সকাল থেকেই বেশ চুপচাপ হয়ে আছে আবির। রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটলেই তার বিয়ে। তিন বছর ধরে প্রেম করার পর পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়ে হচ্ছে তার। বাড়ির কারো এই বিয়েতে আপত্তি ছিল না। তবুও সকাল থেকেই কেমন যেন মনমরা হয়ে বসে আছে আবির। কারো সাথে ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলছে না সে। দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বললেই চলে। কিছু বললেই রেগে উত্তর দিচ্ছে সবার সাথে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, কেন তার এমন হঠাৎ পরিবর্তন? সকলের ধারণা, এটি বিয়ের আগের দিনের স্নায়বিক উত্তেজনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
ব্যাপারটি যত সহজে ভাবা হয়, আসলে কি ততটাই স্বাভাবিক? পাশ্চাত্যে হয়ত ব্যাপারটা অনেকটাই স্বাভাবিক। সেখানে প্রায় সকলেই ‘কোল্ড ফিট’ নামক শব্দটির সাথে কম বেশি পরিচিত। একে আবার অনেকেই ‘গেমোফোবিয়া’ নামেও সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। মূলত গেমোফোবিয়ার সাথে কোল্ড ফিটের কিছুটা ধারণাগত পার্থক্য রয়েছে। গেমোফোবিয়া হচ্ছে বিয়ে বা কোনো সম্পর্ক তৈরি নিয়ে ভয় পাওয়া, আর কোল্ড ফিট হলো সহজ বাংলায় দুশ্চিন্তা করা। আমাদের দেশে গেমোফোবিয়া ধারণাটির অস্তিত্ব তেমনভাবে শোনা না গেলেও, জেনে হোক বা না জেনেই হোক, অনেকেই এই ফোবিয়ার ভুক্তভোগী। পাশাপাশি বর্তমানে একান্নবর্তী সংসার ভেঙে ছোট পরিবারের সংখ্যা বাড়ার কারণে ধারণাটি বিস্তৃত হচ্ছে। অনেকটা সময় স্বাধীনভাবে কাটানোর পর হঠাৎ করে এক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মতো মানসিক চাপ আর কী-ইবা হতে পারে?
আগেকার দিনে, বিয়েটা ছিল অনেকগুলো পরিবারের একটি মিলনমেলা যা একটি বিরাট উৎসবের কাছাকাছি। উৎসব এখনও আছে, তবে আনুষ্ঠানিকতা কমে আসছে অনেকটাই। বর্তমানে পরিবারগুলো ছোট ছোট সংসারে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত দায়িত্ব ও আর্থিক কারণ হেতু অনেকেই বিয়ে নিয়ে এক ধরনের দুঃস্বপ্নে বাস করে। গেমোফোবিয়া এমন এক ধরনের সমস্যা, যার কারণে বর বা কনে দুশ্চিন্তা কিংবা নার্ভাসনেসে আক্রান্ত হয়ে বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে দেওয়ার উপক্রম করে। তাই ছেলেমেয়ে সকলের গেমোফোবিয়া বা বিয়ের আগের দুশ্চিন্তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়, যাতে করে এমন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে তা মোকাবেলা করা সহজ হয়।
তবে সকলের মনেই হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, কখন বুঝবেন আপনার অবাঞ্ছিত দুশ্চিন্তা হচ্ছে? যখন বিয়ের পূর্বে কোনো ছেলে বা মেয়ের এমন অবস্থা দেখা দেয় তখন কিছু ভাবনা মনের অজান্তেই উঁকি দিয়ে যায়। এই সময় কিছু ভাবনার বিষয়গুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো।
স্বাধীন জীবনের সমাপ্তি
বিয়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছেলে বা মেয়ে এক ধরনের স্বাধীন জীবন অতিবাহিত করে। তাই বর্তমানে অধিকাংশ ছেলেমেয়ের মনের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করে যে, বিয়ের পরেই হয়তো তাদের এই স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। পাশাপাশি অনেক বন্ধুর বিয়ে পরবর্তী অবস্থার কথা চিন্তা করেও এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসা অমূলক নয়। তাই দুশ্চিন্তার প্রথম ও প্রধান উপসর্গ হলো স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ভাবনা।
মাথার উপর হাজার দায়িত্ব চেপে আসা
চিরাচরিত নিয়মেই বিয়ে বলতেই দায়িত্ব নামের ব্যাপারটি সকলের মাথায় চলে আসে। ছেলেরা বারবার মনে করতে থাকে, বিয়ে করার মানেই হাজার দায়িত্ব মাথায় চাপিয়ে নেয়া। অন্যদিকে মেয়ের মাথায় চেপে বসে বরের বাড়ি সামলানো এবং শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে মানিয়ে চলার দায়িত্ব।
সিদ্ধান্তটি কি খুব তাড়াতাড়ি নেওয়া হলো?
বিয়ের আগের রাতে মনে হাজার প্রশ্ন উঁকি দেবে। আমি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি? আরেকটু কি সময় নিতে পারতাম না? আমি কি সুখী হতে পারবো? ভালোই তো ছিলাম, একা ছিলাম। বিয়ের পর আমার কোনো চাওয়া পাওয়া কি থাকবে? এত দায়িত্ব আমি কি নিতে পারব? এমন সব প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকবে।
মনের ভেতর থেকে বারবার বলা হবে, তুমি ভুল করছ, তুমি পালাও, এই বিয়ে ছেড়ে তুমি পালাও। তখন মন শুধু চাইতে থাকবে, যেকোনোভাবে যেন বিয়েটা ভেঙে যায়। দরকার হলে কিছুদিন পর আবার দেখা যাবে।
সকলকে নিজের বিয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করছেন
যখন আপনি বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনকে বারবার নিজের বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করবেন, তখন বুঝতে হবে আপনি অযথা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় আপনি আরেকজনের কাছে আশ্বাস চাইবেন যে, বিয়ে করাটা আসলেই ঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়ে।
বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলা
কোল্ড ফিটে আক্রান্ত হলে বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রতি এক ধরনের অনীহা কাজ করবে। বিয়ের কোনো ধরনের আয়োজনে তেমন কোনো আগ্রহবোধ হবে না। সব সময় অনুষ্ঠানের যে কোনো আয়োজন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকবেন।
নিজের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার জন্মানো
সবসময় আপনার মনে এক ধরনের হাহাকার কাজ করতে পারে। আপনার মনে হতে থাকবে, আপনি জীবনে অনেক বড় একটি ভুল করে ফেলেছেন। আপনার বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা মোটেও ঠিক হয়নি। আপনি অনেক মানুষের মাঝেও তখন নিজেকে নিঃস্ব অনুভব করবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, নিজের এমন মানসিক অবস্থা বুঝতে পারলেও বর বা কনের করণীয় কী হতে পারে? ভালোবাসার বিয়েতে তা-ও কিছুটা ভাবার অবকাশ থাকে, কিন্তু পারিবারিক বিয়েতে ব্যাপারটি আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে। নিজের অজান্তেই বিয়ের সকল আনন্দ হারিয়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় শুধু বিয়ের খারাপ দিকগুলোই মনের মধ্যে আসতে থাকে। এই ধরনের চিন্তা নারী-পুরুষ উভয়ের মনেই আসতে পারে। তাদের মধ্যেও এই ধরনের চিন্তা আসাটা আজকাল সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো দেখা যায়, বিয়ের আগের দিন ছেলে বা মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। এর পেছনে কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপার না-ও থাকতে পারে। এই ধরনের বিদঘুটে পরিস্থিতির জন্যে দুটো পরিবারকেই অনেক সময় অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই গেমোফোবিয়ার মাত্রা যা-ই হোক না কেন, পাত্র বা পাত্রীকে এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
নিজেকে অনেক বেশি কাজে ব্যস্ত রাখা
বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যদি আপনার মনে হয় যে, আপনি অযথা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত, তখন বিচলিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। যদি বুঝতে পারেন আপনার সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে, কিন্তু বিয়ের আগের মুহূর্ত আপনাকে বিচলিত করছে, তবে নিজেকে অনেক বেশি কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। বিয়ের ব্যাপারে ঠিক সেই মুহূর্তে যত কম ভাবা যায় ততই ভালো। নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখতে পারলে এই ধরনের সমস্যা অনেক সহজেই এড়ানো সম্ভব।
বন্ধুবান্ধবের সাথে হাসি-ঠাট্টায় সময় কাটানো
কোনো প্রকার ফোবিয়ায় আক্রান্ত হলে, কাছের বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তাদের বিয়ের আগের অবস্থার গল্প শুনে, হাসি-ঠাট্টায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। যত বেশি বিয়ের ব্যাপারটি হাসি-ঠাট্টায় উপভোগ করা যাবে তত বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চলা সম্ভব।
পরিচিত কোনো পরিণত বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছে পরামর্শ নেওয়া
পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের অনেকেই গেমোফোবিয়া সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকাটাই স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় তাদের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারটি তেমন ফলপ্রসু না হওয়াটাই বাস্তব। মানুষের চাওয়ার সাথে পাওয়ার অসামঞ্জস্যতার কারণে হয়তো এই ধরনের উদ্বেগ বেড়ে চলেছে, বিয়ে করার চাইতে এখন টিকিয়ে রাখা বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা মাথায় আসা অবাক করা কিছু নয়। ছেলে বা মেয়ের প্রিয় বন্ধু কারো সাহায্য নিতে হবে যারা ব্যাপারটা সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে। বিয়ের আগের সময়টাতে ছেলে বা মেয়ে কাউকেই একা থাকতে দেওয়া যাবে না। অনেকটা সময় আড্ডা, খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকলে, বিয়ে করার ভালো দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করলে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে হয়ত মুক্তি পাওয়া যাবে।
তবে কেবল দুশ্চিন্তা আর সতিকারের সমস্যার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এমন নয় যে সব সমস্যাই কেবল অযাচিত দুশ্চিন্তা। অনেক সময় সত্যিকার অর্থেই কারো ব্যক্তিগত সমস্যা কাজ করতে পারে। হঠাৎ হয়ত পছন্দ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। তবে সেসব সমস্যা এর আওতায় আসবে না, গেমোফোবিয়া বলতে সাধারণত বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা বা বিয়ের পর নিজের স্বাধীন জীবনে যে বাধা আসবে তা নিয়ে উদ্বিগ্নতাকেই বোঝানো হয়।
বিয়ের আগের এই দুঃসহ অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সিনেমা ও সিরিয়াল তৈরি হয়েছে হলিউডে। আমাদের চারপাশেই কেউ কেউ বিয়ে নামক শব্দটি ভয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। এখন সময় সচেতন হবার, জীবনের স্বাভাবিক নিয়মেই এমন অযাচিত অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।