মাকড়শা, অন্ধকার, উচ্চতা- এমন নানা বিষয়ে আমাদের ফোবিয়া বা ভীতি থাকতেই পারে। তবে তাই বলে যেটা খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি, সেই খাবার নিয়েও যে মানুষের ফোবিয়া থাকতে পারে সেটা কল্পনা করাটাও একটু কঠিন। এমনিতে ছোটবেলায় বাচ্চারা না খাওয়ার জন্য নানারকম কৌশল খুঁজে বের করে, খেতে চায় না, খাবার দেখলেই কান্না শুরু করে দেয়। তবে এর সবটাই ক্ষণস্থায়ী। সবাই ভাবে বড় হলে শিশুদের খাবার নিয়ে এই ঝামেলাগুলো দূর হয়ে যাবে। বাস্তবেও সেটাই হয়। কিন্তু আজ এমন ক্ষণস্থায়ী ফোবিয়া নয়, খাবার সংক্রান্ত পাকাপোক্ত এবং অবাক করে করে দেওয়ার মতন কিছু ফোবিয়ার কথাই বলবো আপনাদের।
১। ডেইপনোফোবিয়া
গালভরা এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা বাদবাকি সময় স্বাভাবিক থাকেন, তবে রাতের খাবারের সময় হলেই চুপ হয়ে যান। রাতের খাবারের সময় টেবিলে কথা বলতে প্রচন্ড ভয় পান তারা। কেবল রাতের খাবারের টেবিলেই নয়, অন্যান্য সময় খেতে বসলেও এই ভীতি কাজ করে থাকে অনেক মানুষের ভেতরে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি ডিনারের সময়।
সাধারণত, খাবার টেবিলে এর আগে ঘটে যাওয়া কোনো বাজে অভিজ্ঞতার জের টেনেই এই বিশেষ ফোবিয়া ঘটে থাকে। অবচেতনভাবেই মানুষ ভয় পেতে থাকে যে, হয়তো কথাবার্তা বললে এসময় কোনো সমস্য সৃষ্টি হবে। তাই সে চুপ হয়ে যায়। এছাড়াও পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনা এবং ছোটবেলার কোনো সমস্যার কারণেও তৈরি হতে পারে ডেইপনোফোবিয়া।
২। ওইনোফোবিয়া
এই ফোবিয়ায় বেশি ভুগে থাকেন পশ্চিমা অঞ্চলের মানুষেরা। ওইনোফোবিয়ার ক্ষেত্রে মানুষ ওয়াইন পান তো দূরে থাকুক, সেটার গন্ধটুকুও সহ্য করতে পারে না। ওয়াইন সংক্রান্ত কোনো কথা বা ঘটনা ঘটলেই তাদের ভেতরে ভীতি কাজ শুরু করে। ফলে তারা অস্থির হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতায় ভোগা মানুষ এবং ওইনোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ- এই দুই ধরনের মানুষের প্রকৃতি কিন্তু অনেকটা এক রকম। বমিভাব, অস্থিরতা, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা- এই সবকিছুর মুখোমুখি হন একজন ওইনোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তি।
৩। ল্যাকানোফোবিয়া
এই ভীতি আমাদের অনেকের ভেতরে কাজ করলেও সেটা ঠিক ফোবিয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছে কিনা বলাটা মুশকিল। ল্যাকনোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা শাক-সবজি খেতে ভয় পান। কী? আপনার সাথেও মিলে গেল বুঝি? তবে বাস্তবে সত্যিকারের ল্যাকনোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা শাক-সবজি যে কেবল খেতে পারেন না তা নয়, শাক-সবজির ধারে কাছে গেলেও তাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, সর্দি লেগে যায়। কেবল সুষম খাবার গ্রহণই নয়, স্বাভাবিক পুষ্টিটুকু পাওয়াও অনেক বেশি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ল্যাকনোফোবিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে।
৪। ম্যাগাইরোকোফোবিয়া
রান্না করতে ইচ্ছে করে না অনেকেরই। তবে কেবল ইচ্ছে না করা নয়, এমন অনেকে আছেন যাদের রান্না করার কথা মনে হলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়, আমি তাদের কথাই বলছি। অনেকে হয়তো না জেনেই ম্যাগাইরোকোফোবিয়া বা রান্না করার ফোবিয়াতে আক্রান্ত আছেন। নানারকম সামাজিক পরিস্থিতির ফলাফল হিসেবে জন্ম নেয় এই ভীতি। সেটা হতে পারে খাবার পুড়িয়ে ফেলার ভয়ে, কিংবা খাবারে ফুড পয়জনিং হবে- এমন ভয়ে। আদতে ভয় যেটা থেকেই তৈরি হোক না কেন এটা মানতেই হবে যে, ম্যাগাইরোকোফোবিয়া বেশ দামী একটা ফোবিয়া। এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা তাদের হাতের কাছেই রাখেন নানারকম রেস্টুরেন্টের মেন্যু কার্ড। খাবারের সময় আসতেই তাদের অস্বস্তি বেড়ে যায়। আর এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে বেশ ভালো একটা খরচ হয়ে যায় তাদের প্রত্যেকদিন।
৫। জোকোলেটফোবিয়া
নামটা শুনে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে? অন্যান্য ফোবিয়ার নামগুলো ফোবিয়ার ধারে কাছে না থাকলেও জোকোলেটফোবিয়ার নাম অনেকটাই এটি যে খাবারটি নিয়ে তৈরি তার সাথে মিলে যায়। ঠিক ধরেছেন! চকোলেট। আমরা চকোলেট খেতে ভালোবাসি। শিশু থেকে বুড়ো- এমন কেউ নেই যার চকোলেট খেতে ভালো লাগে না। ভালোবাসা প্রকাশ থেকে শুরু করে মান-অভিমান ভাঙ্গানো পর্যন্ত- সবখানে ব্যবহার করা হয় চকোলেট। তবে জোকোলেটফোবিয়ায় আক্রান্তদের কাছে চকোলেট ব্যাপারটা যে কেবল বিরক্তিকর তা-ই নয়, বেশ ভীতিপ্রদও!
জোকোলেটফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষের কাছে চকোলেট কেবল ভয়ের কারণ না, বেশ নেতিবাচক একটি পদার্থ। শুধু চকোলেট নয়, চকোলেট জাতীয় যেকোনো খাবার ধরে দেখলেও দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলেন এই রোগে আক্রান্তরা। কেবল সামাজিক সমস্যাই নয়, মানসিক নানা সমস্যাও তৈরি করে এই ফোবিয়াটি। মানুষের কাছে রোগী অদ্ভূত একটা প্রতিক্রিয়া তো পানই, সেই সাথে মানসিকভাবে নিজেও সমস্যায় ভোগেন। কেনই বা ভুগবেন না বলুন? পাশের মানুষগুলো কত মজা করে চকোলেট খাচ্ছে আর আপনি একটু ছুঁয়েও দেখতে পারছেন না- ব্যাপারটা কতটা মানসিক কষ্টদায়ক সেটা এবার বুঝতে পারছেন?
৬। অরথোরেক্সিয়া
অনেকে হয়তো শুচিবায়ের সাথে এই ফোবিয়াকে মিলিয়ে ফেলতে পারেন, তবে ব্যাপারটা ঠিক শুচিবায় নয়। এই ফোবিয়াতে আক্রান্ত মানুষেরা সবসময় ভয়ে থাকেন হয়তো তিনি কোনো অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ফেলবেন। আর তাই খাবার বাছতে থাকা বা যেকোনো খাবার দেখলেই ভয় পাওয়াটা তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।
কেবল যে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ভয় কাজ করে এই ক্ষেত্রে তা নয়, কোনো খাবার ধোয়া হয়েছে কিনা ঠিক করে, সেটা রান্নার সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা হয়েছে কিনা- এসব ভয়ও কাজ করে আরথোরেক্সিয়া ফোবিয়ার সময়। ১৯৯৭ সালে প্রথম এই রোগের নাম দেওয়া হয়। ইদানিং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ট্রেন্ড চলছে। আর এই স্রোতে গা ভাসিয়ে অনেকেই অতিরিক্ত সচেতন এবং সেখান থেকে বিষয়টিকে রোগের কাতারে নিয়ে যাচ্ছেন- অরথোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত মানুষদের ক্ষেত্রে এই কথাগুলোই বলা যায়।
৭। ইচথিফোবিয়া
হাস্যকর মনে হলেও, ইচথিফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা কেবল যে মাছের গন্ধ বা উপস্থিতিতে সমস্যা বোধ করেন তা নয়, সেই সাথে মাছ আছে এমন স্থানেও গোসল করতেও ভয় পান! পুকুর কিংবা সমুদ্রে গোসল করার মতন ভয়ংকর আর কিছুই নেই ইচথিফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষগুলোর কাছে। উদ্বিগ্নতা, মাথা ঘোরার মতন বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় এই রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে।
ইচথিফোবিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা মাছ দেখলে সেটাকে অশুভ ইঙ্গিত বলে মনে করেন। মাছের গন্ধ পেলেও অসুস্থ হয়ে যাবেন এমনটা মানসিকভাবেই ভেবে রাখেন। তাই মাছের ধারে কাছে গেলেও তাদের নানারকম সমস্যা তৈরি হয়।
৮। ফাগোফোবিয়া
এমন অনেকে আছেন যাদের কাছে ওষুধ খেতে যাওয়া মানেই অসম্ভব যন্ত্রণায় পড়ে যাওয়া। বিশেষ করে ট্যাবলেটজাতীয় কোনো ওষুধ খেতে গেলেই বারবার তাদের মনে হয় এই বুঝি গলায় আটকে গেল সেটা। ফলে, ওষুধ গলায় আটকে যাক বা না যাক, তাদের দম বন্ধ হয়ে আসার বা গলায় আটকে আছে কিছু এমন মনে হওয়ার ভয়টা কাজ করবেই। এছাড়াও এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষগুলোর মধ্যে সারাক্ষণ নিজের গলার ভেতরে কিছু আটকে আছে এমন অনুভূতি দেখা দেয়। ফলে কোনোকিছু খেতে গেলেই সমস্যা সৃষ্টি হয় ফাগোফোবিয়ায় আক্রান্তদের।