বাইরে দিনরাত রিমঝিম বৃষ্টি। ভুনা খিচুড়ি বেশ জমে ওঠে এই সময়। সবুজে শ্যামলে ছেয়ে যায় পৃথিবী। তাই বলে কি আপনার ত্বকের জন্যও সময়টা এতোটাই অনুকূল? বিশেষ করে এই জমে থাকা ময়লা পানি আর কাদামাটির সবটা ধকল যখন আপনার পায়ের ওপর দিয়ে যায়? বর্ষার আবহাওয়ার এই অত্যাচার সবচেয়ে বেশি সহ্য করে কে? আপনার ছাতাটা? সে বেচারা মাথার ওপরে না হয় একটু ভিজেই খালি, কিন্তু আপনার পায়ের কথা ভাবুন তো একবার। মুষলধারে আকাশের কান্না দেখে কোনো কাজই তো থেমে থাকে না, বাইরের জমে থাকা পানি দেখেও বন্ধ থাকে না অফিস কিংবা স্কুল-কলেজ। অগত্যা বেরুতেই হয় বাড়ি থেকে। আপনার কোমল পা দুটোর সৌন্দর্যের জন্য সে এক বিপদ সংকেত তো বটেই, অনেক সময় বাইরের ময়লা পানি সৃষ্টি করতে পারে ছত্রাক সংক্রামণের মতো ত্বকের অনেক সমস্যাও। তাই এই সময়টা সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য দুটোর জন্যই আমাদের পায়ের ত্বকের যত্ন নেয়া খুবই জরুরি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদেরকেও এ সময় পায়ের বেশি বেশি যত্ন নেয়ার জন্য বলা হয়।
পায়ের যত্নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় কোন বিষয়ের ওপর? পায়ের পরিচ্ছন্নতার ওপর। বাইরের কাদামাটি ও ময়লা পানি পার করে ঘরে ফিরে সবার আগে প্রয়োজন আপনার পা দুটো ভালো করে পরিষ্কার করা। কুসুম গরম পানি এক্ষেত্রে খুবই ভালো সমাধান। এটি আপনার পায়ে শুকিয়ে যাওয়া কাদাও পরিষ্কার করে আনবে। জীবাণু থেকে মুক্তি ও ইনফেকশন থেকে বাঁচার জন্য কোনো তরল অ্যান্টিসেপটিক মেশানো পানি বা সাবানও ব্যবহার করতে পারেন।
তবে প্রয়োজনমতো কুসুম গরম পানি, অল্প পরিমাণ শ্যাম্পু, লবণ আর কয়েক ফোঁটা লেবুর মিশ্রণ আপনার পা-কে দেবে বাড়তি যত্ন। উপাদানগুলো ভালোভাবে মিশিয়ে পা ডুবিয়ে রেখে দিতে হবে ১০-১৫ মিনিট। এরপর পায়ের বিশেষ ব্রাশ বা শক্ত কিছু দিয়ে ঘষে পায়ের মৃত চামড়া তুলে ফেললেই আপনার পায়ের কোমল রূপটি আপনারও সামনে এসে যাবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে পা ধুয়ে শুকনো নরম কাপড় বা তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলুন ভালোভাবে। পায়ের চামড়ার যত্ন আর পরিচ্ছন্নতা যেমন জরুরি, তেমনি দরকার পায়ের নখের যত্নও। বৃষ্টি আর কাদার এই সময়টা ছত্রাকজনিত সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য পায়ের নখ ছোট আর পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত।
নখের পাশাপাশি দরকার পায়ের আঙ্গুলগুলোরও যত্ন নেওয়া। আঙ্গুলগুলো যেন ভেজা বা স্যাঁতস্যাঁতে না থাকে, বিশেষ করে যদি ইতিপূর্বে আঙ্গুলের ফাঁকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ হয়ে থাকে বা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে। পায়ের শুষ্কভাব বজায় রাখতে ট্যালকম পাউডার খুবই কার্যকরী। একইসাথে পায়ে এই পাউডারের ব্যবহার ত্বককে যেমন শুষ্কতা দান করে, তেমনি পায়ের দুর্গন্ধ থেকেও দেয় মুক্তি। আর যদি কোনোভাবে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রামণ ঘটে যায়, তবে চিন্তার কিছু নেই। বাজারে এখন পাওয়া যায় অনেক ভালো, উন্নতমানের অ্যান্টিসেপটিক জেল। এটি রাতে ব্যবহার করাই ভালো, আর অবশ্যই যেকোনো ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আমাদের বেশভূষার উপরও নির্ভর করে আমাদের সুস্থতা। বিশেষ করে আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে হওয়া উচিত সচেতন। পায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তা-ই। বর্ষাকালে জুতা নির্বাচনেও চাই বিশেষ সতর্কতা। এই সময় অবশ্যই খোলামেলা জুতা নির্বাচন করা উচিত। বদ্ধ বা উঁচু জুতা পরিহার করে পানি, কাদা বের হয়ে যাবে এবং বাতাস চলাচল করবে এমন স্যান্ডেল বেছে নিন। সাথে প্রত্যেকবার ঘরে ফিরে ব্যবহারের স্যান্ডেল বা জুতা পরিষ্কার করে রাখতে পারলে তো আরো ভালো। আর এই আবহাওয়ায় মোজা ব্যবহার বাদ দেয়াটাই শ্রেয়।
এখন আসা যাক এ সময় পায়ের ত্বকের বিশেষ যত্ন নিয়ে। বারবার ধোয়ার ফলে পায়ের ত্বক এই সময় স্বাভাবিক কমনীয়তা আর আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে সহজেই। সাথে দ্রুত জমা হয় মৃত কোষ। তাই এই সময় পায়ের ত্বকের ময়েশ্চারাইজিং বেশ জরুরি। সাধারণ বডি লোশনও ব্যবহার করা যেতে পারে এক্ষেত্রে। এখন অবশ্য পায়ের জন্য বিশেষায়িত অনেকরকম ক্রিম আর লোশন পাওয়া যায় আলাদা আলাদা কোম্পানির। তবে কৃত্রিম এসকল প্রসাধনীর সাথে সাথে এখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক তেল। নারিকেল তেল, অলিভ অয়েলের ম্যাসাজ একইসাথে যেমন ফিরিয়ে আনে ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ও উজ্জ্বলতা, তেমনি ত্বক থেকে দূষণ আর বয়সের প্রভাব দূর করে একে করে তোলে আরো লাবণ্যময়। এক চা চামচ নারিকেল তেল আর এক চা চামচ অলিভ অয়েল ভালোভাবে মিশিয়ে দু’হা্তে নিয়ে প্রত্যেক পায়ে কিছু সময় ম্যাসাজ করতে হবে। এরপর পা-কে কিছুটা বিশ্রাম দিন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই তেল মালিশটি করা হয়।
সাবধানতা আর সচেতনতার পর আসা যাক পায়ের সৌন্দর্যের কথায়। পদ্মের মতো সুন্দর পা কে না চায়? গল্প, উপন্যাসে কিংবা রূপকথায় সুন্দর দুখানা পায়ের বারবার উল্লেখই বলে দেয় পায়ের সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণের কথা। সৌন্দর্য অবশ্যই যত্ন আর চর্চার বিষয়। মুখের ত্বকের মতো পায়ের ত্বকের সৌন্দর্যের জন্যও বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। বিশেষ করে বৃষ্টি আর কাদার এ সময়টাতে। কমলার খোসার গুঁড়া, দুধ আর মধুর মিশ্রণ ত্বকের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে বেশ উপকারী। উপাদানগুলো দিয়ে ভালোভাবে পেস্ট করে পায়ে লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে দিতে হবে শুকানোর জন্য। তারপর পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। পার্থক্যটা নিজেরই চোখে পড়বে। যেহেতু এ সময় বারবার ময়লা ও কাদামাটিতে পা ভরে যায়, তাই আগের মতোই সুন্দর আর আকর্ষণীয় রাখতে এরকম বিশেষ যত্ন তো অবশ্যই দরকার।
ঘরে থাকা সাধারণ বিভিন্ন উপাদান দিয়েও তৈরি করে ফেলতে পারেন চমৎকার সব ফুট মাস্ক। আর আকর্ষণীয় পায়ের জন্য ফুট মাস্ক দারুণ এক সমাধান। চার টেবিল চামচ মুলতানি মাটি, দুই চা চামচ ল্যাভেন্ডার বা জেসমিন তেল (অলিভ অয়েলও ব্যবহার করা যায়), অর্ধেক চা চামচ হলুদ গুঁড়ো আর এক টেবিল চামচ শুকনো নিম পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করতে পারেন মাস্কটি। পেস্টটি তৈরিতে ব্যবহার করতে হবে হালকা গরম পানি। পরিষ্কার শুকনো পায়ে মিশ্রণের প্রলেপ লাগিয়ে অপেক্ষা করতে হবে ২০-৩০ মিনিট। এরপর ধুয়ে ফেলে তোয়ালে দিয়ে পা ভালোভাবে মুছে অলিভ অয়েল মালিশ করুন। প্রথমবার ব্যবহারের পর থেকেই এর জাদুকরি ফলাফল দেখতে পাবেন।
এ সময় পায়ের যত্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৃত চামড়া অপসারণ। শুধু বর্ষাকাল নয়, সকল আবহাওয়াতেই কোমল আর লাবণ্যময় পায়ের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ পেডিকিওর এক্ষেত্রে একটা সহজ সমাধান। বিভিন্ন ধরনের স্পায়েরও বেশ প্রচলন দেখা যায় এখন। তার মধ্যে বর্ষাকালে পায়ের যত্নে ফিশ স্পা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দিন দিন, বিশেষ করে মৃত কোষ থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে। আর পায়ে কোনো আঘাত বা কাঁটাছেড়া থাকলে এই সময় বাইরে যথাসাধ্য কম বের হওয়া উচিত, যেহেতু এ সময় ত্বকের বিভিন্ন অসুখ খুব দ্রুত ছড়ায়। আর বের হলেও অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সুস্বাস্থ্যই সৌন্দর্যের মূল কথা। সুন্দর পা কেবল সুন্দর ত্বকের মাধ্যমেই আশা করা যায়। আর নারীর সুন্দর পা তার সৌন্দর্যে চিরকালই এক আলাদা মাত্রা যোগ করে এসেছে। সুস্বাস্থ্য আর সৌন্দর্যের সাধনাতেই তাই সকল আয়োজন।