আধুনিক পৃথিবীর কর্মব্যস্ত মানুষ দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে কাটায়। তবুও দিনশেষে ঘরে মানুষকে ফিরতেই হয়। কেবলমাত্র নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজেই যে মানুষ ঘরে ফিরে আসে তা না। ব্যস্ততা যতই হোক না কেন, দিনশেষে ঘরই মানুষের পরম শান্তির আশ্রয় হয়। ব্যস্ত কর্মদিবসের পর কেবল ঘরে ফিরেই মানুষের ক্লান্ত মন পায় আরাম ও প্রশান্তি। স্বাভাবিকভাবে যখন নিজ নীড়ের এত প্রভাব মানুষের ওপর, তখন মন ভালো রাখতে নিজের নীড়কে আরেকটু সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা তো যায়ই।
পরিচ্ছন্ন ও গোছানো ঘরের আছে অনেক উপকারিতা। তার মধ্যে মানসিক উপকারি দিকগুলোই বেশি। গোছানো ঘর মানসিক চাপ কমিয়ে দেয় অনেকখানি। এর আরেকটা কারণ হচ্ছে, এক্ষেত্রে বাসিন্দা তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহজে এবং তাড়াতাড়ি খুঁজে পায়। তাই সময় বাঁচে, কষ্ট কমে, সাথে কমে ব্যস্ত জীবনে অতিরিক্ত কাজের চাপও। তাছাড়া গোছানো, পরিচ্ছন্ন ঘর আপনার দুশ্চিন্তা ও অবসাদ কাটাতেও অনেকটা সাহায্য করবে। এর ফলে আপনার বিশ্রামের সময়টা আরো সুন্দর, চিন্তামুক্ত ও ফলদায়ক হয়ে উঠবে। পরিচ্ছন্ন ঘর আপনার ঘুমকে আরো গভীর করতে সাহায্য করবে, আপনাকে করে তুলবে আরো সতেজ ও আত্মবিশ্বাসী। এছাড়া আবাসস্থল পরিচ্ছন্ন ও গোছানো হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতাগুলোর একটি হলো এটি আপনাকে আরো বেশি সৃজনশীল ও মনোযোগী হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
এত প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ব্যস্ত জীবনে সময় নিয়ে আলাদা করে ঘর গোছানোটা সকলের হয়ে ওঠে না। বর্তমানে গৃহে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঘরের কাজগুলোতে অনেক বেশি সময় দেওয়াটা বেশ অনেকটাই কমে এসেছে। আর নারীরাও ঘরের কাজগুলো সহজে মিটিয়ে ফেলার পথটা খুঁজছে বিভিন্নভাবে।
আবার অবিবাহিত অনেকে মেস বা ভাড়া বাসাতে আরেকটু সহজে গুছিয়ে থাকতে চান। তাদের জন্যই সহজে আর অল্প সময়ে নিজের থাকার জায়গাটা গুছিয়ে রাখতে পারলে বেশ মন্দ হয় না। আজ তাই আমাদের পাঠকদের জানাবো কীভাবে অল্প সময়ে আর খুব সহজেই আপনার নীড়টি আপনি গুছিয়ে ফেলতে পারেন সেই কথা।
সকালটা হোক আরেকটু ছিমছাম
ঘুম থেকে উঠেই পরিচ্ছন্নতার দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া যাক। মাত্র ৩-৫ মিনিটের কাজ হলেও ঘুম থেকে উঠেই যদি আপনি আপনার বিছানাটা সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলেন, আপনার ঘরটির সৌন্দর্যে তা রাত পর্যন্ত আলাদা মাত্রা যোগ করতে থাকবে। সেই সাথে আপনার ঘর গোছানোর কাজটাকেও নিমেষেই যেন অর্ধেক করে দেবে দিনের শুরুতেই এই ছোট্ট কাজটি।
অগোছালো আর ময়লা কাপড়গুলোর ব্যবস্থা
বাড়িতে হোক বা মেসে- এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় মুহূর্তেই আপনার ঘরের সৌন্দর্য মাটি চাপা দিয়ে দিতে পারে। তাই একটু ছিমছামভাবে থাকতে চাইলে অগোছালো কাপড়-চোপড়গুলোর একটা ব্যবস্থা তো করতেই হয়, তা হোক পরিধেয় বা ময়লা। পরিধেয় জামা-কাপড় পরার পর রোদে বা বাতাসে রেখে সাথে সাথে গুছিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিলে আপনি আলাদা করে সময় নিয়ে কাপড় গোছানোর ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন। আর ময়লা কাপড় তো অবশ্যই যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যাবে না। কোনো ঝুড়ি বা আলাদা ড্রয়ারে ভাঁজ করে সেগুলো রেখে দেওয়া যেতে পারে। অনেকের ময়লা কাপড় বাথরুমেই রেখে দেওয়ার অভ্যাস থাকে, যা খুবই দৃষ্টিকটু। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি ময়লা কাপড় সাথে সাথেই বা দুই একদিনের মধ্যেই ধুয়ে শুকিয়ে তুলে ফেলেন। তাতে যেমন থাকছে না আলাদা করে কাপড় কাঁচার ঝামেলা, সাথে থাকছে না ময়লা কাপড় গুছিয়ে রাখার কোনো চাপও।
বাথরুম ও রান্নাঘর- পরিচ্ছন্ন বাসার দুই প্রতিনিধি
কথায় আছে, কোনো বাসা কেমন তা বোঝা যায় সেই বাসার রান্নাঘর আর বাথরুম দেখে। রান্নাঘর আর বাথরুম নিঃসন্দেহে যেকোনো বাসার সবচেয়ে ব্যবহৃত অংশ। আর তাই এই অংশগুলো পরিচ্ছন্ন ও গুছিয়ে রাখা সবচেয়ে কঠিন ও দরকারি। সকালে গোসলের সময় কয়েক মিনিট সময় নিয়ে ধুয়ে নিতে পারেন আপনার গোসলের জায়গাটি। সেই সাথে সাবান, শ্যাম্পুর খালি প্যাকেট বা কৌটা কখনোই জমিয়ে রাখবেন না। ভেজা, ময়লা কাপড়, এমনকি ভেজা তোয়ালে পর্যন্ত বাথরুমে না রাখার চেষ্টা করুন। সেই সাথে বাথরুমে সুগন্ধির ব্যবহার একটি স্নিগ্ধ ভাব নিয়ে আসবে।
রান্নাঘরেই যেহেতু আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য নির্ধারিত হয়, আপনি তাই নিজেই বুঝতে পারছেন এটি পরিচ্ছন্ন রাখা কতটা জরুরি। কিন্তু সেই সাথে প্রচুর জিনিসপত্র, ধোঁয়া-কালি আর প্রতিবেলা নতুন আবর্জনা যোগ হওয়াতে এটা বজায় রাখা এখানে সবচেয়ে কঠিনও। অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আগেই সরিয়ে ফেলুন, তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী স্থানভেদে বাকিগুলো সাজিয়ে ফেলুন। প্রতিদিন যেগুলো লাগে সেগুলো রাখুন একদম হাতের কাছে, যেগুলো মাঝেমাঝে লাগে সেগুলো আলাদা করে সাজিয়ে রাখুন এবং যেগুলো বলা যায় হঠাৎ হঠাৎ বা কোনো উৎসবের সময় লাগে- ভালো হয় সেগুলো স্টোররুম বা অন্য কোথাও রাখলে। এতে আপনার রান্নাঘর বারবার ময়লা হবার ঝামেলা হবে না। প্রতিবেলা রান্না বা খাওয়ার পর নোংরা বাসনপত্র সুযোগ থাকলে ধুয়ে ফেলুন আর নির্ধারিত স্থানে রাখুন। ফলে আলাদা করে রান্নাঘরের জন্য সময় দেওয়া থেকে মুক্তি পাবেন। আবর্জনা ফেলার জন্য ঢাকনাসহ পাত্র নির্দিষ্ট করুন, দুর্গন্ধ ও জীবাণু ছড়িয়ে যাবে না। মসলা আর চিনি-লবণের কৌটাগুলো এক জায়গায় রাখুন, থালা-বাটিগুলো আলাদা আরেক জায়গায়। সারা ঘরময় জিনিসপত্র ছিটিয়ে থাকাটা বাদ রাখতে পারলে বেশিরভাগ কাজ সহজেই হয়ে যাবে।
এবার বলা যাক কিছু ছোট ছোট টিপসের কথা, যা আপনার কাজকে আরো সহজ করে দেবে।
প্রথমে কোন কাজ বা জিনিসগুলো আগে গোছানো দরকার তার একটা গুরুত্বের তালিকা বানিয়ে ফেলুন। ঠিক করে নিন কোন কাজগুলো ২-৩ সপ্তাহ পরে করলেও হবে। তারপর সময় নির্ধারণ করে সেরে ফেলুন জরুরি কাজগুলো। এখন আস্তে আস্তে বাড়িটা গুছিয়ে নেওয়া সুবিধা হবে আপনার জন্য।
প্রতিটি ঘরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিতে পারেন আগে। যেটা যে ঘরের জিনিস সেটা সেখানেই রাখার চেষ্টা করুন। আলাদা সময় নষ্ট না করে এটা করতে পারেন, যদি আপনি নিজেই এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার সময় খেয়াল রাখেন কিছু নিয়ে যেতে হবে কিনা। বাড়ির অন্য সদস্যদের সাহায্যও আপনি এক্ষেত্রে ভালোই কাজে লাগাতে পারেন।
নিজেদের থাকার জায়গা ছিমছাম, সুন্দর রাখাটা আপনার জন্য সবচেয়ে সহজ এবং কম সময়সাপেক্ষ হবে যদি বাড়ির অন্যান্য সদস্যদেরও এতে সহায়তা ও সামান্য হলেও অংশগ্রহণ থাকে। কাজ ভাগাভাগি করে নিলে সবসময়ই তা কমে যায়। সেই সাথে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গড়ে ওঠে সহযোগিতার মনোভাব, নিজেদের মধ্যে সময় কাটানোর সুযোগ পায় তারা এবং পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়।
কাজ বেশি আর সময় কম থাকলে রোজ করে নিতে পারেন পরবর্তী দিনের জন্য কাজের সময়সূচীসহ তালিকা। নিজের সুবিধামতো সাজিয়ে নিতে পারেন এক সপ্তাহের জন্য ঘরের কাজের তালিকা ও সময়সূচী। ছোটদের কাজও এই তালিকার মধ্যে রাখতে পারেন। ফলে তারা জানবে কবে, কখন আর কোন কাজটা তাদের সেরে রাখতে হবে। ভাড়া বাসা বদল বা নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে আবার সহজে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য এই পদ্ধতি দারুণ কাজে লাগে।
বাইরের জুতার ঘরে প্রবেশ দরজার কাছেই রোধ করুন। তাহলে ঘরের ধূলাবালি অর্ধেক এমনিতেই কমে যাবে। পড়া শেষ করে ওঠার সময় ঘরের বড়-ছোট সবারই অভ্যাস করানোর চেষ্টা করুন টেবিলটা একটু গুছিয়ে ফেলতে। বাড়িতে আলাদা পড়ার ঘর থাকলেও তা-ই করবেন। সকালে নাস্তার পর সবাই যেন প্লেটটা রান্নাঘরে রেখে আসে সেটাও দেখুন। গাছে পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার বা বারান্দা নোংরা না করা- কয়েক মিনিটের এসব কাজে সবার অংশগ্রহণ করানোর চেষ্টা করুন। কয়েক মিনিটের অভ্যাসগুলো আপনার কাজ সহজ করে দিয়ে সময় বাঁচিয়ে দেবে অনেকটা।
ছুটির কোনো একদিন রান্নার আয়োজন একটু সহজ করে নিয়ে সময় দিতে পারেন বসার ঘর আর বারান্দাটা একটু সাজিয়ে নিতে। মেহমানদের সামনে সুন্দর বসার ঘর আপনার মনটাও আনন্দে ভরে দেবে। সুন্দর গোছানো বারান্দা পড়ন্ত বিকালে মন ভোলাবে আপনার। আপনার জীবন আরেকটু সুন্দর আর গোছানো করে তুলতে সাহায্য থাকবে এদেরও।
ফিচার ইমেজ: niudeco.com