনিক। এর মাঝে শুধু মারেই বাস্তব সত্ত্বা।
এমনকি বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক ডুবে যাওয়ার জন্যও কোনো কোনো মানুষ দায়ী করে থাকে এ মমির বাক্সটিকে। বলা হয়ে থাকে যে, মমির বাক্সটিকে ঘিরে এত দুর্ঘটনার ঘটনায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষও। তাই এর থেকে নিস্তার পেতে তারা সেটি বিক্রি করে দেয় আমেরিকার এক মিউজিয়ামের কাছে। বাক্সটি স্থানান্তর করা হচ্ছিলো সেই টাইটানিকে করেই। বাকিটুকু তো কেবলই ইতিহাস!
আপনার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, টাইটানিকের সাথে মমির বাক্সটির এ মুখরোচক কাহিনীটিও পুরোপুরিই ভুয়া। কারণ সেই ১৮৯০ সাল থেকে মমির বাক্সটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই আছে। মাঝে শুধু দুই বিশ্বযুদ্ধ আর ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এক প্রদর্শনীর জন্য এটিকে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। ১৯৩৪ সালে ওয়ালিস বাজও এক বিবৃতিতে মমির বাক্সটিকে ঘিরে থাকা সকল অশুভ ঘটনাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেন।
যদিও বাক্সটির অভিশপ্ত না হওয়ার বিষয়টি সবদিক থেকেই প্রমাণিত, তারপরও কিছু কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যে, সেটি আসলেই অভিশপ্ত। এজন্য তারা দেখিয়ে দিতে চায় ১৯৩৪ সালটিকেই। কারণ মমির অভিশাপ অস্বীকার করার পর সেই একই বছরে যে পরপারে পাড়ি জমান স্যার ওয়ালিস বাজ!