প্রতিটি মানুষ সৃষ্টিগতভাবে অনন্য। প্রতিটি মানুষেরই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা একজন হিসেবে পরিচিত করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কল্যাণে আমরা একজন মানুষকে সাতশ কোটি মানুষের ভীড়ে শনাক্ত করতে পারি। আপনারও এই অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে যা থেকে আপনার পরিচিতজনেরা আপনাকে চিনতে পারেন । নিশ্চিত হতে পারেন যে, “এটাই আপনি”!
কী সেই বৈশিষ্ট্যগুলো? আজ চলুন জানা যাক সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর কথাই।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট
আপনি যদি অপরাধ কাহিনীর ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই জানেন যে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেখে অপরাধী শনাক্ত করা হয়। মানুষটা যে আপনিই, অন্য কেউ না তা নির্ধারণ করার বহুল ব্যবহৃত এবং স্বীকৃত পন্থা হচ্ছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিরীক্ষণ। ফিঙ্গারপ্রিন্ট হচ্ছে আপনার আঙুলের ডগায় থাকা বিশেষ নকশা যা একেবারেই অনন্য।
আপনার বাবা-মা, এমনকি আপনার অভিন্ন যমজ (Identical Twin) ভাই বা বোনের সাথেও আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলবে না। আপনি যখন আপনার মায়ের গর্ভে ছিলেন তখনই ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরী হয়েছে। ভ্রুণের বিকাশের সময় শরীরের বাইরের আবরণী বা চামড়া তৈরী হয়। আস্তে আস্তে চামড়া যখন পরিণত হতে শুরু করে এবং মাতৃগর্ভের অন্যান্য উপাদানের সংস্পর্শে আসে তখন ভ্রুণের হাতের আঙুলের ডগায় কিছু ভাঁজ সৃষ্টি হয়। আপনার মায়ের গর্ভের অ্যামনিয়টিক ফ্লুইড, আপনি গর্ভে থাকার সময় কতটা নড়াচড়া করেছেন, কেমন অবস্থায় ছিলেন এই বিষয়গুলোর নির্ভর করে ভাঁজ বা দাগগুলো কেমন আকৃতির হবে। গর্ভে থাকার ছয় মাসের মাথায় ফিঙ্গারপ্রিন্টের নকশা পুরোপুরি তৈরী হয়ে যায়। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের বিশেষ একটি জিনে মিউটেশনের কারণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেন। ‘অ্যাডারমেটোগ্লাইফিয়া’ নামের এই রোগকে ‘Immigration Delay Disease‘ ও বলা হয়। কারণ এক দেশে থেকে আরেক দেশে ভ্রমণের সময় ফিঙ্গারপ্রিন্ট না থাকায় ইমিগ্রেশনে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয় তাদেরকে।
আইরিস
“চোখ যে মনের কথা বলে।” পাঠক, আপনার চোখ শুধু আপনার মনের আয়না হয়ে আপনার মনের ভাবকেই প্রকাশ করে না, আপনার আত্মপরিচয়ও বহন করে। আপনার চোখের আইরিস আপনার চোখকে বাহ্যিক দিক থেকে অনন্যতা দেয়। আইরিস হচ্ছে চোখের সামনের অংশে থাকা মাংসপেশী নির্মিত একটি রঙিন পাতলা পর্দা।
একেকজন মানুষের আইরিসের রঙ একেকরকম হয়। কারো নীল, কারো কালো, কারো সবুজ তো কারো বাদামী। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, আইরিসের নিজস্ব কিছু নকশা আছে। আপনার আইরিসের রঙ ও নকশা অন্য কারো মতো হবে না। আইরিসের রঙ বা নকশা কেমন হবে তা নির্ভর করে আমাদের ডিএনএ-তে সঞ্চিত তথ্যের উপরে। আইরিসের গঠন থেকেও মানুষকে চিনতে পারা যায় ।
কান
আপনার কানের বাইরের অংশটিতে হাত দিয়ে দেখুন। অনুভব করতে পারবেন কানে বিচিত্র কিছু খাঁজ রয়েছে। হয়তো কারো কান একটু বেশি বড়, কারো ছোট। আপনার কানের আকৃতি ও ভাঁজগুলো অন্য সকল মানুষের চেয়ে আলাদা।
কানের এই বিশেষত্বকে ভিন্নভাবে কাজে লাগিয়েছেন একদল ইংরেজ গবেষক। তারা তাদের গবেষণায় কানের নকশা থেকে কোনো মানুষের পরিচয় নির্ণয় করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলাফলটা সত্যিই চমকপ্রদ ছিল। ২৫০ জন মানুষের মাঝখান থেকে একজনকে তার কানের নকশা দিয়ে ৯৯.৬ শতাংশ সফল হয়েছেন তারা। এই ফলাফলে অণুপ্রাণিত হয়ে অনেক প্রযুক্তিনির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্মার্টফোনকে আনলক করতে কানের নকশাকে ব্যবহার করতে চাইছেন! হয়তো ভবিষ্যতে এমন স্মার্টফোনও আমরা দেখতে পাবো যা আনলক করতে হচ্ছে হাতের বদলে কান দিয়ে!
জিহ্বা
ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতোই আমাদের জিহ্বারও নিজস্ব গঠনবিন্যাস রয়েছে। আয়নায় আপনার জিহ্বাটি দেখুন। দেখতে পাবেন জিহ্বায় অনেক ভাঁজ, খাঁজ রয়েছে। একে বলা হয় Tongue Print। একজন মানুষের সাথে অন্য আরেকজন মানুষের জিহ্বার প্রিন্টের সাদৃশ্য নেই।
শুধু গঠনই নয়, আকৃতিও ব্যক্তিভেদে জিহ্বা বিভিন্ন হয়। কারো লম্বা জিহ্বা থাকে, কারো খাটো। জিহ্বায় প্যাপিলা নামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গঠন আছে। এগুলোর অভ্যন্তরে থাকে টেস্ট বাড যা আপনাকে বলে দেয় আপনি যে খাবারটি খাচ্ছেন তা সুস্বাদু নাকি বিস্বাদ! তো একেক মানুষের জিহ্বার প্যাপিলা একেকভাবে সজ্জিত থাকে। এটা অবশ্য খালি চোখে দেখা যায় না, মাইক্রোস্কোপ লাগে। জিহ্বা মুখগহ্বরের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে। তাই জিহ্বার নকশা সচরাচর পরিবর্তন হয় না। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিভিন্ন কারণে বদলে যায় বা থাকেই না। সেই তুলনায় জিহ্বার নকশায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব কম। কিছু চীনা গবেষক জিহ্বার এই স্বাতন্ত্র্যের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। তারা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো ব্যক্তির জিহ্বার প্রিন্টের থ্রিডি ইমেজ সংরক্ষণ করার কথা ভাবছেন। আশা করা যায়, এটিও সামনের দিনগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হবে।
দাঁত
আপনার বন্ধুর আর আপনার দাঁত একরকম না। আপনার যমজ ভাই বা বোনের দাঁতও আপনার মতো না। এটা দেখেই বোঝা যায়।
দাঁত কেমন হবে তা কিছুটা নির্ভর করে আপনার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ডিএনএর উপর, কিছুটা নির্ভর করে আপনার অভ্যাসের উপর। আপনি কীভাবে খাবার চিবোচ্ছেন, রেগে গেলে কীভাবে দাঁত কিড়মিড় করছেন বা কতটা যত্ন নিচ্ছেন এই বিষয়গুলো আপনার দাঁতের অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে। ফরেনসিক মেডিসিনে ব্যক্তির দাঁতের রেকর্ড রাখা হয়, যা থেকে সেই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়।
রেটিনা
আবারও চোখ! এবার আমাদের মনের জানালার সবচেয়ে পেছনের অংশটি কতটা এবং কীভাবে ‘বিশেষ’ সেটা বলবো।
রেটিনা চোখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের দেখা বস্তুটি যে আলো প্রতিফলিত হয়ে রেটিনায় এসে পড়ে। পরে এই সিগন্যাল মস্তিষ্কে গেলে আমরা দেখতে পাই। রেটিনায় শিরা-উপশিরা, ধমনী বা রক্তনালীগুলো বিশেষভাবে সাজানো থাকে। এই সজ্জা সব মানুষের আলাদা হয়। এই বিশেষত্বের জন্য মানুষকে শনাক্ত করতে রেটিনা ব্যবহার করা হয়।
কন্ঠস্বর
কন্ঠস্বর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য যার সহায়তায় হাজার হাজার মানুষের থেকে আপনাকে আলাদা করা যায়। কেউ হয়ত জোরে কথা বলে, কেউ আস্তে। কারো স্বরের কম্পাঙ্ক বেশি, কারো কম। কারো গলা শুনলে মনে হয় মিষ্টিসুরের কোনো গান শুনছেন, কারো গলা শুনলে মনে হয় গুড়গুড় করে মেঘ গর্জন করছে। স্বরের কম্পাঙ্ক বা তীব্রতার ছাড়াও আরো কিছু ব্যাপার কন্ঠকে অনন্যতা প্রদান করে।
যেমন- ব্যক্তি কোন টানে কথা বলছে, নাকি স্বরে বলছে, নাকি স্পষ্ট করে বলছে বা কতটা দৃঢ়ভাবে বলছে প্রভৃতি। আপনার গলা কতটা লম্বা, স্বরযন্ত্রের দৈর্ঘ্য কতটুকু- এই বিষয়গুলো আপনার কন্ঠস্বর কেমন হবে তা নির্ধারণ করে। আপনি কীভাবে কথা বলবেন সেটা নির্ভর করে কিছুটা আপনার ডিএনএ’র উপর, কিছুটা আপনার শিখনের উপর। এই সবগুলো ব্যাপার একত্রে আপনার কন্ঠস্বরকে অন্যদের চেয়ে ভিন্ন করে।
হাঁটার ভঙ্গি
আপনার চলনভঙ্গি আপনার পরিচয় প্রকাশ করে। আপনার পা দুটোকে আপনি হাঁটার সময় যেভাবে ব্যবহার করছেন তা থেকে তৈরী হয় আপনার চলার ভঙ্গি।
আপনি ঝুঁকে হাঁটেন নাকি পা টেনে হাঁটেন নাকি, দ্রুত হাঁটেন নাকি আস্তে হাঁটেন? যেভাবেই হাঁটেন না কেন আপনার হাঁটার ভঙ্গি দেখে দূর থেকে আপনাকে চেনা সম্ভব। গোয়েন্দা কাহিনীতে নিশ্চয়ই দেখেছেন হাঁটার ভঙ্গি বদলে ফেললে মানুষকে আর চেনা যায় না। ক্যামেরা ফুটেজ থেকে কোনো মানুষকে শনাক্ত করতে হাঁটার ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়।
ফিচার ইমেজ- kevinaugust.com