মানব সভ্যতার একটি বড় অগ্রগতির নিদর্শন ছিল আগুনের ব্যবহার শেখা। বর্তমানে আগুন যেন অনেক বেশি সহজ, স্বাভাবিক আর নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগুন তো থাকবেই, তাই না? এতে আবার বাড়তি ভাবনার কী আছে? কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন আগুন নামক কোনো ব্যাপার ছিল না। অন্তত মানুষের জ্ঞান ছিল না সেই ব্যাপারে। যথারীতি প্রশ্ন চলেই আসে যে, তাহলে ঠিক কবে থেকে আগুন ব্যবহার করা শুরু করলো মানুষ? কে প্রথম আগুন নামের এই জাদুকরী বিষয়টিকে আয়ত্বে আনে? চলুন, প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক।
হার্ভার্ডের নৃতত্ত্ববিদ রিচার্ড রাংহামের মতে, হোমিনিডরা মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে উন্নীত করে আগুনের আবিষ্কার এবং সেটা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। এই সময়টাকে তিনি ১.৮ মিলিয়ন বছর আগেকার কোনো একটা সময় হিসেবে মনে করেন। বর্তমানে রান্না করাটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। তবে রাংহামের মতে, এটি কেবল রান্না নয়, বরং মানুষ যে আসলেই মানুষ সেটার প্রমাণ। অতীতে আমাদের উন্নত হওয়ার একটি ধাপকে মনে করিয়ে দেয় এই রান্না করা এবং তাতে আগুনের ব্যবহার।
মূলত, আমরা মানুষ তার একটি চিহ্ন এই আগুন। তবে রিচার্ড রাংহামের এই কথাগুলো নিয়ে সমালোচনা হয়েছে প্রচুর। ২০০৯ সালে নিজের তত্ত্বগুলোকে ‘ক্যাচিং ফায়ার’ বইয়ে তুলে ধরেন রিচার্ড রাংহামের। তবে তারপরই এ বিষয়ে আরো অনেকে বিভিন্ন মতামত দেন। তাদের মতামতের প্রধান জায়গাটি ছিল সময়। আগুন আবিষ্কারের সময় এবং কে আগুন আবিষ্কার করেছে কিংবা নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রথম সেটা নিয়ে কথা বলেন তারা। নিয়ান্ডারথাল, হোমো ইরেক্টাস নাকি আধুনিক মানুষ- কারা আগুনের আবিষ্কারক এবং প্রথম নিয়ন্ত্রক?
উত্তর জানতে হলে প্রথমে এদেরকে ভালো করে জানতে হবে। ১.৮ মিলিয়ন বছর আগে মানুষের যে পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীতে ছিল তাদেরকে হোমো ইরেক্টাস বলেই মনে করা হয়। এরা ছিল অনেক বেশি লম্বা আর কম বুদ্ধিসম্পন্ন। তাদের কাছ থেকে পরবর্তীতে দুটো ধাপ সামনে এগিয়ে যায়। সেগুলো হলো- নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানুষ। নিয়ান্ডারথালদের উদ্ভব হয়েছে ৬,০০,০০০ বছর আগে। আর আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয় ২,০০,০০০ বছর আগে। হোমো ইরেক্টাসদের তুলনায় নিয়ান্ডারথাল ছিল ক্ষীণকায়। এদের মস্তিষ্ক ছিল তুলনামূলকভাবে বড় এবং তারা হোমো ইরেক্টাসদের চাইতে বেশি বুদ্ধি ধারণ করতো।
মনে করা হয়, হোমো সেপিয়েন্সদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। রিচার্ড রাংহামের মতে, হোমো ইরেক্টাসরাই প্রথম আগুন আবিষ্কার করে এবং এর ব্যবহার শুরু করে। এদের শারীরিক গঠন থেকেই এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান তিনি। ছোট চোয়াল ও দাঁত, সংক্ষিপ্ত অন্ত্রনালী এবং অন্যান্য হোমিনিডদের চাইতে বড় মগজবিশিষ্ট হোমো ইরেক্টাস সম্পর্কে ডেভিড জানান, এদের গঠনের নিদর্শন থেকেই বোঝা যায় যে, এরা নিয়মিত নরম এবং রান্না করা খাবার গ্রহণ করতো। রিচার্ডের যুক্তি বেশ সহজ এবং গ্রহণযোগ্য।
তবে নৃতাত্ত্বিক তথ্য একটু ভিন্ন কথা বলে। সে অনুসারে ১.৬ মিলিয়ন বছর আগেই কেনিয়ার একটি স্থানে আগুন ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে এই আগুন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল নাকি মানুষের দ্বারা সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ডেভিড র্যাংকহামের দেখানো তথ্য ও যুক্তি অনুসারে, হোমো ইরেক্টাসেরা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসার সময় আগুন নিয়ে আসেনি। হয় আগুনের ব্যবহার তখনো সেভাবে কেউ জানতো না, অথবা আগুন খুব বেশি উপকারী কিছু ছিল না তাদের কাছে। এখন প্রশ্ন হলো, ইউরোপে যদি আগুন হোমো ইরেক্টাসেরা না এনে থাকে তাহলে এখানে আগুনের আবিষ্কার হলো কীভাবে?
নৃবিজ্ঞানী উইল রোব্রোক এবং পাওলা ভিলা বছরের পর বছর এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালান এবং ৪,০০,০০০ ও ৩,০০,০০০ বছর আগেও যে ইউরোপে আগুনের ব্যবহার ছিল সে নিদর্শন বেশ কিছু স্থানে খুঁজে পান। এই সময়ের আগে আগুনের কোনো চিহ্ন কোথাও খুঁজে পাননি তারা। তবে সম্প্রতি পাওয়া তথ্যানুসারে, ইসরায়েলের তাবুন গুহা থেকে ৩,৫০,০০০ বছর আগে আগুন ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। হোমো সেপিয়েন্সরা ১,০০,০০০ বছর আগে স্থানগুলোতে এলেও আগুনের ব্যাপারে কাজ করেছিল নিয়ান্ডারথালরাই।
আগুনকে নিয়ন্ত্রণেও এনেছিল এরা। তবে তার অর্থ এই নয় যে, সবখানে নিয়ান্ডারথালরা সমানভাবে আগুনের ব্যবহার করেছিল। কিছু কিছু স্থানে আগুনের ব্যবহার মানুষের বৃদ্ধির চাইতেও বেশি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। আর অন্যান্য স্থানে আগুনের ব্যবহার ছিল না পর্যন্ত। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ডেনিস সানগ্যাথ এ ব্যাপারে প্রচুর অনুসন্ধানের পর এমন কিছু তথ্য পান যেগুলো নিয়ান্ডারথাল এবং আগুন সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনায় পানি ঢেলে দেয়। ফ্রান্সে তারা এমন দুটি নিয়ান্ডারথাল গুহা খুঁজে পান যেখানে প্রচন্ড ঠান্ডা থাকা সত্ত্বেও নিয়ান্ডারথালরা আগুন জ্বালায়নি। এমন আরো অনেক তথ্য সংগ্রহের পর ডেনিস সিদ্ধান্তে আসেন যে, আদতে নিয়ান্ডারথালরা আগুনের ব্যবহার কিছুটা জানলেও সেটা তৈরি করতে জানতো না।
আগুনকে হোমিনিডরা আয়ত্বে আনে ১২,০০০ বছর আগে। এর আগে নিয়ান্ডারথালরা চেষ্টা করেছে সবসময়, কিন্তু পারেনি। তাদের মধ্যে আগুনের ব্যবহার ছিল। তবে সেটা হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া আগুনকে কেন্দ্র করে। সেটাকেই তারা ব্যবহার করেছে, বেশিক্ষণ ধরে জিইয়ে রেখেছে ব্যবহারের জন্য। তবে নিজ থেকে আগুন জ্বালানোর কৌশল তাদের জানা ছিল না।
রোব্রোক এবং ভিলা অবশ্য সানগ্যাথের যুক্তিকে মেনে নেননি। তারা বলেছেন, সানগ্যাথের দেখানো সময়েরও অনেক পরের কথা। এই সময়েও সবখানে মানুষ আগুন ব্যবহার করেনি। তবে তার মানে এই নয় যে, তারা আগুনের ব্যবহার জানতো না। আর আগুনের ব্যবহার এরা জানতো নাকি জানতো না সেটা নিয়েও খুব বেশি প্রশ্ন করা হয় না। কারণ সবাই ধরেই নিয়েছে যে, এ সময় আগুনের ব্যবহার মোটামুটি মানুষের আয়ত্বের মধ্যে চলে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ তারা প্যালিওলিথিক যুগের শেষ ভাগ অর্থাৎ ১০,০০০ বছর আগেকার কথা বলেছেন।
রিচার্ড রাংহাম অবশ্য সমসাময়িক মানুষ আগুন ব্যবহার করে তৈরি খাবারের জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছে বলে মনে করেন না। মূলত, আগুন ব্যবহারের ব্যাপারটা পুরোটাই আপেক্ষিক। কারণ আগুন তৈরি হলে সেখান থেকে ছাই উৎপন্ন হয়। সেই ছাই উড়ে যেতে পারে বাতাসে। আগুন যদি আরো আগে জ্বলেও থাকে সেটার নিদর্শন যে থাকবেই তা-ও নয়। ঠিক তেমনি পানির মাধ্যমে আগুন জ্বলার কোনো নিদর্শন পাওয়া গেলেও সেটা যে ঐ নির্দিষ্ট এলাকাতেই জ্বলেছিল বা আগুন যে যেখানে নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সেখানেই ব্যবহৃত হয়েছিল সেটা বলা সম্ভব নয়। কারণ, পানি বহমান। সেইসাথে পানিতে মিশে থাকা সমস্ত পদার্থও। তো? কাদের হাত ধরে আগুন সর্বপ্রথম মানুষের কাছে এসেছিল? আমাদের অধিক বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন পূর্বপুরুষ, নিয়ান্ডারথাল, নাকি আধুনিক মানুষ- কারা ছিল আগুনের প্রথম নিয়ন্ত্রক? উত্তর নিয়ে বিতর্ক আছে বটে। তবে আগুন এবং আগুনের ব্যবহারের শুরুটা যে মানুষের হাত ধরেই হয়েছিল সেটা নিশ্চিত।
ফিচার ইমেজ: Getwallpapers.com