দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষের দিকের কথা। ততদিনে নাৎসি জার্মানির অবস্থা বেশ করুণ হয়ে পড়েছে। ধরেই নেয়া হচ্ছিল যে এই যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হবে। তারপরও দেশটি তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। যদিও তখন যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আর কারো কোনো সন্দেহ ছিল না।
পূর্ব ইউরোপে জার্মানির অবস্থা আরও বেশি করুণ ছিল। ইতিমধ্যে সোভিয়েত বাহিনী বিজয়ের মুখ দেখতে শুরু করেছে। ইস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর মোট সৈন্যের প্রায় তিন ভাগই নিহত বা আহত হয়ে পড়েছিল। এদিকে জার্মানিকে রুখতে সোভিয়েতরা যে খুব সহজেই পার পেয়ে গেছে এমনটা কিন্তু নয়। ধারণা করা হয়, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাত ভাগের এক ভাগই নিহত হয়েছিল। সংখ্যার বিচারে যা ছিল আড়াই কোটির বেশি। এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
তাছাড়া দেশটির প্রধান প্রধান শহর, বন্দর, নগর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কৃষি, শিল্প, রাস্তাঘাট এবং ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই সময়ই জোসেফ স্টালিন তার দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন জার্মানিকে ভাগ করে ফেলতে, যাতে করে দেশটি আর কখনো হুমকির কারণ হয়ে উঠতে না পারে। একইসাথে তিনি নিজের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য জার্মানির কাছ থেকে মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন এসব পেতে হলে তাকে পশ্চিমা বিশ্বের আস্থা অর্জন করতে হবে। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের মতিগতির ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আগে থেকেই জানতেন। কারণ, ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে স্টালিনের সঙ্গে মস্কোতে এক বৈঠকে বসেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য যুদ্ধে নেমেছিল ১৯৩৯ সালে। কেননা, সেই বছর সেপ্টেম্বরে তার মিত্রদেশ পোল্যান্ডে আক্রমণ করে বসেছিল জার্মানরা। সেই যুদ্ধে যুক্তরাজ্য জার্মানিকে পরাস্ত করতে পারলেও তাদেরকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আশা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন দেবে এবং একইসাথে স্টালিনের পাশেও দাঁড়াবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের নিজেরও বেশ কিছু দাবিদাওয়া ছিল। তিনি চেয়েছিলেন যুদ্ধপরবর্তী শান্তিরক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘে স্বাক্ষর করুক জোসেফ স্টালিন। পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন সোভিয়েতরা যেন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকে জাপান আক্রমণ করে। যদিও কৌশলগত দিক দিয়ে সবকিছুই জাপানের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল, কিন্তু তারপরও জাপানীরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন জাপানী দ্বীপে রক্তক্ষয়ী আগ্রাসন চালানোর কথাও ভেবেছিল।
নিজেরা যখন জয়ের সুবাতাস পেতে শুরু করেছে তখন বিশ্বের তিন পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন কৃষ্ণসাগরের তীরে সোভিয়েত রিসোর্টের শহর ইয়াল্টায় আলোচনার টেবিলে বসতে সম্মত হন। অবস্থা তখন এমন ছিল যে, জার্মান নাৎসি বাহিনীর অবস্থা সঙ্গিন, সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনের কাছে পৌঁছে গেছে এবং মিত্রবাহিনী জার্মানির পশ্চিম তীর অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী জাপানের দিকে অগ্রসরমান। ঐতিহাসিকভাবে এই তিন পরাশক্তির রাষ্ট্রপ্রধানগণ ‘বিগ থ্রি’ নামে পরিচিত।
পৃথিবীতে এত এত জায়গা থাকতে ইয়াল্টাই কেন বেছে নেয়া হয়েছিল? প্রথমত, রুজভেল্ট ভূমধ্যসাগরীয় কোনো এক এলাকায় এই সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জোসেফ স্টালিনের ছিল বিমানভীতি। যেহেতু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তখন যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল তুঙ্গে, সে কারণেই স্টালিন তাতে সায় দিলেন না। তিনি ইয়াল্টায় বৈঠকের প্রস্তাব দেন। ৪ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন প্রতিনিধি দলের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের আবাসস্থল লিভাদিয়া প্রাসাদে, যেটি রাশিয়ার শেষ জার নিকোলাস-২ এর গ্রীষ্মকালীন বাসভবন ছিল। এত ঘটা করে বিশ্বের তিন পরাশক্তির রাষ্ট্রপ্রধানরা এই বৈঠকের আয়োজন করলেও এটাই কিন্তু তাদের প্রথম বৈঠক ছিল না। এর আগে ১৯৪৩ সালে ইরানে একই টেবিলে বসেন ক্ষমতাধর এই তিন ব্যক্তি।
কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বৈঠকে?
ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট চার্চিলের তুলনায় জোসেফ স্টালিনকে বেশি বিশ্বাস করতেন। কারণ, চার্চিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইউরোপের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে দেখতো। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মানিকে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে বের করে দিয়েছে এবং এসমস্ত জায়গা বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে রয়েছে। সোভিয়েতরা যদি তাদের সৈন্যদের ঐ সমস্ত অঞ্চলে রেখে দিতে চায়, তাহলে যুক্তরাজ্যের জন্য কিছুই করার থাকবে না।
এতসব জটিলতা এবং শর্তের দর কষাকষি নিয়ে যখন তিন পরাশক্তি এক টেবিলে বসলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বের নজর ছিল ইয়াল্টার প্রতি। ১৯৪৫ সালের ৪-১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের পর ঐতিহাসিক তিন ব্যক্তি তাদের সিদ্ধান্ত জানালেন বিশ্ববাসীকে।
যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি ছিল এমন:
১. নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর জার্মানিকে দু’ভাগে ভাগ করা হবে।
২. জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হবে এবং মস্কোতে এ সংক্রান্ত একটি কমিশন গঠন করা হবে ।
৩. পোল্যান্ডসহ ইউরোপ জুড়ে মুক্ত এলাকাগুলোতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে এবং নতুন সরকার গঠিত হবে।
৪. সোভিয়েতরা ওয়ারশ-তে যে প্রভিশনাল কমিউনিস্ট সরকার আছে সেটিও সম্প্রসারিত করবে।
পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং সরকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে ঐক্যমত পোষণ করলেও জোসেফ স্টালিনের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ ছিল ভিন্ন। কেননা সোভিয়েত বাহিনী ইতিমধ্যে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে। এজন্য স্টালিন অনুরোধ জানালেন পোল্যান্ডের সীমানা যেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভূমি দিয়ে কিছুটা ইউরোপের দিকে সরে আসে। নেতারা তার দাবিতে সম্মতিও জানান।
বৈঠকে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট বেশি আগ্রহী ছিলেন তার জাতিসংঘ পরিকল্পনা নিয়ে এবং তিনি সফল হন। কারণ তার প্রস্তাবে তিন দেশই সম্মত হয়। ২৫ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে প্রতিনিধি পাঠাতেও একমত হন এই তিন পরাশক্তির রাষ্ট্রপ্রধানগণ। এতসব চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পরও পূর্ব ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন চার্চিল। ঠিক এই কারণেই তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই তার বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্রকে দূরপ্রাচ্যের দিকে সরে আসতে বললেন।
ফলাফল
বৈঠকের চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বৈশ্বিক রাজনীতির নাট্যমঞ্চে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। সে বছরই ১২ এপ্রিল মারা গেলেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসলেন হ্যারি ট্রুম্যান। ৭ মে জার্মানি আত্মসমর্পণ করল এবং ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালাল। পরীক্ষার পরদিনই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান, উইনস্টন চার্চিল এবং জোসেফ স্টালিন বার্লিনের বাইরে পটসড্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেন। এটা ছিল ট্রুম্যানের সাথে চার্চিল এবং স্টালিনের প্রথম সাক্ষাৎ।
হ্যারি ট্রুম্যান জোসেফ স্টালিনকে তেমন জানতেন না। অন্যদিকে জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের নতুন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসলেন ক্লিমেন্ট এটলি। সম্মেলনে বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী। হ্যারি ট্রুম্যান স্ট্যালিনের ব্যাপারে বেশ সন্দিহান ছিলেন। কারণ তিনি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতেন যে স্টালিন ইয়াল্টার চুক্তি মেনে চলবেন না।
এর ঠিক দুই বছরের মধ্যেই এলো ট্রুম্যান ডকট্রিন অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশ টেনে ধরার ঘোষণা দিল। ফলশ্রুতিতে শুরু হয়ে গেল স্নায়ুযুদ্ধ। এরপরেই ইয়াল্টার বৈঠকের সমালোচনা হতে থাকল। সমালোচনা হলো ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং উইনস্টন চার্চিলেরও। কেননা সেসময় যুক্তরাষ্ট্র মনে করত ইয়াল্টার বৈঠকে জোসেফ স্টালিনকে বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৫ সালের ঐ মুহূর্তে রুজভেল্টের কিছুই করার ছিল না, কারণ সোভিয়েত বাহিনী তখন মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছিল।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু বেসভিক বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে এই বৈঠক সম্পর্কে বলেন “ইয়াল্টা বৈঠকের উদ্দেশ্য যদি হয় যুদ্ধের পর শান্তি আনা, তাহলে বলতেই হয় সেটি ব্যর্থ হয়েছে।“
এত আলোচনা-সমালোচনার পরও ঐতিহাসিক ইয়াল্টা বৈঠক শান্তি স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। কেননা ঐ বৈঠকে ৭৫ বছর আগে রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধের পর এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে আর না হয় সেটিই তারা চেয়েছিলেন। ইয়াল্টা বৈঠক না হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষাংশের পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। বিশেষ করে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের মুক্তাঞ্চলগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইয়াল্টা বৈঠক বৈশ্বিক রাজনীতিতে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।