বায়ুদূষণ শব্দটি শুনলেই আমাদের সবার চোখের সামনে হয়তো কিছু গতানুগতিক ছবিই ভেসে ওঠে। ধূলায় আচ্ছন্ন, যানবাহন আর কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় আবৃত গাছপালাবিহীন কোনো শহুরে রাস্তার কথা মনে পড়ে। কিন্তু শুধু কি বাইরের বাতাসই দূষিত হয়? বাইরের দূষিত পরিবেশ থেকে এসে যে ঘরে আমরা প্রশান্তি খুঁজি, সেখানকার বাতাস কি সম্পূর্ণ পরিশুদ্ধ? তা কিন্তু নয়! ঘরের ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মাধ্যমেই ভেতরের বাতাস হয়ে উঠতে পারে দূষিত, ক্ষতি হতে পারে আমাদের শরীরের।
ঘরের ভেতরের বাতাস দূষিত হবার কারণ
ধূলো-ময়লা
প্রতিবার আমরা বাইরে থেকে ফেরার সময় কিছু পরিমাণ ধূলো নিয়েই ঘরে প্রবেশ করি। বাইরের ধূলো, মাটি, আবর্জনা, এমনকি ত্বকের ঝরে পড়া মৃত কোষও ঘরের ভেতরের বাতাস দূষিত করে।
সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক
কোনো ধূমপায়ী ব্যক্তি তামাক সেবনের সময় যে ধোঁয়া তৈরি হয়, তার আশেপাশে থাকা অধূমপায়ীরাও অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই ধোঁয়া নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে ফেলেন। এ ধরনের ধোঁয়াকে সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক বলা হয়।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, তামাক সেবন ধূমপায়ী ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ক্ষতি তো করেই, সঙ্গে তার আশেপাশে থাকা অধূমপায়ীরাও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানো জীবাণু
যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কাশি, হাম, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি রোগের জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে বাহিত হয়।
ছত্রাক
ঘরের ভেতর আর্দ্রতা বেশি হলে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক জন্মাতে দেখা যায়। এদের মধ্যে কোনোটি নিরীহ প্রকৃতির, আবার কোনোটি খুব বিপজ্জনক হতে পারে।
উদ্বায়ী জৈবরাসায়নিক পদার্থ (Volatile organic compound-VOC)
কার্পেট, কাপড়, পার্টিকেল বোর্ডের তৈরি আসবাবপত্র, দেয়ালে ব্যবহৃত রং, এয়ার ফ্রেশনার, ঘর পরিস্কারের কাজে ব্যবহার্য কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত পরিস্কারক থেকে VOC নির্গত হতে পারে।
কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড
জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে শুরু করে ওয়াটার হিটার, গ্যাস স্টোভ থেকে কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।
সীসা
এটি অত্যন্ত বিষাক্ত একটি ধাতু। সাধারণত পুরনো দিনের বাড়ির দেয়ালে ব্যবহৃত রঙে সীসা থাকে। আরও যেসব উপাদান ঘরের ভেতরের বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর করে তোলে, তার মধ্যে রয়েছে- ফুলের পরাগরেণু, পোষা প্রাণীর শরীর থেকে ঝরে পড়া লোম বা পালক ইত্যাদি।
দূষণকারী পদার্থের শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব
সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক
ধূমপানের ফলে ধূমপায়ী ব্যক্তির শ্বসনতন্ত্রের নানাবিধ জটিলতা, মুখের ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। অধূমপায়ীরা অল্প সময় এই ধোঁয়ার মধ্যে থাকলে চোখ, নাক ও গলায় জ্বালাপোড়া অনুভব করতে পারেন।
দীর্ঘদিন এই ধোঁয়ার মাঝে থাকলে এটি সরাসরি ধূমপানের মতোই ক্ষতি করে। দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো মারাত্মক সব রোগ। যাদের হাঁপানির সমস্যা আছে, এই ধোঁয়ার কারণে তাদের হাঁপানি শুরু হতে পারে।
শিশুদের কান ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, হাঁপানি ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক।
কার্বন মনোক্সাইড (CO)
এই গ্যাস শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হতে বাধা দেয়। ফলে ক্লান্তিবোধ হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া- এসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2)
এটি চোখ, নাক, গলা ও শ্বাসতন্ত্রে জ্বালাপোড়া করে থাকে। এই গ্যাস শরীরে অল্প পরিমাণে প্রবেশ করলে শিশু, হাঁপানি রোগী ও ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। মধ্যম পরিমাণে প্রবেশ করলে এটি ব্রংকাইটিস সৃষ্টি করতে পারে।
সীসা
শরীরে সীসা প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি এবং রক্তের লোহিত কণিকার ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া, আইকিউ কম হওয়া, আচরণগত সমস্যা, দৈহিক বৃদ্ধির গতি ধীর হওয়া- এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
উদ্বায়ী জৈবরাসায়নিক পদার্থ (VOC)
এটির সংস্পর্শে আসার সাথে সাথেই চোখ ও শ্বাসতন্ত্রে জ্বালাপোড়া, মাথা ব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখে দেখতে অসুবিধা হওয়া- এসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী (প্রায় ছয় বছর) সংস্পর্শের ফলে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ছত্রাক
এটি কারো কারো শরীরে অ্যালার্জি করতে পারে। এর লক্ষণ হিসেবে নাক বন্ধ ভাব, চোখ, গলার ভেতর ও চামড়ায় চুলকানি, ফুলে যাওয়া, কাশি, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, মাথা ব্যথা দেখা দিতে পারে।
ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ রোধে করণীয়
- ঘরের জানালা খোলা রাখলে ভেতরে জমা হওয়া বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বেরিয়ে যেতে পারে। স্যাঁতসেঁতে ভাব দূর হয়ে ঘরে সতেজতা ফিরে আসে। তাই ঘরের জানালা খোলা রেখে ভেতরে আলো বাতাস চলাচল করতে দেওয়া উচিত।
- HEPA (High Efficiency Particulate Arresting) ফিল্টারযুক্ত এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করা।
- ঘরের মেঝে পরিস্কার রাখুন। প্রয়োজনে এ কাজে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করুন। শক্তিশালী সাকশন ক্ষমতাসম্পন্ন ব্রাশ ও HEPA ফিল্টারযুক্ত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এ কাজের জন্য আদর্শ।
- ধূমপান সব বয়সে, সব পরিবেশেই ক্ষতিকর। তাই নিজের ও আশেপাশের মানুষের সুস্থতার কথা মাথায় রেখে ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
- ঘর পরিস্কারের জন্যে কৃত্রিম সুগন্ধিবিহীন, মৃদু ধরনের পরিস্কারক ব্যবহার করতে হবে। প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি (যেমন- লেবু, বেকিং সোডা, ভিনেগার, বোরাক্স, এসেনসিয়াল অয়েল) ব্যবহার করে ঘর পরিস্কার রাখাকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।
- ঘরে পোকামাকড়ের আনাগোনা ঠেকানোর জন্যে ময়লা ফেলার ঝুড়ি সবসময় ঢেকে রাখতে হবে।
- গ্যাসের চুলোর সাথে কিচেন হুড ব্যবহার করতে পারলে ভাল। তা সম্ভব না হলে অন্তত চুলোর আশেপাশে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- বাইরে জুতো খুলে রেখে, দরজার সামনে রাখা পাপোসে পা মুছে ঘরে প্রবেশ করতে হবে।
- আসবাবপত্রের উপরিভাগ নিয়মিত ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে।
- বিছানা, বালিস, তোশক প্রতি সপ্তাহে গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
- মানিপ্ল্যান্ট, পিস লিলি, ব্যাম্বু পাম, ইংলিশ আইভি, ফার্ন, স্পাইডার প্ল্যান্ট, অ্যালো ভেরা বা ঘৃতকুমারী- এসব গাছ সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বাতাসকেও পরিশুদ্ধ করে।
- রং, আঠা নিয়ে কাজ করতে হলে বদ্ধ ঘরে না করে বাতাস চলাচল করে এমন জায়গায় বসে ব্যবহার করা উচিত।
- ঘরে এয়ার ফ্রেশনারের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে।
- পারতপক্ষে কার্পেট ব্যবহার না করাই ভাল।
- বাড়ির সব ক’টি এগজস্ট ফ্যান ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ঘর ছত্রাকমুক্ত রাখার উপায়
- রান্না, বাসনকোসন ও কাপড় ধোয়া, গোসল- এসব কাজের সময়ে এগজস্ট ফ্যান চালু রাখা বা জানালা খোলা রাখা।
- ঘরে গাছ থাকলে তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি না দেওয়া।
- পানির সংযোগে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সারানো।
- এয়ার কন্ডিশনার ও ডিহিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা।