‘রাগ’ আমাদের অন্যান্য আর সব অনুভূতিগুলোর মতোই স্বাভাবিক একটি আচরণ। তবে অতিরিক্ত রাগ, বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যে সামান্য কারণেই অতিরিক্ত রেগে যাওয়ার প্রবণতা স্বাভাবিক নয়। একজন সচেতন বাবা-মা হিসেবে আপনার সন্তানের মধ্যে যদি অতিরিক্ত রেগে যাওয়ার প্রবণতা দেখতে পান, তাহলে সন্তানের এই আচরণকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। সাধারণত বাচ্চাদের মন প্রাপ্ত বয়স্কদের থেকে নরম এবং কোমল হয়ে থাকে, তাই যদি লক্ষ্য করে থাকেন আপনার বাচ্চা প্রায় সময়ই বিরক্ত এবং রাগান্বিত থাকছে, তাহলে বুঝে নিতে হবে সে কোনো কারণে হীনমন্যতায় ভুগছে অথবা সে পর্যাপ্ত ভালোবাসা ও মনোযোগ পাচ্ছে না, যেটা তার প্রাপ্য।
আপনার বাচ্চার এই মাত্রাতিরিক্ত রাগের বিপরীতে আপনিও যদি তাকে রাগ দেখিয়ে শাসন করতে যান, তাহলে হিতে বিপরীত হবে। তাই বাচ্চার এই অনাকাংক্ষিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে আপনাকে জানতে হবে, কেন আপনার বাচ্চা এত রেগে যাচ্ছে আর কী করেই বা আপনি তার এই অতিরিক্ত রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
বাচ্চার অতিরিক্ত রাগের কারণ
আপনার আদরের সন্তানের অতিরিক্ত রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সবার আগে আপনাকে জানতে হবে বাচ্চার এই আচরণের জন্য সম্ভাব্য দায়ী কারণ সম্পর্কে। বাচ্চার উপর মিথ্যা অভিযোগ, অন্যায় আচরণ, অসুরক্ষিত পরিবেশ, বাচ্চাকে ভুল বোঝা এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনাকাংক্ষিত আচরণ ইত্যাদি কারণগুলো বাচ্চাদের মনে ক্রোধের জন্ম দেয়। শুধু এগুলোই নয়, বাচ্চার উপর শারীরিক নির্যাতনও বাচ্চার মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে যা ক্রোধে রূপান্তরিত হয়। শুধু বাবা-মা বা পরিবারই নয়, আপনার বাচ্চার খেলার সাথীদের আচরণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশও অনেকখানি প্রভাব রাখতে বাচ্চার এই আচরণে।
এজন্যই যদি সন্তানের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাগ বা ক্রোধ দেখতে পান, তাহলে সন্তানের প্রতি আপনার নিজের এবং পরিবারের আচরণ কেমন তা খুঁটিয়ে দেখার সাথে সাথে বাচ্চার খেলার সাথী ও স্কুলের পরিবেশ নিয়েও খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
নিজেকে দিয়ে শুরু করুন
আপনার যদি বাচ্চাদের সাথে চিৎকার করে কথা বলার অভ্যাস থাকে, তাহলে আপনি নিজেই আপনার বাচ্চার জন্য রোল মডেলের ভূমিকা পালন করছেন। সব সময় নিজেকে শান্ত রেখে বাচ্চাদের সাথে কথা বলা কঠিন, এটা যেমন সত্যি; ঠিক তেমনি আপনি নিজে যদি রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারেন, তাহলে আপনার বাচ্চার কাছ থেকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারার আশা করা নিরর্থক। আপনার সন্তান আপনাকে দেখেই শিখবে কী করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
যেকোনো পরিস্থিতে নিজেকে শান্ত রাখা, কীভাবে এবং কোন পরিস্থিতে আপনি রাগ বা ক্রোধ প্রকাশ করছেন, এগুলো দেখেই আপনার সন্তান নিজেকে তৈরি করবে।
বাচ্চা রেগে গেলে আপনি শান্ত থাকুন
আপনার বাচ্চা যখন হুট করে রেগে যায় বা কোনো কারণে সে অনেক বেশি জেদি হয়ে ওঠে, তখন আপনি বাচ্চার তালে তাল মিলিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে যাবেন না। রেগে যাওয়া বাচ্চাদের সাথে যদি আপনিও সমান রাগ দেখিয়ে তাকে কিছু বোঝাতে চান, তাহলে ব্যাপারটি আগুনে ঘি ঢালার পর্যায়ে চলে যাবে।
এমন পরিস্থিতিতে যতটা পারা যায় শান্ত থাকুন, আপনার বাচ্চাকে বলতে দিন সে কী বোঝাতে চাচ্ছে। বাচ্চা যখন কিছুটা স্থির হবে, তাকে কাছে নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন। মনে রাখবেন, আপনি তখনই কোনো কিছু নিয়ে আপনার বাচ্চাকে বোঝাতে সক্ষম হবেন, যখন তারা শান্ত থাকে। আর আপনার কাজই হচ্ছে বাচ্চাকে শান্ত করা, আরও বেশি রাগিয়ে তোলা নয়।
বাচ্চার মানসিক সচেতনতা বাড়ান
আপনি আপনার সন্তানকে কঠিন অনুভূতিগুলো কীভাবে খুব সহজে প্রকাশ করতে হয়, সে সম্পর্কে উৎসাহিত করুন। কারণ, যত সে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবে, তার মধ্যে তত রাগ, ক্ষোভ ও ক্রোধ এই ধরনের অনুভূতিগুলোর বিস্ফোরণ কমতে থাকবে।
সঠিকভাবে বাচ্চাদের তাদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে উৎসাহিত করার জন্য আপনাকে তাদের সাথে রাগ, অভিমান ও অন্যান্য অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, প্রত্যেকটি অনুভূতি একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। লক্ষ্য করলে দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চারা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে আবার অনেক সময় অনেক বেশি জেদ দেখিয়ে ফেলে।
বাচ্চাকে রাগ ও আক্রমণাত্মক আচরণ এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে বলুন
আপনার সন্তানকে জানতে হবে, রাগ ঠিক আছে, কিন্তু অতিরিক্ত রাগ বা আক্রমণাত্মক আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আপনার বাচ্চা যখন কোনো আক্রমণাত্মক আচরণ করে, তখন তাকে কাছে নিয়ে বলুন, সে যা করেছে সেটা কোনোভাবেই সঠিক কোনো আচরণ নয়। মাথায় রাখুন, বাচ্চার সাথে কথা বলার সময় চাপা বিরক্তি ভাব রাখুন কথার মধ্যে, যাতে সে বুঝতে পারে সে যা করেছে সেটা সত্যিই কোনো ভালো কাজ নয়। তবে ভুলেও যেন আপনার বোঝানোর মধ্যে অতি মাত্রায় বিরক্তি বা অবজ্ঞা প্রকাশ না পায়।
যদি আপনার সন্তানের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বন্ধ হয়ে যেতে দেখেন, তাহলে বাচ্চাকে তার এই অর্জনের জন্য বাহবা দিন। আর যদি আপনার সমস্ত চেষ্টার পরেও আপনার সন্তানের মধ্যে কোনো ধরনের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য না করেন, তাহলে অভিজ্ঞ কারও পরামর্শ অথবা সাহায্য নিতে দেরি করবেন না।
বাচ্চাকে তার নিজের উপর ছেড়ে না দিয়ে বরং তার পাশে থাকুন
একজন সচেতন বাবা-মা হিসেবে আপনার দায়িত্বই হচ্ছে আপনার সন্তানের পাশে দাঁড়ানো যখন সে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। অনেক অভিভাবককেই দেখা যায় বাচ্চার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, অতিরিক্ত রাগ অথবা জেদ ও বাজে অভ্যাস দেখেও খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলতে থাকেন যে, ‘বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’। হ্যাঁ, এটি সত্যি যে অনেক বাচ্চাই বয়সের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তন করতে শিখে যায়, তবে এর উল্টো ঘটনা যে ঘটে না, এমনটা কিন্তু নয়।
তাই সন্তানের সঠিক মানসিক আচরণ সময়ের উপর ছেড়ে না দিয়ে নিজের হাতে তুলে নিন। আপনি আপনার বাচ্চাকে ভালোবেসে বা বুঝিয়ে যেটা শেখাতে পারবেন, সেটা সময় অথবা অন্য কারও পক্ষে অসম্ভব।
বাচ্চাকে মারধোর করে কিছু শেখাতে যাবেন না
বাচ্চার অতিরিক্ত রাগ বা জেদ কমাতে গিয়ে আপনি হরহামেশাই বাচ্চাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে থাকেন, আর দেখা যায় মার খেয়ে আপনার সন্তানও দ্বিতীয়বার আপনার সামনে এই ধরনের আচরণ করা থেকে বিরত থাকছে। মনে রাখুন, আপনার এই মারধোর করে বাচ্চাকে শাসনে রাখার পদ্ধতির কার্যকারিতা কিন্তু সাময়িক। পরবর্তীতে হয়তো আপনাকে এর জন্য চড়া মাশুল দিতে হতে পারে। মেরে ভয় দেখিয়ে আর যা-ই হোক, বাচ্চাকে সুস্থ ও সুন্দর মনের মানুষ করে তুলতে পারবেন না। সে এটা জেনে বড় হতে থাকবে যে, গায়ে হাত তোলা খুব সামান্য একটা ব্যাপার, আর ভবিষ্যতে সে নিজেও এই পন্থাই অবলম্বন করবে।
অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলার ফলে তাদের রাগ আরও বেড়ে যায়। মনে রাখবেন, আপনি যদি গায়ে হাত তুলে আপনার বাচ্চাকে শাসন করতে শুরু করেন, তাহলে যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি তাকে কেবল আগ্রাসনের শিক্ষাই দিচ্ছেন।
সময় নিন
আমরা কোনো ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে বা নিজেদের মধ্যে কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা হলে কী করি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা করি তা হলো, সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেই অথবা নিজেকে স্থির করে মাথা ঠাণ্ডা করে তারপর সে বিষয়ে কথা বলি বা সিদ্ধান্ত নেই। সেই একই পদ্ধতি আমরা কিন্তু আমাদের সন্তানের বেলায় অবলম্বন করতে পারি। আপনার বাচ্চা অনেক রাগারাগি করছে বা জেদ করছে, এমনটা কিন্তু নয় যে, আপনাকে তখনই তাকে ভালো মন্দের তফাৎ বোঝাতে হবে। নিজে সময় নিন এবং আপনার সন্তানকে স্থির হতে সময় দিন। এরপর সময় বুঝে বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলুন, তার কী করা উচিৎ আর কী করা উচিৎ নয়। এতে করে যা হবে, আপনার সন্তান ঠিকভাবে বুঝতে পারবে যে, কী করে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় আর আপনিও তাকে সঠিক আত্মনিয়ন্ত্রণ কৌশল সম্পর্কে বলতে পারবেন, যেটা রাগান্বিত অবস্থায় বলা অসম্ভব ছিল।
আপনার সন্তানের রাগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার প্রয়োজন হলে আপনি কীভাবে বুঝবেন?
আপনার সুবিধার্থে কিছু লক্ষণ এখানে দেওয়া হল:
- বাচ্চা তার আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং খেলার সাথী বা ভাইবোনদের মারধোর করে।
- বাচ্চা অনেক বেশি প্রতিশোধপরায়ণ স্বভাবের হয়ে থাকে।
- ক্রোধবশত বাচ্চা নিজে নিজেকে আঘাত করে।
- খুব সামান্য কারণে প্রতিনিয়ত জিনিসপত্র ভাঙচুর করে।
- আপনার বাচ্চা অন্যান্য বাচ্চা ও প্রাণীদের আঘাত করে
- আপনার সন্তান নিজের প্রতি ও অন্যান্য মানুষের প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণ করে।
- রেগে গেলেই খারাপ ভাষা ব্যবহার করে।
- অন্যান্য বাচ্চারা আপনার বাচ্চার সাথে খেলতে বা মিশতে পছন্দ করে না।