আজকের অবস্থানে আসতে নারীদের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হলেও, বিশ্ব ফ্যাশন বরাবরই নারী কেন্দ্রিক। যদিও বেশিরভাগ ডিজাইনারের পোশাকেই নারীর কমনীয় ও আবেদনময়ী রূপটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এসকল ডিজাইনারদের মাঝে যারা দূরদর্শী ও দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন, তাদের মধ্যে মাইকেল কোর্স অন্যতম। নারীর কমনীয়তা ও আবেদনকে এতটুকুও ক্ষীন না করেও কীভাবে নারীর পোশাককে আধুনিক, সার্বজনীন এবং আকর্ষণীয় ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক হিসেবে তৈরি করা যায়- নিজের ডিজাইনকৃত পোশাকের মাধ্যমে মাইকেল তা-ই উপস্থাপন করে আসছেন।
ফ্যাশন জগতে মাইকেলের হাতেখড়ি হয়েছিল বেশ অল্প বয়সে; মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পোশাক ডিজাইনের মাধ্যমে। মা প্রাক্তন মডেল জোয়ান হ্যামবার্গার ও বাবা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কার্ল এন্ডার্সন সিনিয়রের একমাত্র সন্তান কার্ল এন্ডার্সন জুনিয়র, মায়ের কথায় দ্বিতীয় স্বামী ব্যবসায়ী বিল কোর্সের নামের সাথে মিলিয়ে নতুন নাম ধারণ করেই হয়ে উঠেন মাইকেল ডেভিড কোর্স। জন্ম ১৯৫৯ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের লং আইল্যাণ্ডের মেরিকে। নিউ ইয়র্কে সমকামী বিয়ে আইনগতভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ২০১১ সালের আগস্ট মাসে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও ‘মাইকেল কোর্স ওইমেন্স’ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ল্যান্স ল্যপেরকে বিয়ে করেন।
‘লাকি চার্মস’ নামক ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল ও ‘চার্মিন পেপার টাওয়েলস’ এর জন্য তিনি শিশু মডেল হিসেব কাজ করেন। কিশোর মাইকেল ‘আয়রন বাটারফ্লাই’ নামক ব্র্যাণ্ড প্রতিষ্ঠা করেন বাড়ির বেজমেন্ট থেকেই। তারপর ডিজাইনকৃত পোশাক বিক্রি করতে শুরু করেন। নিউ ইয়র্কের মেরিকে বেড়ে ওঠা মাইকেল বেলমোরের জন এফ কেনেডি হাই স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে অভিনয় বিষয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু ১৪ বছর বয়সেই তার স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি অভিনয় ছেড়ে নিউ ইয়র্কের ‘ফ্যাশন ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’ তে যোগ দেন। সেখানেও তিনি মাত্র ৯ মাস ছিলেন। এসময়েই ম্যানহ্যাট্টেন এর ‘লোথার্স’ নামক একটি বুটিকে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন, যেখানে তিনি নিজের ডিজাইনকৃত পোশাকও বিক্রয় করতেন। বিক্রয়কর্মী হিসেবে শুরু করলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বুটিকটির ‘ভিসুয়্যাল ডিসপ্লে হেড’ দায়িত্ব পান।
লোথার্সের খুব কাছেই ছিল বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল পণ্যের স্টোর ‘বার্জডর্ফ গুডম্যান’। স্টোরটির তৎকালীন ফ্যাশন ডিরেক্টর ডন মেলো মাইকেলের কাজ দেখে তাকে সেই স্টোরে তার ডিজাইনকৃত পোশাক বিক্রয় করার প্রস্তাব দেন। ১৯৮১ সালে মাইকেল বার্জডর্ফে স্বনামে ‘মাইকেল কোর্স’ ব্র্যাণ্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার ডিজাইনকৃত পোশাকের প্রথম কালেকশন উপস্থাপন করেন। উক্ত চুক্তি সাক্ষরের তিন বছরের মধ্যেই তার ডিজাইনকৃত পোশাকের কালেকশন নিম্যান মার্কাস, স্যাকস ফিফ্থ অ্যাভেন্যু, ব্লুমিংডেল সহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য বিলাসবহুল পণ্যের দোকানে বিক্রয় শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে মাইকেল কোর্স ব্র্যাণ্ডের প্রথম রানওয়ে শো অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯০ সালে বিশ্বখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন হাউজ ‘সেলিন’ তাকে ডিজাইনার হিসেবে নিয়োগ দেয়। তখন ব্র্যাণ্ডটির ব্যবসায়িক অবস্থা ততটা ভাল ছিল না। কিন্তু মাইকেল তার ব্যতিক্রমী প্রগতিশীল ডিজাইন ও পোশাকের অনুষঙ্গ সমৃদ্ধ কালেকশনের মাধ্যমে খুব অল্প সময়েই ব্র্যাণ্ডটিকে দাঁড় করান।
সেলিনের মূল মালিকানা ছিল বিশ্ব ফ্যাশনের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচ এর অধীনে। ১৯৯৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি মাইকেল এর স্বনামে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাণ্ড ‘মাইকেল কোর্স’ এর ৩৩ শতাংশের মালিকানা কিনে নেয়। আর মাইকেলকে সেলিনের ডিজাইনার থেকে পদোন্নতি দিয়ে ‘ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর’ পদে নিযুক্ত করে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি একই সাথে নিজস্ব ব্র্যাণ্ড ও সেলিনের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ বছরেই তিনি সেলিন ত্যাগ করে একাগ্রভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানে মনোনিবেশ করেন। একই বছরে স্পোর্টসওয়্যার হোল্ডিংস লিমিটেড ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে মাইকেল কোর্স ব্র্যাণ্ডের ৮৫ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়।
মাইকেল কোর্স তার যু্গান্তকারী ডিজাইন ও অনন্য অ্যাক্সেসরিজ কালেকশনের কল্যাণে বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন সচেতন নারীদের কাছে খুব দ্রুত সমাদৃত হয়ে ওঠেন। তার পোশাকের অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রতিটি কালেকশনই বছর জুড়েই পরা যায় এমন ধরনের পোশাকের সমারোহ থাকে। তার ডিজাইনকৃত পোশাকের মাধ্যমে একই সাথে দৃঢ় ও কমনীয় ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব।
পোশাকে অপ্রয়োজনীয় কোনো অনুষঙ্গের ব্যবহার একেবারেই নেই এবং সেসকল পোশাক সব ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে মানানসই করেই তৈরি। তার তৈরি পোশাকের কাট ও প্যাটার্ন বরাবরই খুব সরল, কিন্তু আধুনিক। তার ডিজাইনকৃত অ্যাক্সেসরিজের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। প্যারিস, কান, মিলান, লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক, হংকং সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাইকেল কোর্স ব্র্যাণ্ডটির ৭৭০টিরও বেশি আউটলেট রয়েছে। ২০০৪ সালে মাইকেল স্বনামে আরও একটি ব্র্যাণ্ড প্রতিষ্ঠা করেন- ‘মাইকেল মাইকেল কোর্স’- যেখানে তুলনামূলক কম দামে তার ডিজাইনকৃত তৈরি পোশাক বিক্রয় হয়।
২০০৪ সালে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ব্রাভো নেটওয়ার্কের প্রতিযোগিতামূলক রিয়্যালিটি শো ‘প্রজেক্ট রানওয়ে’ তে মূল বিচারক হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য মাইকেলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুরুতে তিনি এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। এই শো এ উঠতি তরুণ ডিজাইনারেরা নিজেদের ডিজাইনকৃত পোশাক নিয়ে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজস্ব ব্র্যাণ্ড প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সাহায্য পায়। তাছাড়া প্রখ্যাত ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউজের সাথে কাজ করার সুযোগও লাভ করে।
এই অনুষ্ঠানে মাইকেলের সাথে বিচারক হিসেবে আরও ছিলেন মডেল হাইডি ক্লুম ও ডিজাইনার টিম গান। অনুষ্ঠানটিতে নিজের উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও প্রত্যক্ষ সমালোচনা করার মাধ্যমে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেই সাথে তার পোশাকের ব্র্যাণ্ডও আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠানটির ৫টি সিজন পর্যন্ত তিনি এর বিচারক ছিলেন। এরপর ২০১২ সালে তিনি এই দায়িত্ব থেকে অবসর নেন।
নিজে একজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার পাশাপাশি তিনি অনেক তরুণ ডিজাইনারের জন্য ফ্যাশন জগতে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ করে দেন। তার ব্র্যাণ্ডের সাথে ইন্টার্ন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করে পরবর্তীতে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা ডিজাইনারদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্র্যাণ্ড ‘প্রেঞ্জা স্কুলার’ এর ডেরেক ল্যাম ও লাজ্জারো হার্নান্দেজ উল্লেখযোগ্য। ২০১৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনের নির্বাচিত ‘১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি’র তালিকায় মাইকেল কোর্স স্থান করে নেন।
২০১৫ সালে তিনি ‘জাতিসংঘ ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’ এর ‘গ্লোবাল অ্যাম্বাস্যাডর অ্যাগেনস্ট হাঙ্গার’ নির্বাচিত হন। ‘ওয়াচ হাঙ্গার স্টপ’ নামক একটি হাতঘড়ি ডিজাইন ও বিক্রির মাধ্যমে তিনি বিশ্ব জুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৬ সালে মাইকেল কোর্স ব্র্যাণ্ডটির ৩৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। এই ব্র্যাণ্ডের নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে অসংখ্য তারকার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। ফ্যাশন সচেতনতার জন্য জনপ্রিয় মিশেল ওবামা তার প্রথম অফিসিয়াল চিত্রকলার জন্য মাইকেল কোর্সের ডিজাইনকৃত পোশাক বেছে নেন।
কর্মজীবনে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা হিসেবে মাইকেল অনেক স্বীকৃতি লাভ করেছেন ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘সিএফডিএ ওইমেন্স ওয়্যার ডিজাইনার অফ দ্য ইয়ার ১৯৯৯’, ‘সিএফডিএ মেন্সওয়্যার ডিজাইনার অফ দ্য ইয়ার ২০০৩’, ‘ওলিভার আর. গ্রেস অ্যাওয়ার্ড ফর ডিস্টিংগ্যুইস্ড সার্ভিস ইন অ্যাডভান্সিং ক্যারিয়ার রিসার্চ ২০১০’, ফ্র্যাগ্র্যান্স ফাউণ্ডেশন এর ‘ফিফি অ্যাওয়ার্ড ফর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট ২০১০’ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ২০১০ সালে সর্বকনিষ্ঠ ডিজাইনার হিসেবে সিএফডিএ’র ‘জিওফ্রে বিন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।
৫৯ বছর বয়সী মাইকেল কোর্স প্রতিনিয়ত তার ডিজাইনের মাধ্যমে সকল বয়সের ফ্যাশন সচেতন নারী-পুরুষের হৃদয়ে দৃঢ় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে তার কাছে ভক্তদের প্রত্যাশা কমেনি এতটুকুও। সেই প্রত্যাশার মেটানোর লক্ষ্যেই তিনি নিজেও নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট ছাপ রেখে যাচ্ছেন তার প্রতিটি কালেকশনে।