সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা বুঝি যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যেকোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং সেখান থেকে নতুন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম হয়। নতুন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটাতে হলে সেটি অবশ্যই পুরনো জ্ঞানের সাথে সংঘাতপূর্ণ অথবা অপূর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ পুরনো জ্ঞানের যে সমস্যাদি রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সমাধানের মাধ্যমেই নতুন জ্ঞান আরোহণ সম্ভব। যেসকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নতুন জ্ঞান আরোহণের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় আধুনিক গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্বে বিশ্ববিদ্যালকে শুধুমাত্র পাঠদানের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান এবং নতুন জ্ঞানের উদ্ভবের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে।
আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এবং ভাষাতাত্ত্বিক ভিলহাল্ম হামবোল্ডট। কান্ট মনে করতেন, কোনো বিষয়ে একটি সত্যই সার্বিক সত্য। অর্থাৎ কোনো একটি বিষয় প্রমাণিত হলে তা স্থান, কাল ও পাত্রভেদে সকল স্থানেই সত্য এবং প্রযোজ্য। অন্যদিকে ভাষাতাত্ত্বিক হামবোল্ডটের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা অনুযায়ী, গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধুমাত্র জ্ঞান লাভ করে তা ব্যাখ্যা করা নয়; প্রাপ্ত জ্ঞানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক থাকার পাশাপাশি এর সমস্যা নির্ণয় করে সমাধান অনুসন্ধান করা। এক্ষেত্রে কোনো জ্ঞানের পক্ষেই সার্বিক বা চিরস্থায়ী হবার সুযোগ থাকে না। সে কারণে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনক হিসেবে হামবোল্ডটের নামই এগিয়ে থাকে।
নালন্দার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা। বর্তমান ভারতের বিহারের মগধে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, সেসময় এ অঞ্চলে গুপ্তদের শাসনামল চলছিল। সে অনুযায়ী, নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্রাট কুমারগুপ্তকেই ধরে নেয়া হয়। পরবর্তীতে পাল রাজাদের আমলে শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ অগ্রগতি লাভ করে নালন্দা। ধর্মপালের সময়ে বিক্রমশীলা, সোমপুর ও ওদন্তপুরী প্রতিষ্ঠিত হলে তা নালন্দা মহাবিহারের জ্ঞানচর্চার গতিকে আরও ত্বরান্বিত করে। পূর্বের সেই সোমপুর বর্তমান বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থিত। অর্থাৎ নালন্দার কল্যাণে সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চা শুরু হয়। সে বিবেচনায় গবেষক সৈয়দ নিজারের বক্তব্য অনুসারে, সোমপুরকে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যায়িত করলে বোধহয় ভুল হবে না।
নালন্দা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা দেন চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং। তার বক্তব্য থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান-পতন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। চতুর্থ শতকের দিকে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ধারা দ্বাদশ শতক কিংবা তার পরবর্তী বেশ কিছু সময় পর্যন্ত চলমান ছিল। হিউয়েন সাংয়ের অবস্থানকালে নালন্দায় প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়। সপ্তম শতকের দিকে নালন্দা শিক্ষা-দীক্ষায় সবচে বেশি পূর্বগামিতা লাভ করেছিল বলেও ধারণা করা হয়। প্রায় ১০০ শ্রেণীকক্ষ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাসহ সে সময় প্রায় দুই হাজার শিক্ষক এবং ২০ হাজার শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে তৎকালীন পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নালন্দার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তখন নালন্দায় শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতো। কোরিয়া, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক, তিব্বতসহ আরও বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীবৃন্দের সম্মিলনে মুখরিত থাকতো নালন্দার ক্যাম্পাস। শিল্পজ্ঞান সমৃদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক এবং সভা অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য ছিল বিশেষ কক্ষ এবং সে কক্ষগুলো শুধুমাত্র এসব কাজেই ব্যবহার করা হতো।
সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার
নালন্দার সমৃদ্ধ ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গেলে সবার আগে নালন্দার লাইব্রেরি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। প্রাচীন আমলে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য শিক্ষার্থী-গবেষকদের জন্য নালন্দার বিকল্প ছিল না। পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাদের উদার নৈতিকতার দরুন নালন্দা পেয়েছিল বিশাল এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ। নালন্দায় সংরক্ষিত পুস্তকের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, সেখানে প্রায় নব্বই লক্ষাধিক পুস্তক সংরক্ষিত ছিল। গ্রন্থাগার তিনটি পৃথক দালানে বিস্তৃত ছিল। এদের নামকরণ করা হয় রত্নসাগর, রত্নদধি এবং রত্নরঞ্জক নামে। এদের মধ্যে রত্নদধির ছিল প্রায় নয়তলা বিশিষ্ট ভবন। এসব গ্রন্থাগারে শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক পুস্তকের পাশাপাশি ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা সংবলিত গ্রন্থাবলিও ছিল।
আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের প্রথম গবেষণাকেন্দ্রিক আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়ে থাকে। এর পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পাঠদান কেন্দ্রিক। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে তার উন্নত শিক্ষার বিকাশকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণমূলক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হতো। ১৮০৯ সালে গবেষণা কার্যক্রম চালাবার উদ্দেশে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠ এবং শিক্ষার্থীদের তরুণ গবেষক বলা হতো। মূলত জ্ঞানের যেকোনো শাখায় কোনো তত্ত্ব বা বিষয়ে সংঘাতপূর্ণ বা স্ববিরোধিতাপূর্ণ সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করাই ছিল গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। তবে তখনও পর্যন্ত তা পূর্ণতা পায়নি। কেননা সেসময় সম্ভ্রান্ত এবং ধনী পরিবারের সন্তানেরাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেত। পরবর্তীতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের শিক্ষার সুযোগ দেয়া হয়।
নালন্দা মহাবিহারে প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানের বিস্তার, প্রসার এবং উদ্ভব। অর্থাৎ এর প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং উদ্দেশ্যগত দিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার কোনো পার্থক্য নেই। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই গবেষণার কাজ করতে হবে। আর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মূল কাজই ছিল নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ। কেননা নালন্দার শিক্ষার্থী-অধ্যাপকবৃন্দ কোনো জ্ঞানকেই সার্বিক জ্ঞান মনে করতেন না। তারা সকল সত্যকেই আংশিক সত্য মনে করতেন, যাকে সংস্কৃত ভাষায় ‘সংবৃত’ বলা হয়। এবং সকল জ্ঞানকে সংবৃত ধরেই তারা নতুন জ্ঞান আরোহণের পথে অগ্রসর হতেন, যা বর্তমান আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভিত্তি।
তৎকালীন নালন্দায় জ্ঞান অর্জন ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত। কোনো ধরনের শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণগত বৈষম্যের উপস্থিতি সেখানে ছিল না। হিউয়েন সাংয়ের বক্তব্য অনুসারে জানা যায়, তখন প্রতি ১০ জনের মধ্যে দুজন নালন্দায় শিক্ষার সুযোগ পেত এবং তা ছিল মেধার ভিত্তিতে। প্রাচীন নালন্দার এসব বৈশিষ্ট্য বর্তমানকালের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় পশ্চাৎপদ ছিল না, বরঞ্চ কালের প্রেক্ষাপটে তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং উন্নত। সময় বিবেচনায় নালন্দাকে তাই পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়।
শুরু থেকে শুরু
নালন্দা হয়তো শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতাতেই স্থায়ী হতে পারতো। তবে একে পুনরায় জাগ্রত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম। তার একান্ত প্রচেষ্টার ফলে আবারও প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে ২০১০ সালে একটি বিল পাশের মাধ্যমে পুনরায় এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।
প্রায় ৮০০ বছর পর নির্ধারিত কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শুরু হচ্ছে নালন্দার পুনঃযাত্রা। প্রাথমিকভাবে ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, পররাষ্ট্রনীতি, পরিবেশবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর শিক্ষাদান পদ্ধতি হবে গবেষণাকেন্দ্রিক। সেকারণে দেশ-বিদেশের হাজারো আবেদন থেকে বাছাই করে ১৫ জন শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছেন। আচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবীদ অর্মত্য সেন।
কোটি কোটি টাকা খরচ করে নালন্দার অবকাঠামো উন্নয়ন করা হলেও এখনো মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পদচারণ ঘটেনি। ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দা মহাবিহার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের এক কনভেনশন সেন্টারে বর্তমানে ক্লাস করছে নালন্দার শিক্ষার্থীরা। খুব শীঘ্রই মূল ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হবে বলে জানিয়েছেন নালন্দার মেন্টরেরা।
পশ্চিমা বিশ্ব যখন পাঠদানকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা থেকে বের হয়ে আধুনিক গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণের দিকে ঝুকছে তখন নালন্দার মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় মহাকালের সাক্ষী হয়ে আছে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোকে কৃতিত্ব দেয়া হলেও এদের হাজারো বছর পূর্বে ভারতবর্ষের মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম এবং বর্তমানকালের প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয়।
ফিচার ইমেজ– Buddhist International