বর্তমানে পুরো পৃথিবীজুড়ে যে প্রাণীগুলো মানুষের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আদর-যত্ন পাচ্ছে, তার মধ্যে বিড়াল অন্যতম। কুকুরের পরেই ‘সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া পোষা প্রাণী’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ছোটখাট শারীরিক গড়নের এই প্রাণীটি। পালনে খুব বেশি খরচ না হওয়া, বাসাবাড়িতে থাকার জন্য একেবারে যথোপযুক্ত আচরণ করা কিংবা আদুরে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সবাইকে আকৃষ্ট করার মতো সর্বজনগ্রাহ্য বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে অসংখ্য বাড়িতে বিড়ালকে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখা হয়। এছাড়া বিড়াল ফসলের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর দমন কিংবা বিষাক্ত পোকামাকড়ের সাক্ষাৎ যমদূত হিসেবে কাজ করে মানুষকে শারীরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। আমাদের দেশেও বিড়াল অতি পরিচিত একটি প্রাণী, প্রায় সবখানে এর দেখা মেলে।
আজকের দিনে বিড়াল যেভাবে মানুষের সাথে সবদিক থেকে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, বিপরীতভাবে বললে মানুষ যেভাবে বিড়ালকে একেবারে ‘পরিবারের অংশ’ হিসেবে মেনে নিয়েছে, এর পেছনে প্রাচীন মিশরীয়দের অবদান সবচেয়ে বেশি। চার হাজার বছর আগে তারাই বিড়ালকে নিজেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে।
প্রাচীন মিশরীয় সমাজ ছিল কৃষিনির্ভর। এর পাশাপাশি শিকারের মাধ্যমেও খাবার যোগান দেয়ার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু কৃষিই ছিল প্রধান অর্থনৈতিক কাজ। আজকের দিনে বিজ্ঞানের জয়জয়কার দেখছি আমরা, উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবনের কারণে অল্প পরিমাণ জমিতেও বিশাল পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু চার হাজার বছর আগের প্রেক্ষাপটে প্রাচীন মিশরীয়দের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ছিল অতি অল্প, যা দ্বারা কোনোমতে দিন গুজরান করা যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বিষাক্ত পোকামাকড়ের জন্য ফসলের বড় অংশ নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা তো ছিলই। উৎপাদিত ফসল আবার ইঁদুরের উৎপাতের জন্য ঠিকমতো সংরক্ষণ করাও কঠিন ছিল।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অধিবাসীরা উৎপাদিত ফসল যেখানে সংরক্ষণ করত (বর্তমানে যেমন গুদামঘর রয়েছে), সেখানে ইঁদুরের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষাক্ত পোকামাকড়ের আগমন ঘটত। এসব বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে সেসময়ের মানুষের মারা যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর ইঁদুরের উৎপাতের ফলে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলও ঠিকমতো সংরক্ষণ করা যেত না। প্রাচীন মিশরীয়রা একসময় লক্ষ্য করে, বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ ও ইঁদুরের বিরুদ্ধে বুনো বিড়াল তাদেরকে বেশ ভাল সুরক্ষা দিচ্ছে। এরপর বুনো বিড়ালগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে আকৃষ্ট করা হয় (যেমন- মাছের মাথা খেতে দিয়ে)। এভাবে একসময় বুনো বিড়াল মানুষের কাছাকাছি আসতে থাকে, খাবারের জন্য তাদের সংগ্রাম কমে যায়। খাবারের জন্য যেহেতু বিড়ালগুলোর আর আগের মতো সংগ্রাম করতে হতো না, তাই প্রাকৃতিকভাবে তাদের আচরণেও পরিবর্তন আসে। আগের আক্রমণাত্মক, হিংস্র আচরণের বিড়ালগুলো হয়ে ওঠে সহনশীল, প্রাচীন মিশরীয়দের বাসাবাড়িতে জায়গা করে নেয় তারা।
মিশরীয়দের ফসল ইঁদুরের হাত থেকে সুরক্ষা এবং বিষাক্ত প্রাণী (যেমন- সাপ) ও পোকামাকড়ের কামড়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিড়ালকে রীতিমতো দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। এমনিতে প্রাচীন মিশরীয়রা সবরকমের প্রাণীর প্রতি অত্যন্ত সহনশীল ছিল। অপ্রয়োজনে তারা কোনো প্রাণীকে হত্যা তো দূরে থাক, কষ্ট দেয়া থেকেও বিরত থাকত। এমনকি যেসব প্রাণীকে তারা শিকার করতে, সেগুলোকেও তারা মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে মারত না। তাই বিড়াল যখন তাদেরকে বিভিন্ন দিক থেকে সুরক্ষা দিতে শুরু করল, তখন বিড়ালকে যে দেবতার মতো সম্মান করা হবে, তা অনুমিতই ছিল। মানুষ স্বভাবতই তার রক্ষাকারীকে আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্থান দিয়ে থাকে, বিড়ালের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। এজন্য বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ান বুনো বেড়ালকে বাড়ির ভেতরে পরিবারের সদস্যদের মতো করেই লালন-পালন করার চর্চা শুরু করে প্রাচীনকালের মিশরীয়রা। তারাই পৃথিবী প্রথম সভ্যতা, যেখানে বিড়ালকে বাইরে থেকে এনে ঘরের মধ্যে দেবতার সম্মান দেয়া হয়েছে।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় প্রথমদিকে যেসব দেবীকে সেসময়ের অধিবাসীরা খুব সম্মান করত, তার মধ্যে ‘মাফদেত’ অন্যতম। সাপ ও অন্যান্য বিষাক্ত জীবজন্তু ও পোকামাকড়ের হাত থেকে মুক্তির জন্য প্রাচীনকালের মিশরীয়রা মাফদেতের পূজা-অর্চনায় লিপ্ত থাকত। ধারণা করা হতো, মাফদেতের পূজা করলে তিনি বিড়ালের বেশ ধরে এসে বাড়িকে রক্ষা করবেন, বাড়ির অধিবাসীদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবেন। মিশরীয় পুরাণে তাকে দেখানে হয়েছে একজন নারীর দেহে চিতাবাঘের মাথাবিশিষ্ট অবয়ব হিসেবে। বিড়ালগোত্রীয় অন্যান্য প্রাণী, যেমন- চিতা বাঘ, সিংহকেও সেসময় প্রচন্ড ভক্তি করা হতো।
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় মাফদেতকে পরবর্তীতে ‘বাসতেত’ নামক আরেক দেবী দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। বাসতেতকে মিশরীয় পুরাণে একজন নারীর দেহে বিড়ালগোত্রীয় প্রাণীর মাথাবিশিষ্ট এক দেবী হিসেবে দেখানো হয়। ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতো বাসতেতকে সন্তুষ্ট করতে পারলে নারীদের গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানে কোনো সমস্যা হবে না এবং বাড়িতে শান্তি বিরাজ করবে ও অশুভ শক্তি কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। প্রাচীন মিশরের বুবাস্তিস শহর হয়ে ওঠে বাসতেতের পূজা-অর্চনা ও আরাধনার মূল কেন্দ্র। ঐতিহাসিক হেরোডটাসের মাধ্যমে জানা যায়, প্রতিবছর বুবাস্তিস শহরে বাসতেতের সম্মানার্থে বিশাল উৎসবের আয়োজন করা হতো।
বিড়ালকে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অধিকারীরা কতটুকু সম্মান করত, তা সেই সময়ের কিছু রীতিনীতি ও আইনের মাধ্যমে জানা যাবে। বিড়াল যখন মিশরের সম্পূর্ণ বাড়ির একজন সদস্য হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়, তখন আইন করে বিড়াল হত্যা কিংবা আঘাত নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সময়ে কেউ যদি অনিচ্ছাবশতও কোনো বিড়ালকে হত্যা করত কিংবা আঘাত দিত, তবে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হত। বিড়ালের গায়ে মূল্যবান অলংকার পরানো হতো। যদি কোনো বিড়াল মারা যেত, তাহলে বাড়ির লোকেরা শোকপ্রকাশের অংশ হিসেবে সকলেই ভ্রু ফেলে দিত। পরবর্তীতে যখন আবার ভ্রু গজাত, তখন শোকপ্রকাশ করা ঠিকঠাকমতো শেষ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো।
বাড়ির মেয়েদের অনেক সময় আদর করে ‘মিউত’ নামে ডাকা হতো। মিউত (Miut) বলতে সেই সময়ে বিড়ালকেই নির্দেশ করা হতো। মিশরের উত্তরাঞ্চলে উদ্ধার হওয়া প্রাচীনকালের অনেক কবর থেকে বিড়ালের মমি উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীন মিশরে বিড়াল মারা গেলে সেটাকে মমি করা হতো। তারপর বাড়ির কর্তার কবরের সাথে দিয়ে দেয়া হতো, যাতে পরবর্তী জীবনে বাড়ির কর্তা ও বিড়াল একসাথে থাকতে পারে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ও পারস্য সভ্যতার মধ্যে যুদ্ধ হয়। নীলনদের তীরে পেলুসিয়াম নামের একটি শহরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে ইতিহাসে একে পেলুসিয়ামের যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই যুদ্ধে পারস্যের রাজা দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেসের সেনাবাহিনী মিশরের ফারাও তৃতীয় সামেতিকের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়।
পারস্যের সেনাপতিরা মিশরীয়দের বিড়ালভক্তি সম্পর্কে আগে থেকেই জানতো। তাই আক্রমণের আগে তারা তাদের বর্মে বিড়ালে ছবি এঁকে নেয়। সেনাদলের একদম সামনে অসংখ্য বিড়াল ও অন্যান্য প্রাণী রাখা হয়, যাতে মিশরীয় সেনারা তাদের দেবীতুল্য প্রাণীকে আক্রমণ না করে। মিশরীয় সেনারা অনিষ্টের ভয়ে সেদিন বাস্তবেই পারস্যের সেনাদের আক্রমণ করেনি। কোনো রক্তপাত ছাড়াই পারস্যের হাতে পেলুসিয়াম শহরের পতন ঘটে।
যেহেতু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় অধিবাসীরা বিড়ালের কাছ থেকে নানারকমের সুরক্ষা পেত, তাই বিড়ালের জন্য তাদের মনে আলাদা জায়গা বরাদ্দ ছিল। তৎকালীন শিল্প-সাহিত্যে বিড়ালকে শ্রদ্ধার আসনে বসানো হয়েছে। সেই সময়কার কবরগুলো থেকে বিড়ালের মমি পাওয়ার ঘটনা অন্যান্য প্রাণী থেকে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে বিড়ালের মর্যাদাকে সমুন্নত থাকতেই দেখা যায়। মিশরীয়রা এমনিতেই প্রতিটি প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, আর বিভিন্ন দিক থেকে বিড়ালের গুরুত্ব বিবেচনায় সেই কদর যে আরও বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য।