“দুঃখটাকে দিলাম ছুটি, আসবে না ফিরে…”
গানের এই লাইনটির মতো কি আমরাও বিষণ্ণতাকে ছুটি জানাতে পারি না? হ্যাঁ, অবশ্যই পারি। যদি বলি, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পেতে প্রকৃতির সাথে কিছুটা সময় কাটানোর কোনো বিকল্প নেই। কথাটা যদি মানতেই না চান তাহলে বলুন তো, আপনি যখন বেড়াতে যান পাহাড়ের কোলে বা সাগরের গর্জনের মাঝে অথবা ঘন সবুজ অরণ্যে, তবে কেন আপনার মন ভালো হয়ে যায়? এই ব্যাখ্যা কি আছে আপনার কাছে?
আসলে কী জানেন, বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির দৌড়ের মাঝে আমরা কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপে অসম্ভব ব্যস্ত থাকি। এর মাঝে আমাদের মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি বেশিরভাগ সময়েই আমাদের দৈনন্দিন নানা জটিলতায় ফেলে দেয়। তার ওপর একঘেঁয়ে জীবন আমাদের মনোজগতকে করে তোলে দুর্বিষহ।
আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা সামান্য মানসিক চাপে একেবারেই ভেঙে পড়েন। আবার সামান্য অসুস্থতায় ওষুধ বা ডাক্তারের দ্বারস্থ না হলেই যেন রোগমুক্তি সম্ভব হয়ে উঠে না। এমন মানুষের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়, যাদের সমস্যা থেকে যায় সমস্যার আড়ালেই, সমাধানের পথ আর বেরোয় না।
কিন্তু আমরা কি জানি, এসবের সমাধান আছে আমাদের হাতেই। অনেকেই জানেন না, এক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদের কতটা উপকার করে থাকে। বলতে গেলে আমাদের শারীরিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যা সহ সকল কিছুর সমাধান দিতে পারে এই সবুজ শ্যামল প্রকৃতিই। এসব আমার যুক্তি নয়। গবেষকরা জানিয়েছেন, নিজেকে চাপমুক্ত রেখে ভাল থাকতে প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় কাটান প্রকৃতির নিবিড় ভালোবাসার হাতছানিতে। আসুন জানি, প্রকৃতি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করবে সে সম্পর্কে।
শর্টটার্ম মেমরি ইমপ্রুভমেন্ট
মিশিগান ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ কিছু মানুষের উপর জরিপ চালাতে তাদের দু’ভাগে ভাগ করে, একদলকে সবুজ ছায়ায় ঘেরা উদ্যানে আর আরেক দলকে সিটি স্ট্রিটে পাঠিয়ে দেন। যখন তারা ফিরে আসেন তখন তাদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, যারা সবুজের মাঝে ছিলেন, তাদের স্মৃতিশক্তি আগের তুলনায় ২০% উন্নতি করেছে। আর যারা ছিলেন সিটি স্ট্রিটে, তাদের কোনো রকম উন্নতিই হয়নি। সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রকৃতি মানুষকে তার স্মৃতিশক্তি ঝালিয়ে নিতেও অনেক সাহায্য করে থাকে।
মানসিক উন্নতি ও পুনর্গঠন
বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টিকে উল্লেখ করে থাকেন ‘Mental Fatigue’ নামে। গবেষকরা দেখেছেন, কোনো মানুষ যদি প্রকৃতির কোনো ছবির দিকেও মনোযোগ দেয়, তাহলেও তার স্মৃতি বা মেমরি কিছুটা রিফ্রেশ হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ছবি না হয়ে তা যদি হয় সত্যিকারের প্রকৃতি সান্নিধ্য, তাহলে তো কথাই নেই। (সূত্র: Journal of Environmental Psychology, 1995; Journal of Environmental Psychology, 2005; Psychological Science, 2012)
মানসিক চাপ কমায় এবং মনোযোগ বাড়ায় প্রকৃতি
বিশ্বাস হচ্ছে না তো কথাটি? তাহলে বলি, বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় প্রমাণ দিয়েছেন, চাপ ও বিষণ্ণতার মতো মানসিক ব্যাপারগুলোর সব চাইতে বড় ওষুধ হচ্ছে প্রকৃতির মাঝে কিছুটা সময় অতিবাহিত করা। গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী, মানসিক চাপগ্রস্থ ব্যক্তি চরম হতাশ মুহূর্তে মাত্র ১০ মিনিটের জন্যে হলেও যদি কোনো পার্ক বা খোলামেলা হাওয়াযুক্ত সবুজ পরিবেশের স্থান থেকে হেঁটে আসেন, তবে তার মানসিক দুরবস্থা কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও উপশম হয়। কারণ এতে মস্তিষ্কে তৈরি হয় কিছু ভালো লাগার হরমোন। এ হরমোন আপনাকে মানসিক চাপ উপশমে অসাধারণ কাজ দেবে। (সূত্র: Environment & Behavior, 1991; Journal of Environmental Psychology, 1995 (2); Journal of Attention Disorders, 2008)
মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সবুজে থাকুন
ডাচ গবেষকরা ২,৫০,৭৮২ জন লোকের উপর গবেষণা চালিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন যে, যারা শহরাঞ্চলে ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে দিনাতিপাত করেন তাদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষজন অধিক দীর্ঘায়ু এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা অধিক সবুজ আবহাওয়ায় থাকেন। তাদের মানসিক পীড়া তুলনামূলক হারে তাই কম থাকে। এটাই মূলত তাদের দীর্ঘায়ুর প্রধান কারণ।
ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় বাতলে দেবে প্রকৃতি
কঠিন অসুখ থেকে সেরে ওঠার নিমিত্তে অনেক সময় ডাক্তাররা পরামর্শ দেন যেন রোগী কোনো পছন্দসই স্থানে কিছু সময় কাটিয়ে আসেন। এ কথার পেছনে রয়েছে খুব সুন্দর যুক্তি এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল। জাপানের একদল গবেষক বিষয়টির উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ, সবুজ অরণ্য-ছায়া, পাখির কিচির-মিচির ইত্যাদি বিষয়গুলো এন্টি-ক্যান্সার প্রোটিনকে উদ্দীপিত করে থাকে। তাতে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা ক্যান্সার উপশম সত্যি সম্ভব। তাছাড়া, চেইন স্মোকাররাও তাদের অতিরিক্ত ধূমপানের অভ্যাস নিরাময়ে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সুযোগ থাকে বলে জানানো হয়েছে সেই গবেষণায়।
দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধিতে
তাইওয়ানের একদল গবেষক একটি স্কুলের শিশুদের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, স্কুলের ১২ বছরের মধ্যকার বেশিরভাগ শিশুই কঠিন মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। মায়োপিয়া হলো এমন এক ধরনের চোখের অসুখ, যেক্ষেত্রে শিশুরা ক্রমশ কাছের জিনিস কম দেখতে পাওয়া শুরু করে। তখন চশমার সাহায্য নিতেই হয়। ঐ গবেষকদল সে স্কুলের বাচ্চাদের স্কুলের বাইরের কার্যক্রম বাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। এক বছর পর তার ফলাফল দাঁড়ায়, মায়োপিয়া আক্রান্তের হার ১৭.৬৫% এ নেমে এসেছে যা কিনা ‘প্লে আউটসাইড স্কুল’গুলোতে ৮.৪১% হয়ে থাকে। বাচ্চারা স্কুলের বাইরে খেলাধুলা করলে বা বেড়াতে গেলে, বেশিরভাগ সময়েই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে। সুতরাং বাচ্চাদের সুস্থ স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।
অন্তর্দহন প্রতিরোধে সবুজের ছোঁয়া
ইনফ্ল্যামেশান বা অন্তর্দহন এমন এক স্বাভাবিক ঘাতক, যা কিনা ধীরে ধীরে আপনাকে হতাশার গভীরে তলিয়ে নিয়ে যাবে। এই সমস্যার একেবারেই শেষ পর্যায়ে অটোইমিউনো ডিজঅর্ডার, হাইপারটেনশন, ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদগ্রস্থতা, ক্ষুধামন্দা এমনকি মরণঘাতী ক্যান্সারের হাতছানিও এসে যেতে পারে আপনার সুন্দর জীবনে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এই সমস্যা থেকে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে বেশি বেশি প্রকৃতির সন্নিকটে থাকা। আর সেই প্রকৃতির মাঝে যদি থাকে সমুদ্র বা ঝর্ণাধারা, তবে তো একেবারে সোনায় সোহাগা বলতেই হয়। যাদের আবার দেহঘড়ি নিয়ম মেনে চলে না, অর্থাৎ যাদের রয়েছে অনিদ্রা সমস্যা, তা অনেকটা দূর করতে সহায়তা করে শুভ্র সকালের সূর্যের আলোক রশ্মি। নিয়মিত ভোরের শুভ্র আলো উপভোগ আমাদের শরীর আর মনের মাঝে একটি ‘বায়োলজিক্যাল ঘড়ি’ ঠিক করে দেয়, যা আমাদের শরীরকে সময় মেনে কাজ করার জন্য বার্তা পাঠায়। আপনি সকালে নির্দিষ্ট একটা নিয়ম মেনে ঘুম থেকে উঠলে খেয়াল করে দেখবেন, রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপনা-আপনিই ঘুম চলে আসবে। সে নিদ্রা সুখনিদ্রাই হবে বটে।
একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের করা অনলাইন সমীক্ষায় ৪,৪০০ জন অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা ভালো থাকার কারণ খুঁজতে মোট ১৩টি মেট্রিকস ব্যবহার করেছিলেন। সেসব মেট্রিকসের মাঝে অন্যতম ছিল, প্রকৃতির সাহচর্যে থাকা, আউটডোর গেমসে অংশগ্রহণ, সামাজিক কাজে যোগ দেয়া, সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতা ইত্যাদি। দেখা যায়, জীবনে সন্তুষ্টি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি এনে জীবনের গতি সচল রাখতে সেই ১৩টি মেট্রিকসের ১১টিই সরাসরি যুক্ত প্রকৃতির সাথে।
আরেক গবেষক কেলি বিডেনওয়েগ এনভায়রনমেন্টাল জার্নালে প্রকাশিত তার গবেষণালব্ধ ফলস্বরূপ জানান,
‘‘প্রকৃতির সাথে সংযোগ যত গভীর হবে বা যতটা বেশি সময় প্রকৃতির সঙ্গে কাটাতে পারবো, আমাদের ভাবনার স্বচ্ছতা, চিন্তার গভীরতা ও বোঝার ক্ষমতা ততই উন্নত হবে। এটা সামগ্রিকভাবে জীবনকে গ্রহণ করার ও উপভোগ করার মানসিকতা গড়ে তোলে।”
তাই যদি সুস্থ স্বাভাবিক আনন্দময় জীবন চান, বেশি বেশি সবুজ দেখুন, সবুজের মাঝে থাকুন আর মাঝে মাঝে হারিয়ে যান সবুজ প্রকৃতির নির্লিপ্ততায়।
ফিচার ছবিসূত্র: playbuzz.com