মনের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে, মস্তিষ্কজাত চিন্তা-চেতনা বা অনুভূতিকে বাক সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশের নামই হলো ভাষা। যেমন এই যে লেখাটি পড়ছেন, এটির ভাষা বাংলা। এরকম পৃথিবীব্যাপী বর্তমানে ৬,৫০০টি ভাষা রয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে ২০০০টি ভাষায় তো কথা বলার মতো এক হাজার মানুষও পাওয়া যাবে না।
সুতরাং বলাই বাহুল্য, খুব জনপ্রিয় গুটিকতক ভাষার বিপরীতে, অপ্রচলিত ও মৃতপ্রায় ভাষার সংখ্যাই বেশি। তবে প্রায় সকল ভাষার ক্ষেত্রেই রয়েছে একটি অভিন্ন সাদৃশ্য: এসব ভাষার জন্ম হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখে ব্যবহৃত হতে হতে এসব ভাষার শব্দমালা ও ব্যকরণ একটি সংঘবদ্ধ রূপ লাভ করেছে। একই কথা প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি কিংবা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রেও।
তবে কিছু ব্যতিক্রমও যে নেই, তা কিন্তু নয়। এমন কিছু ভাষাও রয়েছে, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে বিকশিত হয়নি। বরং মানুষ নিজেরাই সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেছে। এসব ভাষাকে বলা হয় পরিকল্পিত বা কৃত্রিম ভাষা। আর এমন ভাষার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত যে ভাষাটি, সেটির নাম এসপেরান্তো। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ এ ভাষায় কথা বলে থাকে। তাই এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কথিত কৃত্রিম ভাষা।
এসপেরান্তো ভাষাটির জনক লুডভিক জামেনহোফ নামের একজন ডাক্তার। উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি এ ভাষাটি উদ্ভাবন করেন। সাধারণ ভাষা যেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে, সময়ের পরিক্রমায় এবং মানুষের ব্যবহার প্রণালীর উপর ভিত্তি করে নিজের ধর্ম লাভ করে, তার বিপরীতে তিনি এ ভাষাটির সৃষ্টি করেন একেবারেই পরিকল্পিতভাবে। এ ভাষার শব্দ ও ব্যকরণগুলো সৃষ্টি করেন তিনি, এবং অন্যান্য ভাষার মতো হাজার বছর ধরে ক্রমবিকাশের পরিবর্তে, প্রায় উন্নত ও পরিণত অবস্থাতেই এসপেরান্তো কড়া নাড়ে মানবসভ্যতার দুয়ারে।
নিজের সৃষ্ট এ নতুন ভাষা নিয়ে জামেনহোফের ছিল অনেক আশা, এবং তাই তিনি এর নামকরণও করেন এসপেরান্তো, যার অর্থ এ ভাষানুযায়ী “আশা”। জামেনহোফের লক্ষ্য ছিল একটি অভিন্ন ভাষার মাধ্যমে মানবজাতিকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসা, যা কিনা জাতিগত বিদ্বেষ দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে।
জামেনহোফ ছিলেন একজন ইহুদি। তিনি জন্মেছিলেন তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যে, যেখানকার সমাজ গভীরভাবে বিভক্ত ছিল অসংখ্য ধর্ম ও সম্প্রদায় ভেদে। তার অঞ্চলের জার্মান, পোল, ইহুদি ও রাশিয়ানরা একে অপরকে নিজেদের শত্রু বলে মনে করত, এবং সে কারণে তারা সব সময় নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মত্ত থাকত। রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল মূলত গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থারই একটি প্রতিফলন। এ সমস্যা কীভাবে নিরসন করা সম্ভব তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন জামেনহোফ। শেষমেষ তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, “ভাষাগত বৈচিত্র্যই হলো প্রথম, কিংবা অন্তত সবচেয়ে প্রভাবশালী ভিত্তি, যার কারণে মানব পরিবারে বিচ্ছেদ ঘটে বিভিন্ন শত্রু দলের সৃষ্টি হচ্ছে।”
পেশায় একজন চক্ষু চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও, জামেনহোফের বেজায় আগ্রহ ছিল ভাষার ব্যাপারে। তিনি কথা বলতে পারতেন একাধারে জার্মান, রাশিয়ান, যিদ্দিশ, পোলিশ ভাষায়। এছাড়াও তার মোটামুটি দখল ছিল লাতিন, ইংরেজি ও ইটালিয়ান ভাষাড় উপরও। তাই তিনি মনস্থির করেন, ভাষাকে কাজে লাগিয়েই বন্ধ করবেন পৃথিবীর যাবতীয় সহিংসতা, এবং মানবজাতিকে পুনরায় পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসবেন।
জামেনহোফের লক্ষ্য ছিল অনেকটা এমন যে: তিনি একটি এক ও অভিন্ন ভাষা সৃষ্টি করবেন, যে ভাষায় কথা বলা সম্ভব হবে সকল ভাষাভাষী মানুষের পক্ষেই, এবং এ ভাষায় কথা বলার মাধ্যমেই তারা নিজেদের মনের ভাব আদান-প্রদান করে নিজেদের সকল ভুল বোঝাবুঝি ও শত্রুতা দূর করতে সক্ষম হবে। এজন্য বহু বছর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের পর, ১৮৮৭ সালের ২৬ জুলাই এ পোলিশ ডাক্তার প্রকাশ করেন এসপেরান্তো ভাষার প্রথম ব্যকরণ বই, “উনুয়া লিব্রো” (প্রথম বই)। বইটির ভাষা ছিল রাশিয়ান।
নতুন এ ভাষাটির বেশ কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক ছিল।
- ইতিবাচক দিকসমূহের মধ্যে ছিল সহজ উচ্চারণ, সুসংগঠিত ব্যকরণ, সহজে মনে রাখার মতো শব্দ ইত্যাদি। বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান ভাষার সাথেই এ ভাষাটির অন্তঃস্থিত মিল বিদ্যমান ছিল, যে কারণে ইউরোপিয়ানরা সহজেই আয়ত্ত করে নিতে পারত ভাষাটি। তাছাড়া কোনো নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের অধীনে ছিল না ভাষাটি। ছিল একদমই নিরপেক্ষ। তাই যে কেউ নির্দ্বিধায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারত ভাষাটি। অন্য কোনো ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও এ ভাষাটি হতো বেশ সহায়ক।
- অন্যদিকে নেতিবাচক দিকের মধ্যে প্রথমত এ ভাষার অধিকাংশ শব্দ উচ্চারণ সহজ হলেও, কিছু কিছু ছিল সত্যিই অনেক কঠিন। তাছাড়া এ ভাষার ব্যকরণের ধরন ছিল অনেকটাই অন্যান্য ইউরোপিয়ান ভাষার মতো, যা এশিয়া বা পৃথিবীর বাকি অঞ্চলের মানুষের পক্ষে আয়ত্ত করা ছিল কঠিন। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বিশ্বব্যাপী খুব কম মানুষই পারত এ ভাষায় কথা বলতে, ফলে সার্বজনীন ভাষা হয়ে উঠতে পারছিল না এটি।
নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও, শুরু থেকেই সাফল্য পেতে থাকে নবসৃষ্ট এ ভাষাটি। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য নানা অঞ্চলে হাজার হাজার দল গঠিত হতে থাকে, যারা এ ভাষার চর্চা শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যেই দশ লক্ষাধিক সক্রিয় ব্যবহারকারী পেয়ে যায় ভাষাটি। এ ভাষায় কথা বলা মানুষদের জন্য বিভিন্ন সভা ও সম্মেলনের আয়োজন করা হতে থাকে, আর সেখানে মানুষের আনাগোনাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। এ ভাষায় বইও প্রকাশিত হতে থাকে নিয়মিতভাবে।
সব মিলিয়ে জামেনহোফের স্বপ্ন ছিল পূরণের দ্বারপ্রান্তে। মনে হচ্ছিল, ভাষাটি পুরোদস্তুর বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক ভাষা হতে না পারলেও, বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যকার সেতুবন্ধনের একটি নিরপেক্ষ মাধ্যম হিসেবে অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে এটি।
এমনকি বেলজিয়াম ও জার্মানির মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত নিউট্রাল মরেসনেট তো এসপেরান্তোকে তাদের আনুষ্ঠানিক ভাষার স্বীকৃতিও প্রায় দিয়েই ফেলেছিল। দুইটি শত্রু দেশের মাঝখানে থেকে চ্যাপ্টা হতে থাকা ক্ষুদ্রাকার এ দেশটি ভেবেছিল, জার্মান বা ফরাসি ভাষার বদলে একটি নিরপেক্ষ ভাষায় কথা বলতে পারলেই বুঝি লাভ হবে তাদের।
কিন্তু এসপেরান্তোকে নিয়ে যত উচ্চাশা ছিল, সেগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায় দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধই ছিল এ ভাষার অগ্রগতির পথে একটি বিশাল বড় ধাক্কা। কেননা স্পষ্টতই, বিশ্বব্যাপী রক্তের বন্যা বইতে থাকে, অথচ মানবজাতিকে একাট্টা করার লক্ষ্যে উদ্ভূত ভাষাটি তা থামাতে কোনো সাহায্যই করতে পারছিল না।
যুদ্ধের সময় জার্মানরা নিউট্রাল মরেসনেট দখল করে নেয়। আর যুদ্ধ শেষে এ দেশের ক্ষমতা যায় বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের হাতে। এভাবেই স্বাধীনতা হারায় দেশটি, এবং এসপেরান্তো নিয়ে তাদের সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ইতি ঘটে।
তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরও আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিল এ ভাষাটিকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার। ১৯২০ এর দশকে এটিকে লিগ অব নেশন্সের আনুষ্ঠানিক ভাষা করারও চেষ্টা-চরিত্র করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাবনায় ভেটো দেয় ফ্রান্স। তবে মজার ব্যাপার, সোভিয়েত রাশিয়াও একটা সময় পর্যন্ত ছিল এ ভাষার পক্ষে। স্ট্যালিন নাকি এ ভাষা নিয়ে পড়াশোনা পর্যন্ত করেছিলেন।
তবে সে যা-ই হোক, লিগ অব নেশন্সের অনুমোদন না পেলেও, ১৯২০ এর দশকে এসপেরান্তোর জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে। প্রচুর বই প্রকাশিত হয় এ ভাষায়। পত্রিকাও প্রকাশিত হতে থাকে বেশ কিছু। সব মিলিয়ে এটি ছিল এ ভাষার জন্য এক স্বর্ণালী যুগ।
কিন্তু ফের জামেনহোফের স্বপ্নের পালে ধাক্কা লাগে হিটলার ক্ষমতায় এলে। হিটলার ছিলেন এ ভাষার খুব বড় ধরনের বিদ্বেষী। “মাইন ক্যাম্ফ” বইয়ে তিনি এসপেরান্তোকে অভিহিত করেছিলেন ইহুদি জাতি কর্তৃক বিশ্বের দখল নেয়ার জন্য যে ষড়যন্ত্র চলছে, তার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে।
নাজিরা এসপেরান্তো ভাষায় কথা বলা মানুষদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করত, কেননা এ ভাষার জনকই যে একজন ইহুদি। তাই হিটলার যখন চূড়ান্ত ক্ষমতায় এলেন, তখন তার হামলার প্রথম শিকার হলো এসপেরান্তিস্টরাই (যারা এসপেরান্তো ভাষায় কথা বলে)। অবশ্য কিছু এসপেরান্তিস্ট এ ভাষার মূল আদর্শের সাথে প্রতারণা করে, নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে নাজিদের সাথে হাত মেলাবার চেষ্টা করেছিল। এমনকি তারা অন্য ইহুদিদের নিধনের ক্ষেত্রে নাজিদের সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। তবে নাজিরা বিশ্বাস করেনি এ বিশ্বাসঘাতকদের। তাই বাকি এসপেরান্তিস্টদের সাথে তারা এদেরকেও হত্যা করে।
এভাবেই এসপেরান্তো ভাষার কফিনে শেষ পেরেকটিও বিদ্ধ করা হয়। তবে ভাগ্যক্রমে, এ চরম দুর্দিন দেখে যেতে হয়নি জামেনহোফকে। ১৯১৭ সালে, ৫৭ বছর বয়সেই মৃত্যু ঘটেছিল তার। কিন্তু নাজিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তার পরিবার। তার পুত্র, যিনি নিজেও ছিলেন একজন চিকিৎসক, গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আর তার কন্যার মৃত্যু হয় ট্রেবলিঙ্কা এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পে। এছাড়া তার অন্য আরেক কন্যারও মৃত্যু হয়েছিল হলোকাস্টে।
অবশ্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে গোপনে টিকে ছিল এসপেরান্তোর ব্যবহার। সেখানে এ ভাষা জানা বন্দিরা অন্যদের শেখাত ভাষাটি, যাতে করে তারা নিজেদের মধ্যে সহজে যোগাযোগ করতে পারে। অবশ্য প্রহরীদের বোকা বানাবার জন্য তারা বলত, তারা নাকি ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলছে। প্রহরীরাও এ কথা বিশ্বাস করত, কেননা এসপেরান্তোর সাথে বেশ মিল ছিল ইটালিয়ান ভাষার।
সোভিয়েত রাশিয়ার কাছেও এক পর্যায়ে ভাষাটি এক চক্ষুশূলে পরিণত হয়। শুরুর দিকে এ ভাষার অনুরাগী হলেও, পরবর্তী স্ট্যালিন নিজেও এ ভাষাভাষীদেরকে হত্যা করতে শুরু করেন। এছাড়া অনেককে গুলাগেও পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জামেনহোফের সৃষ্ট শান্তির বার্তাবাহী এ ভাষা এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতেও ব্যবহার শুরু হয়, কিন্তু তা মূলত প্রশিক্ষণকালে শত্রুপক্ষের কাল্পনিক ভাষা হিসেবে।
এরপরও এসপেরান্তোকে একটি সফল ভাষা বলতেই হবে। কারণ এত বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করে মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলেও, আজও টিকে রয়েছে ভাষাটি, এবং তা-ও বেশ ভালোভাবেই। ১২০টিরও বেশি দেশে বর্তমানে কথা বলা হয় এ ভাষায়। উইকিপিডিয়া এ ভাষার জন্য চালু করেছে একটি বিশেষ সংস্করণ, যেটি তাদের ৩২তম বৃহত্তম সংস্করণ। ভিকিপিডিও নামের সে সংস্করণটিতে বর্তমানে আর্টিকেলের সংখ্যা ২,৬১,০০০। ১,৫১,০০০ মানুষ নিয়মিত ভিজিট করে ভিকিপিডিও। এছাড়া ভাষা শেখার অ্যাপ ডুয়োলিঙ্গোতেও পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ এ ভাষাটি শেখার জন্য সাইন আপ করেছে।