সামুরাই নামটি নিতেই মনে পড়ে যুদ্ধের বর্ম পরা কাতানা তরবারি হাতে একদল জাপানি সৈন্যের কথা। অথবা মনে পড়ে যায়, পঞ্চাশের দশকে প্রকাশ পাওয়া আকিরা কুরোসাওয়ার বিখ্যাত সিনেমা ‘সেভেন সামুরাই’য়ের কথা। আর নয়তো একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে টম ক্রুজ অভিনীত ‘দ্য লাস্ট সামুরাই’ সিনেমার কথা নাড়া দেবে স্মৃতিকাতর মনকে। নব্বই দশকের প্রজন্মের জনপ্রিয় ভিডিও গেমস ‘সামুরাই শোডাউন’ কিংবা সে সময়েরই জনপ্রিয় অ্যানিমেশন সিরিজ ‘সামুরাই এক্স’কেও বাদ দেয়া যায় না এ তালিকা থেকে।
সামুরাইদের উৎপত্তিটা মূলত হেইয়ান পিরিয়ডে (৭৯৪-১১৮৫)। সে সময় ধনী, সম্ভ্রান্ত এবং জমির মালিকরা নিজেদের পাশাপাশি জমির দেখভালের জন্য ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী রাখতেন। মূলত সামুরাইদের পূর্বপুরুষরাই এই ধনী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ‘সামুরাই’ শব্দটির অনূদিত অর্থ হচ্ছে- যে বা যারা সেবাদান করে। মালিকের সেবা করে জীবিকা নির্বাহ করা ছিল সামুরাইদের পেশা বা কর্তব্য। তবে শুধুমাত্র ভূস্বামীদের ব্যক্তিগত বাহিনীতে না থেকে ধীরে ধীরে সামুরাইরা বিশেষ এক যোদ্ধা শ্রেণিতে পরিণত হয়ে উঠেছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের অধীনে থেকেই সামুরাইরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অঞ্চল রক্ষার জন্য লড়াই করত। এমনকি সরকার কর্তৃক চিহ্নিত শত্রু, বৈরী উপজাতি এবং দস্যুদের সঙ্গেও যুদ্ধ করত। এভাবেই সামুরাই যোদ্ধারা এক বিশেষ আর সুদক্ষ যোদ্ধা শ্রেণিতে পরিণত হয়ে ওঠে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই প্রাদেশিক যোদ্ধাদের দক্ষতাই তাদেরকে শুধুমাত্র সামরিক যোদ্ধাই নয়; বরং আগামী ৭০০ বছরের জন্য জাপানে শাসক শ্রেণির সঙ্গে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম করেছিল। অষ্টাদশ শতকে মেইজি সংশোধনের মধ্য দিয়ে সামুরাইদের বিলুপ্তি ঘটার আগ অবধি জাপান সরকার সামুরাইদের জাতীয় যোদ্ধা বলে পরিচয় দিয়েছিল।
আনুগত্যবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা এবং নৈতিকতা- এগুলোই ছিল সামুরাইদের দায়িত্ব আর কর্তব্যের মুখ্য বিষয়। একজন সামুরাইয়ের কাছে কাতানা তরবারির গুরুত্ব অনেক, এটাই ছিল তাদের প্রধান অস্ত্র। এছাড়াও, ওয়াকিজাশি নামক দু’টি ছোট তরবারিও সবসময় তাদের সঙ্গে থাকত। মার্শাল আর্টে পারদর্শী সামুরাইরা সঙ্গে তীর-ধনুকও রাখত। তবে একজন পূর্ণ সামুরাইয়ের কাছে দুটো সামুরাই সোর্ড বা কাতানা তরবারি থাকত। এটা অনেকটা প্রতীকের মতো হয়ে গিয়েছিল তাদের জন্য। এই কাতানা তরবারিকে বলা হতো সোল অভ দ্য সামুরাই, মানে সামুরাইয়ের আত্মা।
কোনো সামুরাইয়ের যদি কখনো ভুলেও মনে হতো যে, তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব আর কর্তব্য পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছে; কিংবা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়; তাহলে তৎক্ষণাৎ প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করত। ‘পরাজয়’ বলতে কোনো শব্দ যেন তাদের জীবনে ছিল না। তারা পরাজিত হয়ে জীবনধারণের চাইতে মৃত্যুকে গ্রহণ করা শ্রেয় মনে করত। নিজের পেটে নিজেই তরবারি ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করার এ প্রথা অনুষ্ঠানেও রূপান্তরিত হয়েছিল; যা হারা-কিরি বা সেপ্পুকু নামেই পরিচিত।
আজকের আয়োজনে থাকছে এক সামুরাইয়ের জীবনগল্প। তবে তিনি জাপানের আর দশটা সামুরাইয়ের মতো নন। কারণ তিনি আদতে জাপানি নাগরিকই ছিলেন না। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন, একজন আফ্রিকান নাগরিক। জাপান এবং পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র বিদেশী বংশোদ্ভূত সামুরাই ছিলেন এই ব্যক্তি। ইয়াসুকে ছিল তার নাম। এ লেখায় আজ আমরা একজন আফ্রিকানের সামুরাই হবার পেছনের কাহিনীটাই জানব।
ইয়াসুকে নামটি সম্ভবত হিব্রু আইজ্যাক (Issac>Yasuke) নামের জাপানি বিকৃত রূপ। ইয়াসুকেকে জ্যাং নৃগোষ্ঠীর কট্টরবাদী একজন অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে এই নৃগোষ্ঠীকে ‘ডিংকা’ও বলা হয়ে থাকে। ডিংকা মূলত একটি অঞ্চলের নাম, যা বর্তমান দক্ষিণ সুদান রাষ্ট্রের অন্তর্গত। তবে ইয়াসুকেকে জ্যাং নৃগোষ্ঠীর মানতে রাজি নন অনেকেই। কেননা, ইয়াসুকের জন্মতারিখ আর জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই কারোর। আবার অনেক ইতিহাসবিদ তাকে মোজাম্বিকের বাসিন্দা বলে থাকেন। অনেকে আবার অন্যান্য দেশের কথাও বলে থাকেন, যেমন ইথিওপিয়া বা নাইজেরিয়া। এ-ও প্রচলিত আছে যে, আরব দেশের বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশের নাগরিক ছিলেন ইয়াসুকে।
২০১৩ সালে ‘ডিসকভারি অভ ওয়ার্ল্ড মিস্ট্রি’ নামক এক টিভি প্রোগ্রাম ইয়াসুকেকে নিয়ে একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠান নির্মাণ করে। সে অনুষ্ঠানের তদন্ত অনুসারে, ইয়াসুকে নামকরণটা করা হয়েছিল ‘ইয়াসুফে’ নাম থেকে। তিনি ছিলেন মাকুয়া বা মাখুয়াহ নৃগোষ্ঠীর একজন সদস্য। ইয়াসুফে নামটা মোজাম্বিকের উৎস হতে উদ্ভূত এবং এটি অনুবাদ করলে আসে ইসুফো (Issufo)। যা-ই হোক, এ বিবৃতি বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক বিশ্বাস করেন না। কেননা, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময়ে মাকুয়া বা মাখুয়াহর সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার কোনো যোগাযোগই ছিল না। ইতিহাস বলে, প্রথমবারের মতো মাকুয়া বা মাখুয়াহর সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ হয় ১৮৫৭ সালে, যখন পর্তুগিজরা মোজাম্বিক সফরে গিয়েছিল।
বালক বয়সেই ইয়াসুকে দাস ব্যবসার শিকার হয়েছিল। তাকে দাস হিসেবে ভারতে পাচার করে দেয়া হয়। টোকিওর নিহোন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক থমাস লকলে ধারণা করেন, দাস হিসেবে বিক্রি করা হলেও ইয়াসুকেকে দাসের পাশাপাশি শিশুযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ভারতের গুজরাট এবং গোয়া রাজ্যে তাকে থাকতেও হয়েছিল শিশুযোদ্ধা হিসেবে। হয়তো সেখানেই যোদ্ধার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তাকে। তখনকার দিনে পর্তুগিজদের সামরিক, ধার্মিক প্রচার আর বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল গোয়া। আর আফ্রিকান দাস বেচাকেনার জন্য এশিয়ার অন্যতম সেরা জায়গাও ছিল এটি।
আবার অনেকে মনে করেন, তখনকার সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের বেশিরভাগই দাস হতো বিধায় তাকেও দাস বলে গণ্য করা হয়। তবে উপযুক্ত বিবৃতিমতে, দাস হিসেবে বিক্রি হলেও শিশুযোদ্ধার প্রশিক্ষণে দক্ষ ছিলেন ইয়াসুকে। আর এ বিষয়েই উপযুক্ত আর যথার্থ প্রমাণ উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদেরা। এক্ষেত্রে ফ্লয়েড ওয়েব এবং ডেবোরা ডেস্নু, ইয়াসুকের উপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে বলেন,
তার দাস হওয়াটা কেবল অনুমানের ভিত্তিতেই বলা চলে। কিংবা হতে পারে, প্রথম জীবনে সে দাস ছিল। কারণ এক বছরের ব্যবধানে একজন মানুষের পক্ষে সামুরাইয়ের মর্যাদায় উন্নীত হওয়াটা অসম্ভব; উপরন্তু আবার বিদেশী বংশোদ্ভূত। জানামতে, সামুরাইদেরকে একদম কিশোর বয়স থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।
আবার এদিকে লকলে বলেন ভিন্ন কথা। তিনি আফ্রিকান এই সামুরাইয়ের উপর ব্যাপক গবেষণা করে একটা গ্রন্থ রচনা করেছেন, ‘আফ্রিকান সামুরাই: দ্য ট্রু স্টোরি অভ ইয়াসুকে, অ্যা লেজেন্ডারি ব্ল্যাক ওয়ারিয়র ইন ফিউডাল জাপান’ শিরোনামে। তার করা গবেষণা এবং গ্রন্থের গল্পের সঙ্গেই জাপানি নথিপত্র এবং জাপানিদের মৌখিক গল্পগুলোও মিলে যায়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থমাস লকলের গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। এ আলোচনাটিও থমাস লকলের গ্রন্থের উপর নির্ভর করেই লেখা, তবে অন্যান্য গবেষণার থেকেও খানিকটা আলোচনা করা হবে।
সে সময়ের সমগ্র এশিয়ার প্রধান জেসুইট (মিশনারি কাজের জন্য রোমান ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকগণ) ছিলেন অ্যালেসান্দ্রো বা অ্যালেক্সান্ডার ভ্যালিগন্যানো। তিনি তখন ইন্ডিজ পরিদর্শন সফরে ছিলেন। বিগত ছয় বছরে রোম থেকে যাত্রা শুরু করে পর্তুগাল, মোজাম্বিক, ভারত, মালয় এবং ম্যাকাউ ভ্রমণ করেছেন তিনি। তবে তার প্রধান ও চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল জাপান যাত্রা। তিনি আশা করছিলেন, জাপানের হাজার হাজার মানুষকে তিনি খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দিতে পারবেন। সে সময়টাতেই ভ্যালিগন্যানোর চোখে ধরা পড়েন ইয়াসুকে। তিনি ইয়াসুকেকে কিনে নেন। এরপর তার অনুগামী লোকজনের সঙ্গে তাকে খানসামা ও ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে রেখে দেন। অতঃপর ভ্যালিগন্যানো ১৫৭৯ সালে জাপান ভ্রমণ করেন। দেহরক্ষী এবং একইসঙ্গে খানসামা হিসেবে সাথে নেন ইয়াসুকেকেও। আর এখান থেকেই বদলে যায় ইয়াসুকের জীবনগল্প।
ইতিহাসবিদ লরেন্স উইংকলারের মতে, ১৫৮১ সালে ইয়াসুকে জাপানের রাজধানী কিয়োটো ভ্রমণ করেছিলেন। পথিমধ্যে জেসুইটের দলটি সাকাই বন্দরনগরী অতিক্রম করেছিল। সেখানে এই কৃষ্ণাঙ্গকে এক ঝলক দেখার জন্য বেশ বড় জনসমাগম হয়। ইতিহাসবিদরা ইয়াসুকেকে ‘ভীতিকর’ চেহারার অধিকারী বলে বর্ণনা করেছেন। কথিত আছে, ইয়াসুকেকে এক ঝলক দেখতে এত জনসমাগম হয়েছিল যে মানুষের ভারে একটা ভবন ধসে পড়েছিল। আর এ দুর্ঘটনায় জেসুইটের সংযাত্রিকদল মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল।
ব্যাপারটা এমন নয় যে, জাপানিরা এর আগে কখনোই কোনো আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ স্বচক্ষে দেখেনি। জাপানিজদের গড় উচ্চতা অন্যান্য জাতির তুলনায় কম। ঊনিশ শতকেও জাপানের গড় উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ২ ইঞ্চি (১৫৮ সেন্টিমিটার বা ১.৫৭ মিটার)। আর এখানে কথা হচ্ছে সেই ষোড়শ শতাব্দীর, যখন জাপানের গড় উচ্চতা আরো কম ছিল পুষ্টিজনিত কারণে। তাই তাদের দৃষ্টিতে ইয়াসুকেকে দৈত্যাকৃতির বা স্বর্গীয় দূত ভাবাটা অবাক করার মতো কোনো বিষয় ছিল না। এমনকি কথিত আছে, সর্বোচ্চ উচ্চতার দু’জন জাপানি মানুষকে একজনের উপর আরেকজনকে দাঁড় করালে যতটা উচ্চতা হবে, সেটাও হয়তো ইয়াসুকের সমান হবে না।
ইয়াসুকে লম্বায় ছিলেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি (১৮৮ সেন্টিমিটার বা ১.৮৮ মিটার)। বলিষ্ঠ দেহের গড়ন ছিল তার। শরীরের ত্বক ছিল কয়লার মতো কালো। শারীরিক কাঠামো দেখে মনে হতো, দশজন মানুষের গায়ের শক্তি ইয়াসুকের একার গায়েই রয়েছে। জাপানি এক বিশ্বাসমতে, বৌদ্ধকেও কৃষ্ণাঙ্গ ভাবা হয়ে থাকে। তাই অনেক উৎসুক জনতার কাছে ইয়াসুকে স্বর্গীয় এক দূত বলেই গণ্য হয়েছিলেন তখন। একজন সামুরাই তার ডায়েরিতে ইয়াসুকের বর্ণনায় লিখেছিলেন,
লম্বায় তিনি ছিলেন ৬ সাকু ২ সান (৬ ফুট ২ ইঞ্চি বা ১৮৮ সেন্টিমিটার), তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন; আর তার চামড়া চারকোলের মতো কালো, চকচকে আর খসখসেও ছিল।
ইয়াসুকের বুদ্ধিমত্তা দুর্দান্ত আর চৌকস ছিল বলেই জানা যায়। তিনি খুব দ্রুতই যে কোনো কিছু শিখে নিতে পারতেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফাস্ট লার্নার’। আর তাই, অতি অল্প সময়ে তার জাপানি ভাষার দক্ষতা গোটা জাপানিদের মুগ্ধ করেছিল। যেসব জাপানি উৎসুক হয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল বা তার কাছাকাছি গিয়েছিল, তাদের কাছ থেকেই তিনি খুব দ্রুত তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা নিয়ে ফেলেছিলেন।
ইয়াসুকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অনর্গল জাপানি ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। আর তিনি এতটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছিলেন, যেন এ ভাষাই তার মাতৃভাষা। এটিও একটি কারণ, যেজন্য তাকে সে অঞ্চলে ডেমি-গড বা অর্ধ-দেবতা বলে গণ্য করা হয়েছিল। সে সময়ে স্বাভাবিকের বাইরের যেকোনো ঘটনাকেই ঈশ্বর বা দেবতার সঙ্গে তুলনা করা হতো। জানা যায়, এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ তার পূজাও করেছিল। তবে ইয়াসুকেকে এভাবে সম্মান করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তার কালো ত্বক। অনেকেই ইয়াসুকেকে ‘দাইকোকুতেন’ ভেবেছিল। সমৃদ্ধির এ দেবতার সম্মানে মন্দিরে কৃষ্ণবর্ণের মূর্তি রাখা হয়।
রাজধানী কিয়োটা যাবার পর তাকে দেখতে জনসমাগমের পুনরাবৃত্তি হয়। এখানে আগের বারের তুলনায় অনেক বেশি লোক জড়ো হয়। অপেক্ষমাণ জনতার মাঝ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন ইয়াসুকে। এমন বর্ণ, শারীরিক গঠন আর এমন চেহারার মানুষ এর আগে কখনোই দেখেনি জাপানিরা। তাই সেদিন ভিড় যেন উপচে পড়ছিল। উত্তাল জনতার ঢল দেখে ইয়াসুকে জেসুইট গীর্জার ভেতরে আশ্রয় নেন। কিন্তু উন্মত্ত জনতা তাকে এক নজর দেখার জন্যে গীর্জার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেবারও কিছু দর্শক উন্মত্ত জনতার পদতলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
ইয়াসুকে যখন জাপানে এসেছিলেন, সে সময়টায় জাপান ছিল উত্তাল। সমগ্র জাপান এক জঘন্য গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যার শেষ ঘটে ১৬০৩ সালে। সে সময়টাকে যুদ্ধরত রাষ্ট্রের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। তখন ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্য সারা দেশ থেকে ক্ষণে ক্ষণে একেক ব্যক্তির উত্থান দেখেছে জাপান। শেষমেশ ‘দাইমায়ো’-এর মাধ্যমে জাপানে শান্তি ফিরে আসে।
তাদের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী শাসক হিসেবে পদার্পণ করেছিলেন ওডা নোবুনাগা। তিনি ক্রমশ জাপানের সবচেয়ে পরাক্রমশালী সেনাপতি হয়ে উঠেছিলেন। জাপানের ইতিহাসে তিনজন শান্তিস্থাপকের মধ্যে তাকে প্রথম বলে বিবেচনা করা হয়। ইয়াসুকেকে এক নজর দেখার জন্য চারিদিকে যখন দারুণ হল্লাহাটি হচ্ছে, তখন তিনি কাছেই হন্নো-জি মন্দিরে আদালতে এক বিচারকার্যের সভাপতিত্ব করছিলেন। এত কোলাহলে তার বিচারকার্য বিঘ্নিত হচ্ছিল। পরে তিনি জানতে পারেন যে, এক কৃষ্ণাঙ্গের জন্য এত হৈ-হুল্লোড় আর কোলাহল। তখন তিনি লোকটিকে তার দরবারে হাজির করার নির্দেশ দেন।
ইতোমধ্যেই জাপানি ভাষা আর সংস্কৃতিতে নিজেকে যথেষ্ট পারদর্শী করে ফেলেছিলেন ইয়াসুকে। তাই ওডা নোবুনাগার সঙ্গে কথোকপথনে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি তার। ইয়াসুকেকে নিয়ে লেখা লকলের গবেষণা গ্রন্থে আছে, ইয়াসুকের বলা আফ্রিকা এবং ভারতের গল্প নোবুনাগাকে মুগ্ধ করেছিল। একইসাথে জাপানি ভাষায় কথা বলা এক আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গকে দেখা তার জন্য সৌভাগ্যও ছিল বটে।
তাদের দু’জনের কথাবার্তা যতই এগোচ্ছিল, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলেন ওডা নোবুনাগা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে নোবুনাগা ইয়াসুকেকে তার মাথা থেকে কোমর অবধি কাপড় খুলে ফেলতে বলেন। নোবুনাগার বিশ্বাস ছিল, ইয়াসুকে হয় কোনো দেবতা; আর নয়তো কোনো এক অপদেবতা। তাই তিনি ভালোভাবে স্পর্শ করে পরীক্ষা করে দেখলেন ইয়াসুকের গাত্রবর্ণ। তিনি দেখলেন, ইয়াসুকে সত্যিকারের কৃষ্ণাঙ্গ মানব। আর তা বুঝতে পারার পর আনন্দে তিনি এক উৎসবের আয়োজন করে বসলেন। তিনি নিজের ভাতিজাকে আদেশ দিলেন ইয়াসুকেকে মোটা অংকের অর্থ উপহার দিতে। সে উপহার ইয়াসুকেকে তাৎক্ষণিকভাবে জাপানের একজন ধনী বানিয়ে দিয়েছিল।
ফরাসি-আইভরিয়ান লেখক সার্জ ভাইলও ইয়াসুকেকে নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। ইয়াসুকে আর নোবুনাগার প্রথম সাক্ষাতের বিষয়ে তিনি আরেকটু গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার ব্যাখ্যানুসারে, নোবুনাগা আর ইয়াসুকের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে বেশ মিল ছিল। স্বভাবে বেশ খামখেয়ালী নোবুনাগা মার্শাল আর্টসের ব্যাপক ভক্ত ছিলেন এবং নিয়মিত অনুশীলনও করতেন।
ইয়াসুকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জাপানি ভাষা আর সংস্কৃতি আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। তিনি নোবুনাগাকে উতেঞ্জি বা উতেঙ্গি পরিবেশন করে দেখিয়েছিলেন। এটি হচ্ছে সোয়াহিলি ভাষায় রচিত একধরনের আখ্যানমূলক কবিতা, যা বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য পরিবেশন করা হয়। এখানে আবার ইয়াসুকের মোজাম্বিকের নাগরিক হবার প্রসঙ্গটা চলে আসে। কারণ, এ ভাষা দেশটার কিছু কিছু জায়গায় এখনও বিদ্যমান।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নোবুনাগা খানিকটা খামখেয়ালি স্বভাবের ছিলেন। সেইসাথে তিনি শিল্প-সাহিত্যের ভক্ত এবং পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। ক্ল্যাসিকাল জাপানি গীতিনাট্য ‘নোহ’-এর ভীষণ ভক্ত ছিলেন তিনি। আর সে সুবাদেই ইয়াসুকের গল্প আর নাচগানে মুগ্ধ হয়ে, খুব কম সময়ের মধ্যেই তাকে মনে ধরে যায় তার। নোবুনাগার কাছের খুব কম লোকই ছিল, যারা নোবুনাগার সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন; এবং তার মধ্যে ইয়াসুকে ছিলেন অন্যতম। ইয়াসুকেকে তিনি নিজের পরিবার বলেই গণ্য করতেন। ইয়াসুকের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, উচ্চ মানসিক গুণাবলীর প্রশংসা করতেন তিনি এবং এও বিশ্বাস করতেন যে, ইয়াসুকের শরীরে ১০ জন মানুষের শক্তি বিদ্যমান।
এ ঘটনার কিছুদিন পর একদিন নোবুনাগা ভ্যালিগন্যানোকে ডেকে পাঠালেন। তার কাছে ইয়াসুকেকে নিজের সেবায় নিয়োজিত করার আবদার করলেন। ভ্যালিগন্যানো তাতে সম্মতি দিলেন। ইয়াসুকে নোবুনাগার অস্ত্রবাহক হিসেবে নতুন পরিচয় পেলেন। তখনকার সময়ে একজন ওয়ারলর্ড বা সেনাপতির অস্ত্রবাহক হওয়াটা অনেক সম্মান আর মর্যাদার ছিল। তাছাড়া, একজন অস্ত্রবাহক এমন একজন বিশ্বস্ত হওয়া চাই, যার সঙ্গে রাজ্যের অন্তর্গত এবং বহিরাগত বিষয়গুলো সম্পর্কেও আলোচনা করা যায়। আর ইয়াসুকে নিঃসন্দেহে সে বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি করে ফেলেছিলেন।
ইয়াসুকের কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফলস্বরূপ কয়েকমাসের মধ্যেই কিয়োটো প্রদেশের উত্তর-পূর্ব দিকের আজুচি প্রাসাদের একটা বাড়ি তার জন্য বরাদ্দ করা হয়। সে সময় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সামুরাইদের সে প্রাসাদে বাড়ি বরাদ্দ করা হতো। এর পরপরই ইয়াসুকে পদোন্নতি পান এবং নোবুনাগা তাকে একটি কাতানা তরবারি উপহার দেন। কাতানা তরবারি একজন সামুরাই যোদ্ধার প্রতীক; যার জন্য একে ‘সামুরাই তরবারি’ আখ্যাও দেয়া হয়। তাই জাপানে ঐতিহ্যগতভাবে এবং নথিপত্রের হিসেবে, ইয়াসুকেই একমাত্র বিদেশি বংশোদ্ভূত সামুরাই।
ইতিহাসে এমনটাও বর্ণিত আছে যে, ইয়াসুকে নোবুনাগার সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানেও যোগ দিয়েছিলেন। নোবুনাগার চির শত্রু তাকেদা সম্প্রদায়ের অধীনে থাকা মাউন্ট ফুজির উত্তরের অঞ্চলগুলো তারা জয় করেছিল যুদ্ধাভিযান চালিয়ে। অভিযান শেষে ফিরতি পথে ইয়াসুকে জাপানি এক দিনলিপিকারের চোখে পড়ে। তিনি তার ডায়েরিতে ইয়াসুকেকে নিয়ে অনেককিছুই লিপিবদ্ধ করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গবেষণার কাজে বেশ সাহায্য করেছে।
১৫৮২ সালের জুন মাসে নোবুনাগা পশ্চিমের মরি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নোবুনাগার দীর্ঘকালের শত্রু ছিলেন এই মরি সম্প্রদায়। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নোবুনাগার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল। ইয়াসুকেসহ আরো ২৯ জন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে সেনাবাহিনীর সম্মুখে থেকে যুদ্ধে অগ্রসর হন নোবুনাগা। কিয়োটো এসে তারা হন্নো-জি মন্দিরে বিশ্রাম নেয়; যেখানে ১৫ মাস আগে ইয়াসুকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নোবুনাগার।
কিন্তু ২১ শে জুন ভোর হবার খানিক আগেই আকাচি মিতসুহাইডের ১৩ হাজার সৈন্য দ্বারা আক্রমণের শিকার হন নোবুনাগা এবং তার দল। আকেচি মিতসুহাইড সামরিক পদমর্যাদা ভঙ্গ করে শত্রুতে পরিণত হবার আগে নোবুনাগার বিশ্বস্ত একজন জেনারেল ছিল। কিন্তু কেন মিতসুহাইড বিশ্বাসঘাতকের খাতায় নাম লিখিয়েছিল? ইতিহাসে এই ঘটনারও দু’টি দিক বর্ণিত আছে।
প্রথমটি হচ্ছে, নোবুনাগার প্রতিপক্ষের একজন ছিল চোসোকাবে মতিচিকা, যে মিতসুহাইডের খুব কাছের বন্ধু ছিল। ২১ শে জুনের আগে বেশ কয়েকবার তাদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হয়। সেখানে মতিচিকা নোবুনাগার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না গিয়ে আত্মসমর্পণের কথা বলেছিল। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই মিতসুহাইড এ অভিযানে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টাও করেছিল নানানভাবে। সম্ভবত নিজের বন্ধুকে বাঁচাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য হয়েছিল মিতসুহাইড।
আর দ্বিতীয়ত, মিতসুহাইড জানত যে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নোবুনাগা ‘তেংকা ফুবু’, মানে সমগ্র জাপানের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবে। অন্তত নোবুনাগার সেটাই পরিকল্পনা ছিল, যেটা জানত মিতসুহাইড। এমনও হতে পারে, এই লোভই আকাচি মিতসুহাইডকে বিশ্বাসঘাতকের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য করেছিল।
সে যা-ই হোক, মিতসুহাইডের অতর্কিত আক্রমণে মুহূর্তেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন নোবুনাগা আর তার দল। যারা নোবুনাগাকে বাঁচানোর জন্য সামনে দাঁড়িয়েছিল, তারা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। আর যারা বেঁচে ছিল, তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যুদ্ধ যখন মারাত্মক রূপ লাভ করেছে, তখনই মন্দিরে আগুন ধরে যায়। পুরো মন্দির যখন আগুনের শিখার কাছে পরাজিত, তখন নোবুনাগাও নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে সেপ্পুকু (সামুরাইদের শাস্ত্রীয় আত্মহত্যা) পালন করেন। আগুন ধরে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও অবশ্য দ্বিমত রয়েছে।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, মিতসুহাইড নোবুনাগাকে কোণঠাসা করে ফেলতে তিনদিক থেকে সৈন্য পাঠিয়েছিল। ফলে নোবুনাগাকে বাধ্য হয়ে পেছাতে হয়। পেছাতে গিয়ে তিনি একটা কক্ষে নিজেকে বন্দি করে ফেলেন। মিতসুহাইডের উদ্দেশ্যই ছিল মূলত এটা, ইতিহাসবিদরা তা-ই ধারণা করেন। আর সেই কক্ষে নিজের সৈন্যদের আত্মচিৎকার আর নিজের পরাজয় সইতে না পেরে সেপ্পুকু পালন করেন তিনি। তবে আগুন ধরে যাবার ব্যাপারটাতেই বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ আর সাংবাদিক সম্মতি দেন।
কিংবদন্তি অনুসারে, নোবুনাগা তার শেষ ইচ্ছার কথা ইয়াসুকের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ইয়াসুকেকে আদেশ করেন, মৃত্যুর পর তার শিরচ্ছেদ করতে যা যা করার দরকার, তার সবটাই যেন ইয়াসুকে করেন। ইয়াসুকেকে আরো বলা হয়েছিল, নোবুনাগার ছিন্ন মাথা আর রক্তাক্ত তরবারি নিয়ে পালিয়ে তারই পুত্র ওডা নোবুতাডার কাছে যেতে। বাবার মৃত্যুর পর সম্প্রদায়ের নতুন প্রধান হিসেবে ওডা নোবুতাডার স্বীকৃতিটা ইয়াসুকেই দিয়েছিলেন। এটাও অত্যন্ত সম্মানিত একটি কাজ ছিল জাপানি সংস্কৃতিতে।
নোবুতাডার দলে তখন মাত্র ২০০ জন সৈন্য ছিল। চোখের পলকেই সব সৈন্যকে মিতসুহাইডের সৈন্যরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। উপায়ান্তর না দেখে নোবুতাডাও আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। ইয়াসুকেকে বন্দি করে আকেচি মিতসুহাইডের সামনে দাঁড় করানো হয়। আকেচি তাকে ছেড়ে দিলেন এবং জেসুইটে ফিরে যেতে বললেন। তবে আরেক কিংবদন্তি অনুসারে, নোবুনাগার পতন হলে ইয়াসুকেকে বন্দি করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তবে তার নির্বাসনের শাস্তি মওকুফ করা হয়, কারণ তিনি জাপানি নাগরিক ছিলেন না। তাই তাকে কিয়োটেতে জেসুইটের কাছে ফের পাঠানো হয়। সে থেকে ইতিহাসের পাতায় ইয়াসুকে একজন ‘রনিন’-এ পরিণত হন। জাপানিজ সংস্কৃতিতে রনিন হচ্ছে এমন একজন সামুরাই, যার কোনো প্রভু বা গুরু নেই।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে এটিই হচ্ছে ইয়াসুকের সর্বশেষ আর সুনির্দিষ্ট ঘটনা। এ ঘটনার পর আর কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাতেই ইয়াসুকের নাম উচ্চারিত হয়নি। তার মতো দেখতে অনেক পুরুষকেই জাপানে প্রত্যক্ষ করা গেছে পরবর্তীকালে। তবে তারা কেউ আদতে ইয়াসুকে ছিলেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ইয়াসুকের শেষ পরিণতি নিয়ে কোনো কিছুই লিপিবদ্ধ নেই কোথাও। তবে তার জাপানে এসে সামুরাই হবার ঘটনার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে বেশ কিছু, আর সেজন্যই তার অবদান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়।
তবে বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে অনেক কাহিনীই হারিয়ে গেছে। ইয়াসুকে যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলেন, অতীতের ভুবনে। কিন্তু আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে ইয়াসুকের কিংবদন্তি নতুন করে জাগ্রত হয়েছে। কমিকস বই থেকে শুরু করে কম্পিউটারের গেমসে ইয়াসুকের গল্প নতুন করে পূর্ণতা পেয়েছে। তাকে নিয়ে রচিত সাহিত্যে অমরত্ব পেয়েছেন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ইয়াসুকে।
বিদেশী বংশোদ্ভূত প্রথম এই সামুরাইকে নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে অনেক প্রামাণ্যচিত্র আর ক্ষুদে সিনেমা। অনেক থিয়েটারে তাকে নিয়ে মঞ্চ নাটকও পরিচালিত হয়েছে। জাপানিজ মাঙ্গা আর অ্যানিমেতেও ইয়াসুকের গল্প ঠাঁই করে নিয়েছে। জাপানিজ মাঙ্গা ‘আফ্রো-সামুরাই’ তো পুরস্কারও পেয়েছে। ২০১৭ সালে হলিউডের বিখ্যাত স্টুডিও লায়ন্সগেইট এই কৃষ্ণাঙ্গ সামুরাইকে নিয়ে সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেয়।
বিনোদন জগতের প্রসিদ্ধ ম্যাগাজিন ভ্যারাইটি’র বরাতে জানা গিয়েছিল, ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ খ্যাত চ্যাডউইক বোসম্যান এই মুভির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার কথা। কিন্তু ২০২০ সালে হারাতে হলো তাকেও। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকসের থিমটাও ইয়াসুকের স্মরণে করা হয়েছিল। মধ্যযুগের এই আফ্রিকান সামুরাই যেমন আচমকাই হারিয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি আচমকাই আবার ফিরে এলেন যেন।
কুরুসো ইয়োসিয়ো তাকে নিয়ে ‘কুরু-সুকে’ (জাপানিজ ভাষায় কুরু অর্থ কৃষ্ণাঙ্গ) নামে একটি শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইটি সেরা শিশুতোষ সাহিত্য পুরস্কারও পায়। তবে এ বইতে শেষটা শিশুদের কথা চিন্তা করে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নোবুনাগার সেপ্পুকু পালনের পর কুরু-সুকেকে (ইয়াসুকে) একটা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে তিনি আফ্রিকায় থাকা তার বাবা-মাকে স্বপ্নে দেখেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ইয়াসুকে, আফ্রিকান এই সামুরাইকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় মনিব নোবুনাগার প্রতি একাগ্র আনুগত্যের জন্য। ওয়ারলর্ড বা সেনাপতির জন্য নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। আফ্রিকান কোনো এক অঞ্চলে জন্ম নেয়া এক দরিদ্র ঘরের সন্তান; বালক বয়সেই যে মানব পাচার আর দাস ব্যবসার শিকার হয়েছিল- সেই বালকটাই, সেই আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গই কিংবদন্তি হয়ে উঠল, সামুরাইরূপে।