অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী বললেও হয়তো বিজ্ঞানের জগতে তার অবদানকে পুরোপুরি বোঝানো সম্ভব না। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট, থিওরি অফ রিলেটিভিটি, মাস-এনার্জি ইকুইভ্যালেন্স ফর্মুলার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীর মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে স্মরণ করবে আজীবন।
মহান এ বিজ্ঞানী তার জগত তথা বিজ্ঞানের জগতে যেমন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তেমনি প্রতিভার স্বাক্ষর দেখিয়েছেন আরেক জায়গাতেও, সেটা তার নারীপ্রীতি। জীবনে বিয়ে করেছিলেন তিনি দু’বার। দুই সহধর্মিনী ছাড়াও তার আরো অর্ধ ডজনের মতো নারীর সাথে সখ্যতার ব্যাপারে জানা যায়। আজকের লেখাটি অবশ্য আইনস্টাইনের সেই অর্ধ ডজন ‘বিশেষ বান্ধবী’র সবাইকে নিয়ে না, বরং কেবলমাত্র তার সোভিয়েত বান্ধবী মার্গারিটাকে নিয়েই, যিনি আইনস্টাইনকে ভালোবেসেছিলেন না বলে নিজের কার্যসিদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবহার করেছেন বললেই বোধহয় কথাটা যথোপযুক্ত শোনাবে!
১৯৩৩ সালের কথা, দ্বিতীয় স্ত্রী এলসাকে নিয়ে আইনস্টাইন তখন চলে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের প্রিন্সটনে। ১১২ মার্সার স্ট্রিটে একটি বাড়ি কিনেছিলেন আইনস্টাইন। সপরিবারে সেখানে গিয়ে ওঠেন তিনি। শুরুর কয়েকদিন নতুন বাড়িতে ভালোই কাটলো তাদের। কিন্তু এ সুখানুভূতি ছিলো ক্ষণস্থায়ী। অল্প কিছুদিন পরেই এলসার শরীরে নানাবিধ অসুখ বাসা বাধতে শুরু করলো। ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা গেলো তার হৃদযন্ত্র আর কিডনীতে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
অর্ধাঙ্গিনীর এমন অসুস্থতার খবরে মারাত্মক ভেঙে পড়লেন এ বিজ্ঞানী। এলসার ভাষায়, “উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি”। এলসার অসুখ তার সকল সমীকরণ ওলটপালট করে দিয়েছিলো। দুঃখ আর হতাশা ভুলতে তিনি আরো বেশি করে গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকতে শুরু করে দেন। তবু মন বসাতে পারেন না সেখানেও। অবশেষে ১৯৩৬ সালের ২০ ডিসেম্বর এ রোগে ভুগেই পরপারে পাড়ি জমান এলসা আইনস্টাইন। তার মৃত্যুতে মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন অ্যালবার্ট। এমনকি তার বন্ধু পিটার বাকি এটাও জানান যে, দীর্ঘদিন ধরে পরিচয় থাকলেও যে আইনস্টাইনকে তিনি কোনোদিনই কাঁদতে দেখেন নি, সেই মানুষটিকেই তিনি শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছিলেন এলসাকে হারিয়ে!
তখন নাহয় আইনস্টাইন স্থায়ী বন্ধনে কারো সাথে আবদ্ধ ছিলেন না, কিন্তু কারো প্রতি কি তার মনে কোনো অনুভূতির জন্ম নেয় নি?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের চলে যেতে হবে ১৯৩৫ সালের দিকে। দ্বিতীয় স্ত্রী এলসা তখনও বেঁচে ছিলেন। আইনস্টাইনকে নিজেদের মাঝে পেয়ে তার সম্মানার্থে কিছু করার চিন্তা করলো প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম সেরা এ বিজ্ঞানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে তারা তাঁর ব্রোঞ্জনির্মিত একটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করবে। এ উদ্দেশ্যে ডাক পড়লো সের্গেই কোনেনকোভা নামক এক সোভিয়েত ভাষ্করের। গত প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছিলেন সের্গেই, তৈরি করছিলেন চমৎকার নানা ভাষ্কর্য। তাই এ কাজটি সম্পাদনের জন্য তাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছিলো প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আইনস্টাইনও আর দ্বিমত করলেন না, মূর্তি বানানোর মডেল হয়ে নিয়মিতভাবেই বসে থাকতেন সের্গেইয়ের সামনে।
ঘটনাটা (কিংবা দুর্ঘটনা) আসলে ঘটে যায় তখনই। আর এ ঘটনা ঘটে যায় সের্গেইয়ের স্ত্রী মার্গারিটা কোনেনকোভাকে ঘিরেই। মূর্তিটি বানাতে মোটামুটি ভালোই সময় লেগেছিলো। আর এজন্য নিয়মিতভাবেই সের্গেইয়ের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকা লাগতো আইনস্টাইনকে। এভাবে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতে করতে তার স্ত্রী মার্গারিটার সাথে আইনস্টাইনের সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে খুব বেশি দিন সময় লাগে নি। চল্লিশ বছর বয়স্কা মার্গারিটা আইনস্টাইনের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলে কী হবে, তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের মোহনীয়তায় তিনি ঠিকই আইনস্টাইনকে কাবু করতে শুরু করেছিলেন। তাদের মাঝে সম্পর্ক কী এলসার মৃত্যুর আগে না পরে শুরু হয়েছিলো, সে সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে ১৯৪৫ সালে মার্গারিটা যখন মার্কিন মুল্লুক ছেড়ে চলে যান, তখন আইনস্টাইনের হৃদয়ের এক বড় অংশ জুড়েই ছিলো তার স্থান।
আইনস্টাইন আর মার্গারিটার এ সম্পর্কের কথা তাদের জীবিতাবস্থায় কেউই জানতো না। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো মার্গারিটার বৈবাহিক অবস্থা। যেহেতু তিনি সের্গেইয়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ, তাই আইনস্টাইনের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে সেটার ফল যে খুব সুখকর হবে না, সেটা তো না বললেও চলে।
১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তাই পুরো ব্যাপারটি গোপনই ছিলো। কিন্তু সেই বছর আইনস্টাইনের নয়টি চিঠি নিলামে তোলা হয়, যেখানে ১৯৪৫-৪৬ সালে মার্গারিটাকে উদ্দেশ্য করে লেখা তাঁর চিঠিগুলো ছিলো। এরপরই বিশ্ববাসী সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের সাথে মার্গারিটার গোপন প্রণয় সম্পর্কে জানতে পারে। অবশ্য পরকীয়ার ব্যাপারটি মার্গারিটার জন্য নতুন কিছু ছিলো না। কারণ সের্গেই রাখমানিনোভ নামে আরেকজনের সাথেও তার সম্পর্ক ছিলো।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপারটি ছিলো অন্য জায়গায়। আইনস্টাইনের খ্যাতি কিংবা ব্যক্তিত্ব কিছুই মার্গারিটাকে আকর্ষণ করে নি। আইনস্টাইন তার প্রতি দুর্বল হলেও তিনি আইনস্টাইনের প্রতি দুর্বল হয়েছিলেন কিনা সে সম্পর্কে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। কেন? কারণ আইনস্টাইন যে ছিলেন তার ‘অ্যাসাইনমেন্ট’!
১৮৯৫ সালে এক আইনজীবী পিতার ঘরে জন্ম নেন মার্গারিটা। সারাপুলে মেয়েদের এক স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি মস্কোর মাদাম পোলতোরাতস্কিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ভাষ্কর সের্গেই কোনেনকোভের সাথে বিয়ে হয় তার। ১৯২৩ সালে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি সোভিয়েত আর্ট এক্সপোজিশনে অংশ নিতে তারা এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পরবর্তী ২২ বছর সেখানেই কাটিয়ে দেন তারা।
মাঝে মাঝেই ইউরোপের নানা দেশে ঘুরতে যেতেন তারা। সেসব ভ্রমণ বুদ্ধিমতী মার্গারিটাকে আরো সুচতুর ও বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী করে তোলে, জ্ঞান দেয় নানা জাতির নানা সংস্কৃতি সম্পর্কে। বিভিন্ন ভাষায় তিনি বেশ দক্ষতার সাথেই কথা বলতে পারতেন। মাঝে মাঝে যখন সের্গেই নানা কাজে বাইরে যেতেন, তখন বাড়িতেই থাকতেন মার্গারিটা। সময় কাটাতেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য নানা বিজ্ঞানীর সাথে। এভাবে তাদের সাথে বেশ সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় তার।
একসময় মার্গারিটার নজরে পড়ে যান আইনস্টাইনও। মূর্তি বানানোর ছুতোয় তাদের দুজনের মাঝে ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগপর্যন্ত বজায় ছিলো সেই সম্পর্কের ধারা। তাদের একত্রে ছবিও তোলা আছে। কেউ যখন জানতে চাইতো মার্গারিটার সাথে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে, তখন আইনস্টাইন মার্গারিটাকে তাঁর ‘সঙ্গিনী’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিতেন!
আহ, আইনস্টাইন যদি জানতেন…
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে মার্গারিটা তার স্বামীর সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে যান। প্রিয় মানুষটিকে চলে যাবার আগে নিজের স্বর্ণের হাতঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। মার্গারিটার উদ্দেশ্যে তিনি এতটাই ভাবাবেগে পরিপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন, যা দেখলেও অবাক হতে হয়। একটি নমুনা তুলে দেয়া যাক।
“Just recently I washed my head by myself, but not with the greatest success; I am not as careful as you are. But everything here reminds me of you: Almar’s shawl, the dictionaries, the wonderful pipe that we thought was gone, and really all the many little things in my hermit’s cell.”
এই বৃদ্ধ বয়সে গিয়েও মধ্যবয়স্কা এক নারীর প্রতি আইনস্টাইনের আবেগের প্রাচুর্য দেখে বিস্মিত হয় সথবি অকশন হাউজ কর্তৃপক্ষ (যারা চিঠিগুলো নিলামে তুলেছিলো)। এজন্য তারা আরো ঘাটাঘাটি শুরু করে দেয় মার্গারিটার প্রকৃত পরিচয় উদঘাটনের উদ্দেশ্যে। কিছুদিন পর তারা যা খুঁজে পায়, তা ছিলো এক কথায় অবিশ্বাস্য।
১৯৯৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঝানু গোয়েন্দা পাভেল সুদোপ্লাতভ আর তার ছেলে আনাতোলির লেখা ‘স্পেশাল টাস্কস’ নামক বইয়ে উঠে আসে মার্গারিটা কোনেনকোভার নাম। মার্গারিটার কোডনেম ছিলো ‘লুকাস’। প্রিন্সটনে অবস্থানকালে তাকে একটি বিশেষ মিশন দেয়া হয়েছিলো। তার কাজ ছিলো নিজের মোহনীয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রিন্সটনের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে আসা, বিশেষ করে ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীদের সাথে।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন অবশ্য ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তাই তার সাথে সম্পর্ক থেকে মার্গারিটা আসলে কীভাবে ফায়দা লুটতে চাচ্ছিলেন তা বোঝা মুশকিল। তবে চিঠি থেকে এটা জানা যায় যে, নিউ ইয়র্কে একবার আইনস্টাইনের সাথে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন মার্গারিটা।
আইনস্টাইন কি তাহলে মার্গারিটার প্ররোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন? না, এমনটা বলার উপায় নেই। কারণ তার মনে ছিলো কেবলই মার্গারিটার প্রতি বিশেষ অনুভূতি। তিনি জার্মানদের সাথে হাত মেলাতে পারেন কিংবা তাকে অপহরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় ১৯৩৩ থেকে ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁর উপর নজরদারি করে গেছে এফবিআই। তাঁকে নিয়ে এফবিআইয়ের বানানো ১,৪০০ পৃষ্ঠার নথিতে নানা বিষয় উঠে এলেও আসেনি মার্গারিটার নাম, আসেনি সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সাথে তাঁর সাক্ষাতের বিষয়টিও। এদিকে অবশ্য গোপনীয়তা সর্বোচ্চ পরিমাণে রক্ষা করতে পারায় মার্গারিটাকে কৃতিত্ব দেয়াই লাগে।
মার্গারিটার প্রতি লেখা আইনস্টাইনের সেই চিঠিগুলোতে উঠে এসেছে তাদের একত্রে কাটানো নানা সময়ের কথা, বিবাহিতা এ নারীর প্রতি তাঁর আবেগ-অনুভূতির কথা। মার্গারিটা যে আড়ালে আড়ালে একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা, তা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি বিখ্যাত এ বিজ্ঞানী। আইনস্টাইনের প্রতি মার্গারিটার অনুভূতি কেমন ছিলো তা অবশ্য কখনোই জানা যায় নি। কারণ মস্কোতে যাবার পর আর কোনোদিনই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেননি, খুঁজে পাওয়া যায় নি আইনস্টাইনকে লেখা তার কোনো চিঠিও। ১৯৮০ সালে মস্কোতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মার্গারিটা।