বর্তমান কর্মব্যস্ত এই জগত সংসারে আমরা অর্থের পেছনে ছুটছি প্রতিটি মূহুর্ত। ব্যস্ততায় ঘিরে থাকা সপ্তাহের সময়গুলোতে মনোযোগটা যেন অন্য দিকে সরানোর ফুরসতই মেলে না। সময় বেরোলেই চোখ আটকে যায় ছোট পর্দায় কখনো কিংবা বড় পর্দায়, হয়ত লেনদেনের গোলক ধাঁধায় আর চিত্তবিনোদন, সে তো যোজন যোজন দূরে। বলা যায়, জীবন আর আগের মতো নেই, টেকনোলজির অব্যর্থ নিশানা আর আমাদের হাতের স্মার্টফোনের ডিসপ্লেতে নুয়ে পড়া ঘাড় যেন জানান দেয়, আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। কে জানে? হয়তবা নিশ্চুপ সমর্থন দিয়ে আমরাও আস্তে আস্তে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন।
একটি দিনে আমরা অনেক ব্যস্ত সময় পার করি এবং সেটা কাজ করেই হোক আর না করেই হোক। কিন্তু সত্য এই যে- একটি ব্যস্তময় কাজের দিনে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এক ঘণ্টা অন্য কিছুতে ব্যয় করা আপনাকে বহুগুণে সৃজনশীল এবং সফল করে তুলতে বাধ্য। প্রবল কাজের চাপ থাকার পরেও অনেক গুণী উদ্যোক্তা , শিল্পী এবং রাজনীতিবিদের এই গুণটি ছিল।
উদাহরণ হিসেবে অনেকের কথাই বলা যায়, স্বয়ং মার্ক জাকারবার্গের কথাই বলি, খোদ তিনিই আমাদের হাতে ফেসবুক নামক একটি অতীন্দ্রিয় বস্তু ধরিয়ে নিজেই কিন্তু দিনের ৮টি ঘণ্টা বই পড়ার পিছনে কাটিয়ে দেন। একদিকে উনি জ্ঞানসমৃদ্ধ হচ্ছেন, বড় বড় জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিচ্ছেন, অন্যদিকে আমরা এক চিমটি শেয়ার করছি এদিক ওদিক। আর ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’ নামক প্রবাদটা নিজের গায়েই জড়িয়ে নিচ্ছি একটু একটু করে।
এদিকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথাও আনা যেতে পারে। তিনি সাপ্তাহিক কাজের দিনগুলোতেও এক ঘন্টা করে সময় বের করে নতুন কিছু শিখতেন, লিখতেন, পড়তেন, লক্ষ্য স্থির করতেন । তিনি ছাড়াও অন্যান্য সফলরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে শিখেছেন নতুন কিছু, জীবনভর জ্ঞানের সীমানা ও দক্ষতা বাড়িয়ে দক্ষ এবং সৃজনশীল নেতায় পরিণত হয়েছেন।
চব্বিশটি ঘন্টা বা এক দিনে অনেক কিছুই করা যায়, যদি সেখানে আপনার পূর্ণ সদিচ্ছা থাকে। নাহ, আমি এখানে চব্বিশ ঘন্টার কথা বলব না, আমি বলব এক সপ্তাহ। একটি সপ্তাহকে নিজের করে সাজিয়ে নিন, জায়গাটাকে নিজের জন্য নিজের যুদ্ধক্ষেত্র ঘোষণা করুন। আপনাকে কাজগুলো নিজের জন্য করতে হবে এবং আপনি করবেন।
এখানে সফলদের অনুসরণ করা পাঁচটি দৈনন্দিন অভ্যাসের কথা বলা হলো যেগুলো নিমিষেই পাঁচ ঘন্টায় করা সম্ভব। এগুলো মেনে নিজেকে আপনি সফলতার শিখরে যেতে না পারলেও নিজের কাছে নিজে একজন সফল হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন।
নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য সময় বের করুন
আধুনিকতা ছোঁয়া কিংবা নিজেকে রিচার্জ করার একটা ভালো ক্ষেত্র বলা যায় কফি হাউজ, যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কফি হাউজ তুলনামূলকভাবে অর্থের বদহজম হিসেবে ধরা হয়। অনেকের ভরসা টংয়ের দোকানগুলোতেই আবদ্ধ থাকে। তবে ব্যস্ততার একটু ফাঁকে কফি হাউজ কিংবা নিরিবিলে টংয়ের দোকানে চা খেতে খেতে কিছু সময় কাটানো আমাদের কাছে কষ্টের কিছু মনে হওয়ার কথা না।
ইতিহাস ঘাটলেও দেখা যাবে কফি হাউজে বসেই শ্রেষ্ঠ ভাবনাগুলোর জন্ম হয়েছে, আবার কফি হাউজে বসলেই যে যুগান্তকারী চিন্তার উদ্ভব হবে সেটাও কিন্তু নয়। প্রতিদিন নিজের জন্য এক ঘন্টা ভেবে বা নিজের চাওয়া-পাওয়া বা নিজের শখের কথা ভাবতে ভাবতেই হয়ত পেয়ে যেতে পারেন আপনার কাঙ্খিত লক্ষ্য। মোটকথা যেখানেই বসুন না কেনো, ঐ বসাতে যেন নিজের সাথে নিজের সংযোগ ঘটে, নতুবা সময়টা অনর্থক ব্যয় হবে।
আগ্রহী হয়ে উঠুন
অপরিসীম কৌতূহল একজন অতি সফল উদ্যোক্তা কিংবা একজন সফল ব্যক্তির অন্যতম হাতিয়ার বলা চলে। এটা অবশ্য তাকে বাকি সবার থেকে খানিকটা আলাদা করে দেয়। এক্ষেত্রে তিনি কখনোই কেবলমাত্র একটি বিষয় ভালোভাবে জেনে তৃপ্ত থাকেন না। তিনি সবসময় নিজের মধ্যে বৈচিত্র্য এনে সকল মূল্যবান সু্যোগের সঠিক ব্যবহার করে থাকেন।
হ্যাঁ, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সাবজেক্টের আধিক্য দেখে অনেকে আবার তার জানার আগ্রহের মাত্রাও তুলনামূলক হারে কমিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেন না। তবে এখানে ভালো লাগাটা প্রাধান্য পাবে আপনার একটি বা একাধিক বিষয়ের উপর। তাই সময় নষ্ট না করে নিজের পছন্দের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন
একজন উদ্যোক্তার আরেকটি বড় গুণ হলো কোনো বিষয় নিয়ে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে চিন্তা করা। অবশ্য কাজের চাপে হয়ত এ চিন্তা বা গবেষণার ধারা বেশিক্ষণ সময় পর্যন্ত থাকে না। তবে মাথায় ব্যবসার যে ধারণাটিই আসুক না কেন, সেটি নিয়ে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভাবুন, এর সম্ভাব্যতা যাচাই করুন। কারণ ব্যবসা আপনার, মূলধনও আপনার, হঠাৎ ভুল সিদ্ধান্তে মূলধনও কখন অনিশ্চিত ব্যয়ে চলে যাবে তা আপনি শত চেষ্টা করেও ফেরাতে পারবেন না, বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য।
এজন্য আইডিয়াকে লালন পালন করুন, নিজের সন্তানের মতো করে যত্ন করুন এবং প্রতিদিন সেটাকে নিয়ে সময় করে ভাবুন। কে জানে? হয়ত এভাবেই পেয়ে যেতে পারেন আপনার কাঙ্খিত ব্যবসার যুগান্তকারী ফর্মুলা।
পড়ুন, পড়ুন, পড়ুন
আসলেই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। নিজের মতো করে মাথা উচু করে বাঁচার জন্য হলেও আপনাকে পড়তেই হবে। বই কিনে মানুষ যেমন দেউলিয়া হয় না, বই পড়ার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আগেই বলেছি বিষয়গুলো হবে একান্তই নিজের ভালো লাগার। দেখুন বারাক ওবামা, বিল গেটস, অপরাহ উইনফ্রে, মার্ক জাকারবার্গ, ওয়ারেন বাফেটরা প্রচুর পড়তেন এবং এখনো তাঁদের সেই পড়াশুনার ধারা অব্যাহত রয়েছে। এঁদের জীবনী পড়লে আপনি জানতে পারবেন নিয়মিত পাঠ্যাভ্যাস কিভাবে তাদেরকে আরও পরিণত করেছে এবং জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়া এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। সেক্ষেত্রে পারলে সপ্তাহে ৫ ঘন্টা আপনি বই পড়ার পিছনে সময় ব্যয় করতে পারবেন।
শেখার ধারা অব্যাহত রাখুন
নিজেকে আর দশটা মানুষের মতো করে দেখতে না চাইলে প্রতিদিন নতুন কিছু শিখুন। শেখার ধারাটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে একদিকে যেমন নিজের অভিজ্ঞতা বাড়বে, তেমনি জীবন চলার পথে আরেকটু এগিয়ে যাবেন প্রতিনিয়ত। বলা যায় নিয়মিত কিছু একটা করার অভ্যাস আমাদের আইডিয়া কিংবা দক্ষতাকে নিশ্চল করে দেয়, নতুন কিছু বের হতে চায় না আমাদের ভিতর থেকে। সে জায়গায় আপনি যখন ধীরে ধীরে নিজেকে নতুন কিছু শেখাবেন, আপনি ততই নিজেকে নতুনভাবে আবিস্কার করতে সক্ষম হবেন। দিনের কিছু সময়ে কিংবা সপ্তাহের রুটিনে বেঁধে দেয়া কিছু সময়ে আপনি তা চালিয়ে নিতে পারেন।
সবশেষে একটাই আহ্বান, শুধু দরকার আপনার প্রাত্যহিক একঘেয়ে জীবন থেকে মাত্র ৫টি ঘন্টা। যে পাঁচটি ঘন্টা আপনাকে আপনার কাছে নতুনভাবে প্রকাশ করবে, তুলে ধরবে আপনার বিশালত্ব, চিনিয়ে দিবে আপনার আপন সত্তাকে। আর সেই পথ ধরেই আপনার জীবনকে করে তুলবে আরও প্রাণবন্ত, মুখর ও ক্লান্তিহীন।
তথ্যসূত্রঃ
১) medium.com/the-mission/how-to-use-the-5-hour-rule-to-radically-improve-your-intelligence-and-success-c3343b0ef232#.gq6ejfg5e
২) medium.com/the-mission/10-critical-skills-you-ll-need-to-succeed-at-work-in-2020-7583c52b2971#.z6y30j3r2