আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অক্সিজেনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই একমুঠো খাবারের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে অসংখ্য মানুষ। তবে অর্থনীতি আর সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে খাবারের ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। আগে দরকারের বাইরে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত খাবার কথা চিন্তাই করত না, অথচ আজকাল প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষই রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি রেস্টুরেন্টের বদৌলতে নানা দেশের নানা স্বাদের খাবারও আজকাল খাবার সুযোগ মিলছে। কিন্তু এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে খাবার নষ্ট আর অপচয় হওয়া। অথচ বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাবারের চাহিদা, প্রচুর খাবার নষ্ট হবার পরেও অভুক্ত থেকে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
খাদ্য নষ্ট ও অপচয়ের সংজ্ঞা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (FAO) হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত খাবারের এক-তৃতীয়াংশ খাবার নষ্ট কিংবা অপচয় হচ্ছে! খাদ্য অপচয় কিংবা খাদ্য নষ্ট হওয়ার সংজ্ঞা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বিভিন্নভাবে দিলেও পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে দুটি সহজ সংজ্ঞা এই লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে। খাবার নষ্ট বলতে বোঝানো হয় উৎপাদন থেকে গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবহনের সমস্যা কিংবা সঠিকভাবে মজুদ না করার কারণে খাবার ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হতে পারে। অন্যদিকে খাবারের অপচয় হচ্ছে যখন গ্রাহক বা ভোক্তার কারণে খাবার নষ্ট হয়। সম্পূর্ণ ভালো একটি খাবার শুধুমাত্র পছন্দমত রঙ বা আকারের না হওয়ায় অনেকে ফেলে দেন। আবার একসাথে অনেক খাবার কিনে খেতে না পারার ফলে অপচয় করেন অনেক গ্রাহক। আর রেস্টুরেন্টে কিংবা রান্না করা খাবার নষ্ট করা তো আজকাল খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে।
খাদ্য নষ্ট ও অপচয় হয় যেভাবে
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে খাবার নষ্ট বা অপচয় বাসা-বাড়িতেই বেশি হয়। কিন্তু বাস্তবে খাবার ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে নষ্ট হওয়া শুরু হয়। খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বেশ লম্বা একটি প্রক্রিয়া কাজ করে। আর সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় এই পর্যায়েই। তবে যেসব দেশ প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে তাদের এই ক্ষেত্রে নষ্ট হবার পরিমাণ অন্যান্য দেশগুলোর থেকে কম স্বাভাবিকভাবেই।
খরা, বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় পোকামাকড় কিংবা অণুজীবের আক্রমণে ফসলের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অনুন্নত দেশে সঠিকভাবে ফসলের যত্ন নিতে না পারার কারণে উৎপাদন কম হতে পারে। পশুপাখির খামারেও বিভিন্ন সময় রোগ দেখা দেয়। ফলে খাদ্য নষ্ট হওয়া একেবারে খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু হয়। ফসল সঠিকভাবে উৎপাদন হলেও ভোক্তা পর্যন্ত যাবার জন্য স্বল্পস্থায়ী কিংবা দীর্ঘস্থায়ী মজুদ করতে হয়। সঠিক উপায়ে মজুদ না করার কারণেই প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। এরপরে রয়েছে পরিবহনের সময় খাবার নষ্ট হওয়া। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে খাবার নষ্ট হয়, পরিবহনের জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুত না করায় গরমে বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় কাঁচা ফল বা সবজি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাছ-মাংস পরিবহন করা গাড়ির রেফ্রিজারেটর নষ্ট হয়ে মাছ-মাংস নষ্ট হতে পারে।
উৎপাদন পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা পরিবহন দুর্ঘটনার কারণে নষ্ট হলেও ভোক্তাদের হাতেও খাবার কম অপচয় হয় না। উন্নত দেশে অনেকেই খাবারের রঙ বা আকার একটু অন্যরকম হলেই আর কিনে না! ফলে একটু বেখাপ্পা দেখতে সবজি বা ফলগুলো শেষপর্যন্ত ময়লার ঝুড়িতেই যায়। আবার অনেকে বাসায় অতিরিক্ত খাবার কিনে রেখে দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো না খেয়ে ফেলে দেয়। দাওয়াত কিংবা রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত খাবার নিয়ে না খাওয়া তো আজকাল খুবই সাধারণ কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্যাকেটজাত খাবার কিনে মেয়াদ কতদিন আছে খেয়াল না করায় মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ফেলে দিতে হয়। আমাদের বাসা বাড়িতেই আমরা না খাওয়া যে খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলি সেটি আমাদের দৃষ্টিতে অনেক কম মনে হলেও সামগ্রিকভাবে এভাবে প্রচুর পরিমাণে খাবার অপচয় করছি আমরা সবাই, প্রায় প্রতিদিনই!
খাদ্য উৎপাদন আর ভোক্তার মাঝামাঝি পর্যায়েও অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়। হঠাৎ করে কোনো ফসলের দাম বেড়ে গেলে সেটি অনেক সময় বিক্রি কমে যায়। ফল বা সবজি যেহেতু পচনশীল, তাই এরকম পরিস্থিতিতে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়। আবার ফসলের দাম কমে গেলেও অনেক সময় কৃষকরা প্রতিবাদস্বরূপ ফসল নষ্ট করে। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় ফসলের দাম কমে গেলে কৃষকরা রাস্তায় ফসল ফেলে প্রতিবাদ করেন। আবার অনেক বড় বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি তাদের কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুঁতে হয়। এতে দেখা যায় তারা একজন কৃষকের উৎপাদিত সব ফসল না নিয়ে কিছু অংশ নেয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনগুলোতে প্রায়ই বলতে শোনা যায় “বিশেষভাবে বাছাইকৃত … দিয়ে তৈরি’’। এই বিশেষভাবে বাছাইয়ের পর বেঁচে যাওয়া ফসল বা ফলগুলোর বেশিরভাগই নষ্ট হয়। আর এভাবেই উৎপাদন পর্যায়ে বা ভোক্তার দ্বারা খাবার নষ্ট বা অপচয় না হয়েও খাবার নষ্ট হচ্ছে।
খাবার অপচয়ের কিছু পরিসংখ্যান
খাবার অপচয় সবচেয়ে বেশি হয় উৎপাদন পর্যায়ে, সেটি পৃথিবীর সব অঞ্চলেই। তবে গ্রাহক পর্যায়ে অপচয় ধনী ও উন্নত দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি। FAO এর তথ্য অনুসারে, শিল্পোন্নত দেশগুলো অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ খাবার নষ্ট ও অপচয় করে। আর সব অঞ্চলেই নষ্ট খাবারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফল আর শাকসবজি। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ধনী দেশগুলোতে প্রতিবছর যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয় সাব-সাহারা অঞ্চলের মোট খাদ্য উৎপাদন প্রায় একই পরিমাণ! ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ জনপ্রতি যে খাবার নষ্ট ও অপচয় হয় তা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার জনপ্রতি খাবার নষ্টের প্রায় ১০ গুণ বেশি! সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে অর্থের সাথে সাথে খাবার নষ্ট ও অপচয়ের পরিমাণও বাড়তে থাকে।
খাদ্য অপচয় রোধে আমাদের করণীয়
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগ-জীবানুতে নষ্ট হওয়া কিংবা পরিবহনের সময় নষ্ট হওয়া খাবারের ব্যাপারে আমরা ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি কিছু করতে না পারলেও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের খাবারের অপচয় কিন্তু আমরা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
- শুরুটা বাজার করা দিয়েই করা যাক। অনেকেই বাজারে গেলেই একগাদা বাজার করে বাসায় ফেরেন, অথচ এত খাবার কেনার কিন্তু কোনো দরকারই ছিল না। এতে দেখা যায় সপ্তাহ শেষে কিছু খাবার ফ্রিজেই নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট হবার পথে। সুতরাং বাজার করার সময় অতিরিক্ত বাজার করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
- অনেক সময় বাজার পরিমিত পরিমাণে করলেও সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোন খাবার কোথায়, কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় এ ব্যাপারে জ্ঞান থাকাটাও জরুরি। যেমন- আলু, পেঁয়াজ খোলা জায়গায় রাখলে কিংবা শাক-সবজি ফ্রিজে বায়ুরোধক ব্যাগে রাখলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
- এরপর রয়েছে রান্না করা খাবার নষ্ট করা। আমরা কে কতটুকু খাবার খেতে পারি এ ব্যাপারে সবারই ধারণা আছে। কিন্তু তারপরেও ‘চোখের ক্ষুধা’ মেটানোর জন্য আমরা অতিরিক্ত খাবার প্লেটে নেই যার অনেকটাই শেষে নষ্ট হয়। এটি সবচেয়ে বেশি হয় বিয়ে বাড়ি কিংবা দাওয়াতে। অনেকে তো দাওয়াতে অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেতে বসেন। এতে খাবার যেমন অপচয় হয়, নিজের স্বাস্থ্যেরও কিন্তু ক্ষতি হয়। অতিরিক্ত এবং অকারণে খাবার কারণে আজকাল খুব অল্প বয়সেই অনেকের হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। তাই খাবার সময় আমরা যতটুকু খেতে পারব ততটুকুই নেয়া উচিত। প্রথমেই অনেকগুলো না নিয়ে অল্প অল্প করে নিয়েও অনেক বেশি খাওয়া যায়- খেতে বসে এ কথাটি মাথায় রাখলেই খাবারের অপচয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
- প্যাকেটজাত খাবার কেনার ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া উচিত। পাউরুটির মতো স্বল্পমেয়াদী খাবার কেনার সময় অবশ্যই মেয়াদ কতদিন বাকি আছে দেখে কেনা উচিত। সেই সাথে এই মেয়াদের ভেতরে খাবারটি পুরোটি শেষ করা সম্ভব হবে কি না সেটিও মাথায় রাখা উচিত। যদি এমন হয় যে মেয়াদ শেষ হলেও রান্না করে বা অন্য কোনো উপায়ে সংরক্ষণ করা যায় তাহলে সেই ব্যবস্থাও নেয়া উচিত।
- বিয়ে বা দাওয়াতের বেঁচে যাওয়া খাবার এতিমখানা বা পথশিশুদের দিয়ে দেয়া যায়। বর্তমানে বেশ কিছু সংগঠন আছে যারা এ রকম বেঁচে যাওয়া খাবার সংগ্রহ করে।
- নষ্ট হয়ে যাওয়া সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আজকাল অনেকেই বাসায় ফুল কিংবা সবজি চাষ করেন। কোনো খাবার ফেলে না দিয়ে সেটি দিয়ে কম্পোজিট সার বানিয়ে সহজেই গাছে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে খাবার নষ্ট হলেও অন্য কাজে ঠিকই লাগলো আবার গাছের যত্ন নেয়ার জন্য আলাদা খরচও করতে হলো না।
খাবারের অপচয় বন্ধ করা জরুরি কেন
শুধুমাত্র গরীবেরা খাবার পাচ্ছে না তাই খাবার অপচয় বন্ধ করা বা কমানো দরকার এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খাবার অপচয় শুধু খাবারের অপচয় না, একই সাথে অর্থ, শ্রম, শক্তির অপচয়। ফসল ফলানো থেকে খাবার কেনা পর্যন্ত প্রচুর মানুষ জড়িত। এতে তারা তাদের অর্থ দেন, শ্রম দেন। কিন্তু তাদের দেয়া অর্থ আর শ্রমের খাবার যদি নষ্ট হয় তাহলে সেই অর্থ আর শ্রমও নষ্টই হয় শেষ পর্যন্ত। ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ পরিবহন, ট্রাক্টর কিংবা ফসল পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে খাবার প্রক্রিয়াজাত কারখানা থেকে নিঃসরিত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রীনহাউস গ্যাস। রান্না করা খাবার তৈরিতেও কিন্তু জ্বালানী ও পানির প্রয়োজন হয়। খাবার যদি নষ্টই হয় শেষ পর্যন্ত তাহলে একই সাথে প্রচুর জ্বালানী নষ্ট হচ্ছে আর সাথে বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাস। আবার অন্যদিকে খাবার সাথে পানিরও অপচয় হচ্ছে। ফলে একদিকে খাবার যেমন নষ্ট হলো, পরিবেশেরও ক্ষতি হলো। খাবার নষ্ট না হলে অন্তত একদিক থেকে তো লাভ ছিল! সবদিক বিবেচনা করলে খাবার নষ্ট বা অপচয় হলে শুধু খাবারই নষ্ট হয় এমন না, বরং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও যুক্ত হয়।
পৃথিবীতে প্রচুর মানুষ খাবার না পেয়ে মারা যাচ্ছে, অথচ এরপরেও প্রতিদিন খাবার নষ্ট হচ্ছে। আবার সমন্বয়হীনতা, সদিচ্ছা, দুর্নীতির কারণে উৎপাদিত খাবারও সবার কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।উৎপাদন পর্যায়ের কথা বাদ দিলেও ভোক্তা পর্যায়ে যে পরিমাণ অপচয় হয় তা দিয়েও অনেক পরিবারের সারা বছরের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে অন্তত নিজেদের সংশোধিত করতেই পারি। এতে হয়তো দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের মানুষেরা সরাসরি খাবার পাবে না, কিন্তু নিজের লাভটাও কম হবে না। নিজের খাবার নষ্ট করা মানে নিজের কষ্টার্জিত টাকারই অপচয়। তাই খাবার অপচয় রোধে সবারই সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।