মহামারী এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি। তবে যেটুকু স্থিতিশীলতা এসেছে বিশ্বে এখন, সেটাও কম নয়। করোনাকালীন নানারকম মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয় কাটিয়ে মানুষ নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিলেও চারপাশে রয়ে গিয়েছে তার ছাপ। শুধু বাইরেই নয়, মহামারীর কারণে সৃষ্ট এই ছাপ পড়েছে আমাদের ভেতরের জগতেও।
হতাশা, উদ্বিগ্নতা আর অন্যান্য মানসিক সমস্যা ঘর বেধেছে বহু মানুষের জীবনে। শুধু মহামারীর জন্যই নয়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় মানসিক এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন, হচ্ছেন, বা হবেন। একটা গোটা প্রজন্ম মহামারী ও অন্যান্য কারণে যে মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে, সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, মানসিক অবস্থা ইতিবাচক করে তুলতে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতেও যতটা সম্ভব ভালো থাকতে কিছু ব্যাপার সাহায্য করতে পারে আপনাকে।
ওষুধ বা থেরাপি নয়, আজ বলবো মানসিক সমস্যাগুলোকে কমিয়ে আনার একদম ভিন্ন এক উপায়ের কথা। নতুন কোনো কিছু নয়, বলছিলাম শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের কথা।
সম্প্রতি ব্রিটিশ জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় প্রায় ১,০০০ রিসার্চ ট্রায়াল পরিচালনার পর এ সিদ্ধান্তে আসেন গবেষকেরা যে, মানসিক সমস্যা ও চাপ থেকে দূরে থাকতে একজন মানুষকে ওষুধ বা কাউন্সেলিংয়ের চেয়েও বেশি সাহায্য করে শরীরচর্চা। মোট ১,২৮,১১৯ জন মানুষের অংশগ্রহণে করা এই পরীক্ষায় কিছু মানুষকে সাধারণ জীবনযাপন করতে বলা হয়, এবং বাকিদের সপ্তাহে মোট ১৫০ মিনিট নানারকম শরীরচর্চা, যেমন- হাঁটাহাঁটি, ভারোত্তোলন, যোগব্যায়াম ইত্যাদি করতে দেওয়া হয়। হতাশা, উদ্বিগ্নতা, মানসিক চাপের জন্য ওষুধের চেয়ে তুলনামূলক বেশি কার্যকর হিসেবে দেখা যায় এক্ষেত্রে শরীরচর্চাকে।
শুধু তা-ই নয়, শারীরিক নানা সমস্যার বেলায়ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এই শরীরচর্চার প্রক্রিয়া। গবেষণায় হতাশা, এইচআইভি, কিডনি রোগ, গর্ভধারণ পরবর্তী হতাশা ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বেশি ভালো কাজ করতে দেখা যায় শরীরচর্চাকে।
কতটা সময় শরীরচর্চা করা ভালো?
গবেষণায় পাওয়া তথ্যানুযায়ী, শরীরচর্চা নিজের ক্ষতি না করে বা অতিরিক্ত চাপ না নিয়ে যতটা করা যায় ততটাই আমাদের মানসিক অবস্থার জন্য ভালো। যেমন- ধীরে হাঁটার চেয়ে একটু জোরে হাঁটা, কম সময়ে না করে মোটামুটি ৬-১২ সপ্তাহ শরীরচর্চা করা- এই সবকিছুই মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে। তবে তার মানে এই নয় যে আপনি আপনার শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ দেবেন। কারণ, অতিরিক্ত চাপ একসময় আপনার শরীর এবং সেখান থেকে প্রভাবিত হয়ে মনকেও নানারকম সমস্যায় জর্জরিত করবে।
শরীরচর্চা মানসিক সমস্যা দূর করে ঠিকই, কিন্তু ঠিক কতটা?
মানসিক সমস্যার যে গৎবাঁধা সমাধানগুলো আছে চারপাশে সেগুলোর সাথে তুলনা করলেই এই সহজ হিসেবটা বের করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরচর্চা অন্যান্য ওষুধ বা কাউন্সিলিং-এর মতো উপায়ের চাইতে মানসিক সমস্যা দূর করতে ১.৫ গুন বেশি কাজ করে। এছাড়াও পাশাপাশি আছে সবচেয়ে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আর কম খরচে শারীরিক কাঠামো ঠিক করার দারুণ সুযোগও। যেটা কিনা দীর্ঘমেয়াদে আপনার হৃদপিণ্ডের কার্যক্রম আর হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতেও সাহায্য করবে।
শরীরচর্চাই কেন?
এটা তো জানা গেলো যে শরীরচর্চা বা ব্যায়াম ওষুধের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বেশি কাজ করে। কিন্তু কীভাবে এমনটা সম্ভব সেটাও নিশ্চয় জানতে ইচ্ছা করছে আপনার? চলুন জেনে নেওয়া যাক!
কোনো একটি উপায়ে না, ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যায়াম মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। স্বল্প আর দীর্ঘ- দুই মেয়াদেই কাজ করে ব্যাপারটি। শরীরচর্চা করলে সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্কে এন্ডরফিন আর ডোপামিনের মতো হরমোন নিঃসরিত হয়, যা মন ভালো করে। এতে মানসিক চাপও দ্রুত কমে আসে। মস্তিষ্কে প্রদাহ দূর করতে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে শরীরচর্চা। সবমিলিয়ে খুব সহজে কম খরচে আপনার মস্তিষ্ককে দারুণ একটা অবস্থায় নিয়ে যায় ব্যায়াম।
আর এই ব্যায়ামই যদি আপনি লম্বা সময়ের জন্য করেন, সেক্ষেত্রে আপনার ঘুমের যেকোনো সমস্যাও দূর করে ব্যায়াম। ঘুম না হওয়া হতাশা আর উদ্বিগ্নতা বৃদ্ধি করে। ঘুম ঠিকঠাক করার মাধ্যমে মানসিক সমস্যাগুলো অনেকটাই কমিয়ে আনে শরীরচর্চা। কিছু না করতে পারা, নিজেকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি চিন্তা আমাদের হতাশার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে। লম্বা সময়ের জন্য শরীরচর্চা মানুষের ভেতরে নিজের এই হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতেও ভূমিকা রাখে।
শুধু এই একটি গবেষণাই না, শরীরচর্চার উপরোক্ত উপকারী দিকগুলো মানেন এবং ব্যবহার করে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরাও। বিশ্বের বিভিন্ন হাসপাতালে মেডিকেশন আর সাইকোথেরাপির পাশাপাশি বা এগুলোর বদলে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে হ্যাঁ, শুধু শরীরচর্চার উপরেই তাই বলে নির্ভরশীল হওয়া ঠিক না। আপনার চিকিৎসক অবশ্যই শরীরচর্চার পরামর্শ দেবেন মানসিক সমস্যার সাথে লড়াই করার জন্য। তবে এর পাশাপাশি আপনার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে কাউন্সেলিং বা ওষুধের পরামর্শ চিকিৎসক প্রদান করে থাকলে সেটাও মেনে চলুন। সাথে স্বাস্থ্যকর খাবার আর জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলার ব্যাপার তো আছেই। তবে অবশ্যই, এই সবকিছুর পাশাপাশি কার্যকর আর সাশ্রয়ী উপায় হিসেবে শরীরচর্চাকে নিয়মিত আপনার দৈনন্দিন কার্যক্রমের তালিকায় কিন্তু রাখতেই পারেন!