ঝড়কে আমি করব মিতে,
ডরব না তার ভ্রুকুটিতে।
ঝড়কে মিতে করতে বলছি না, বলছি ভয়কে মিতে করার কথা। আমরা যখন কোনো কারণে বা কোনো কিছুতে ভয় পাই, তখন সেই বিষয়গুলো আমাদের কেন যেন পেছনে আটকে রাখতে চায়। ভয় কখন বা কীভাবে আমাদের পেয়ে বসবে সেটা আমরা জানি না। সেই ভয় অতিক্রম করা কিন্তু সহজসাধ্য নয়।
যেমন ধরুন, আপনি পড়াশোনায় বেশ সফল; বরাবর ভাল ফলাফল করেই আসছেন এযাবত। কিন্তু হঠাৎ করে আপনার মনে একটা আতংক কাজ করছে, যদি এবার আপনি ভাল না করতে পারেন? যদি এতদিনের সফলতা একমুহুর্তে উবে যায়? ভয় বা আতংক সবচেয়ে বড় মূলক, যা আমাদের পেছন থেকে টেনে রাখে, সামনে এগোতে দেয় না।
আমাদের জীবনে অনেক রকম মানসিক বাধাবিপত্তি আছে। ভয় হলো সেসবের মাঝে শীর্ষস্থানীয়, আর এটা আমাদের যেভাবে পেছনে টানে, সেই টান ছিড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আজ আমরা আলাপ করব এই অহেতুক, অযাচিত আতংক কীভাবে আমরা দূর করা যায়, কীভাবে ভয়ের ভ্রুকুটি অগাহ্য করে করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই ব্যাপারে।
ভয় পেলে আমরা কী করি?
যখন হঠাৎ করে আমরা ভই পাই, আমাদের হাত-পা শির শির করে, মাথা কাজ করে না, মাথা ঘুরে যায়, সব কিছু কেমন যেন অন্ধকার লাগে। জ্বর আসে, অনেকে তো গো গো করে অজ্ঞানও হয়ে যায়! আমরা সেই সময়ে বুঝে উঠতে পারি না কী করা উচিত, কার কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত। যে জিনিস ঘটবে না, সেটা ভেবে অজানা আতংকে সারা হয়ে উঠি। আতংকে অনেক সময় এমন কিছু ভুল করে বসি, যা ব্যর্থ হবার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। ভয়ের মুখোমুখি না হয়ে কী হবে, সেই ভেবে কাজ করলে ভয় তো কাটবেই না, বরং আরো বেশি জেঁকে বসবে। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি তার কিছু উপায় এখন তুলে ধরছি। হয়তো এটা পড়লেই ভয় পুরোপুরি কেটে যাবে না, তবে ধীরে ধীরে সেই ভয়কে জয় করার রাস্তা আপনি ঠিকই খুঁজে পাবেন।
বিরতি নিন
টানা একই ধরনের কাজ বা একই কাজ বার বার করতে গেলে কিছুটা বিরক্তি এসে ভর করে। যদি কোনো ধরনের ভয় বা উদ্বিগ্নতা আপনার মাঝে ভর করে, তাহলে প্রতিদিনের একঘেয়ে কাজ থেকে বিরতি নিন। চা বা কফি ব্রেক নিতে পারেন। হাতে সময় থাকলে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারেন। অফিস বা পড়াশোনা থেকে একটু ছুটি নিন। যা নিয়ে আপনার ভয় বেশি কাজ করে, কিছু সময়ের জন্য সেই ভয়ের আশপাশ দিয়ে চলা বন্ধ করে দিন। দেখবেন- কিছু সময় পর আপনার বেশ ফুরফুরে লাগবে, আপনি নতুন করে সব শুরু করতে পারবেন। এ ধরনের বিরতি মাঝে মাঝেই নিলে আপনার মনের ভয় আস্তে আস্তে কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন
যখন ভয় আপনার সব ইন্দ্রিয়কে ঘিরে ধরছে, তখন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করুন। আস্তে আস্তে, কিন্তু বেশ বড় করেই শ্বাস নিন। এমন এক জায়গায় বসুন, যেখানে প্রচুর অক্সিজেন আছে। আস্তে আস্তে সময় নিয়ে শ্বাস নিন। কিছু সময় শ্বাস ধরে রেখে ধীরে ধীরে ছাড়ুন। দেখবেন নিজেকে বেশ হালকা লাগবে। শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বেশি হলে নিজের ভেতরের অস্বস্তি অনেকাংশে কমে যায়। শরীর এবং মন- দুটোই ভালো থাকার জন্য নিঃশ্বাসের ব্যায়াম বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে অন্তরের ভীতি দূর করতে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে যোগব্যায়াম বেশ ভালো কাজ করে।
ভয়ের মুখোমুখি হোন
ধরুন, আপনার উচ্চতাভীতি রয়েছে। উঁচু বিল্ডিং কিংবা ফ্লাইওভারে উঠে নিচে তাকালে আপনার পৃথিবী দুলে ওঠে। মনে হয়, এখনই পড়ে যাবেন। এখন যদি আপনি প্রতিদিন একটু একটু করে উপরে ওঠেন, আর নিচের দিকে দেখার চেষ্টা করেন, আপনার ভয় কেটে যাবে আস্তে আস্তে। অনেক ক্ষেত্রে এই ফোবিয়া দূর করতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য প্রয়োজন পড়ে।
সেরা হবার চেষ্টা করবেন না
আমাদের ভয় পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ কি জানেন? আমি যদি না পারি, যদি হেরে যাই- এমনটা আমরা কেন ভাবি জানেন? কারণ, আমরা সেরা হতে চাই। আমরা চাই- আমাদের যেন কেউ হারাতে না পারে। এটা আমাদের জীবনের অন্যতম বড় ভুল। কারণ, আমরা কেউ সেরা না, কেউ অলরাউন্ডার হতেও পারব না। আমরা যা না, সেটা হতে চাওয়ার চেষ্টা করা উচিত না। তাই, আমরা যা, সেটাই আমাদের হওয়া উচিত। যখন আমরা আমাদের আশার অতিরিক্ত কিছু হতে চাইব, পরাজয়ের ভয়, ব্যর্থতার ভয় আমাদের মাঝে জেঁকে বসবে।
নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করুন
যে বিষয়গুলো আপনাকে ভালো রাখে, সেসব বিষয়ের কথা ভাবুন, সেই সময়ের কথা ভাবুন। নিজের যেসব কাজ ভালো লাগে, সেই কাজগুলো করুন। বই পড়তে ভালো লাগলে, একঘেয়ে কাজ থেকে নিজেকে একটু দূরে রেখে কিছু সময়ের জন্য বই পড়ুন। বাগান করতে ভালো লাগলে সেটাই করুন। এক কাপ কফির সাথে প্রতিদিন বিকেলে বারান্দায় সময় কাটান। ছাদে একটু হেঁটে আসুন। সকালবেলা ওঠার চেষ্টা করুন। যে সময়ে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন, সেই সময়ের কথা মনে করুন।
অর্থাৎ, নিজের সাথে সময় কাটান। নিজের প্রিয় জিনিস নিজেকেই উপহার দিন। যেমন- আপনার ঘড়ির শখ থাকলে একটা সুন্দর ঘড়ি কিনুন। স্ব স্ব ধর্মীয় আচার পালন করুন। এই কাজগুলো ভয় কাটাতে বেশ সাহায্য করে।
ভয় নিয়ে কথা বলুন
আমাদের অনেক বড় একটা ভুল হলো- যে বিষয় নিয়ে আমাদের ভয়, সেই বিষয়ই আমরা লুকিয়ে রাখতে চাই। “লোকে কী বলবে” ভেবে আমরা সেই কথাগুলো নিজেদের মধ্যে চেপে রাখি। এই চেপে রাখা ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খায়। ভয়ের বেশ বড়সড় এক দেয়াল আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকে, যা ভেদ করে আমরা নিজেরাই বের হতে পারি না।
বন্ধু, পরিবার, প্রয়োজনবোধে ডাক্তারের সাথে কথা বলা দরকার হতে পারে এক্ষেত্রে। কথা শেয়ার করলে আমাদের আশেপাশের ভয়ের দেয়াল আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে, ভয়ের মাত্রা একটু বেশি হলেও ওষুধ বা থেরাপির দরকার হতে পারে।
যারা ভয়ের রাজ্যে ঘুরপাক খান, তাদেরকে এই বিষয়গুলো সামনে যেতে দেয় না। বার বার পেছনে টেনে রাখে। আমাদের জীবনে যেমন সবকিছু পারফেক্ট না, তেমনই সবকিছুকে ভয় গ্রাস করবে তা তো হতে পারে না। যে ভয়ই আসুক না কেন, পেছন ফিরে না দেখে তার মুখোমুখি হতে হবে। পরীক্ষায় ফেল করলে কী হবে এটা ভেবে পরীক্ষা না দেয়ার বদলে ভাবতে হবে, আমার সাধ্য অনুযায়ী পরীক্ষায় উত্তর দেব। যা ফলাফল আসবে, তা-ই মেনে নেব। এই মনোভাব প্রতিটি ভয়ের বিষয়ের ক্ষেত্রে ভাবলে দেখা যাবে, আস্তে আস্তে ভয় কেটে যাবে। ভয় খুব বেশি গ্রাস করলে, আর কিছু না পারলে অন্তত কাছের কারো সাথে কথাগুলো শেয়ার করবেন।
আমাদের পরামর্শ হয়তো আপনার ভয় দূর করতে পারবে না, কিন্তু নিজের ভয় নিজে কীভাবে দূর করবেন, সেই বিষয়ে একটা পথ দেখাতে পারে। দেখুন তো চেষ্টা করে, ভয়কে মিতে করতে পারেন কিনা!