মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু কিছু স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য থাকে। নিজেদের চরিত্রের মাঝে আমরা কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করতে চাই বা সময়ের সাথে বিয়োজনেরও প্রয়োজন হয়। কিছু স্বপ্ন থাকে ক্ষণিকের, আবার কিছু লক্ষ্য থাকে, যা কিনা অর্জন করতে হয় সুদীর্ঘ সময়ের আবর্তে। আমরা হয়তো আত্মবিশ্বাস, উষ্ণতা, দৃঢ়তা, সময়ানুবর্তিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি নানা গুণ নিজেদের মাঝে সঞ্চার করতে ইচ্ছুক।
কেউ পেশাগত জীবনে সাফল্যের জন্য হয়তো আকুল হয়ে আছে। সাফল্য, লক্ষ্য পূরণ, পেশাগত উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অজস্র কাজ হয়েছে। একটি সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত ব্যক্তিগত, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পেশাগত সাফল্যকে ব্যক্তির একক প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ফলাফল হিসেবেই বিবেচনা করে আসা হতো। এরপর গবেষকরা দেখলেন, একজন ব্যক্তির সাফল্যযাত্রায় তার সঙ্গী চমকপ্রদ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, এখানে সঙ্গী রোম্যান্টিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
স্বামী যদি নিরামিষাশী হতে চান, তাহলে টফুর প্রতি স্ত্রীর ইতিবাচক মনোভাব তাকে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। স্ত্রী যদি ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে চান, তাহলে স্বামীর প্রতি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে নতুন অভ্যাসের সাথে অভিযোজিত হতে উৎসাহিত করবে। আপাতদৃষ্টিতে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভ্যাসের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে চাইলে বলতে হয় যে, একজন ব্যক্তি নিজের বিচার-বিবেচনায় নিজের সবচেয়ে উন্নত, দক্ষ, চৌকস যে রূপটি দেখতে চান, তা অর্জনের ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। একজন ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষিত সত্ত্বা (true self) হয়ে ওঠার যাত্রায় তার স্বামী বা স্ত্রী বা জীবনসঙ্গীর এই অসাধারণ প্রভাব গবেষণার ভুবনে ‘মিকেল্যাঞ্জেলো প্রভাব’ বলে সুপরিচিত।
প্রায় ছয় মাসেরও অধিক সময় ধরে চলা করোনা মহামারির অন্যতম ইতিবাচক ফলাফল হিসেবে মিকেল্যাঞ্জেলো প্রভাবকে উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশে দেশে লকডাউন জারি থাকার দরুন মানুষের ব্যক্তিত্বে নানা ধরনের পরিবর্তন আসছে। এসব পরিবর্তনের মাঝে প্রণিধানযোগ্য একটি হচ্ছে- বৈবাহিক সঙ্গীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য কাছে পাওয়ার মাধ্যমে জীবনে তার শর্তহীন ভালোবাসা এবং উৎসাহের কারণে নিজের চরিত্রে পরম আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনগুলোর সুদৃঢ় সংযোজন। স্বাভাবিক জনজীবন স্থবির হয়ে গেল লকডাউনের কারণে, আর তখনই নানা ব্যস্ততা, কর্মক্ষেত্রের চাপ, বসের আদেশ, সহকর্মীদের নানান রাজনীতির একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর জীবন থেকে বিশাল একটা মুক্তি মিলে গেল।
বিবাহিত জীবনে তাই স্বামী-স্ত্রীরা নিজেদেরকে নিয়ে ভাবতে পারছে, ‘আমি’র পাশাপাশি ‘আমরা’ ধারণাটিকেও তারা প্রাধান্য দিচ্ছে, একসাথে বেশি সময়ও কাটাচ্ছে। এসবের ফলে তারা নিজেদের সম্পর্কে ধারণা, নিজেদের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ইত্যাদির সুস্পষ্ট এবং কার্যকরী মূল্যায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে। নিজেদের মধ্যকার সুদৃঢ় বন্ধন তাদের ব্যক্তিগত এবং যৌথ জীবন, উভয় ক্ষেত্রেই আশাব্যঞ্জক প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। সর্বোপরি, তাদের ব্যক্তিত্বে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে।
লকডাউনের কারণে যারা বাধ্য হয়ে একা থেকেছেন, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনটা ভিন্ন। বাধ্যতামূলকভাবে যারা এই লকডাউনের কারণে ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন চরম একাকিত্বে, তাদের মানসিক পরিবর্তনটা বেশ দুঃখজনক। বান্ধবহীন জীবন যদি কারও মাঝে একাকিত্বের জন্ম দেয় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, তার মাঝে অন্তর্মুখিতা বৃদ্ধি পাবে ধীরে ধীরে। নিউরোটিসিজম যাদের ব্যক্তিত্বের সজ্জা, তাদের এ চরিত্র আরও প্রকট হবে। অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ভয়, দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা, রাগ, হতাশা, হাহাকার ইত্যাদি নেতিবাচক অনুভূতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।
তবে এ ধরনের পরিবর্তন সকলের ক্ষেত্রে না-ও হতে পারে। একাকিত্ব কারও কারও ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফলও বয়ে আনতে পারে। কিছু গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ঘরবন্দী জীবন কাউকে কাউকে অধিক সহনশীলতার পথে পরিচালনা করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে আবেগানুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা জন্মায়। ডুরহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং রিডিং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত যৌথ এক গবেষণায় ৮০০ অংশগ্রহণকারীর উপর লকডাউনের প্রথম সপ্তাহের প্রভাব কীরকম, তা খতিয়ে দেখা হয়। একাকিত্ব এবং হতাশা ছিল এ গবেষণার দু’টি প্রধানতম বিষয়। গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করেননি। গবেষণা সম্পর্কে গবেষকদের একটি বিবৃতিতে বলা হয়,
ঘরবন্দী জীবন মানেই একাকিত্ব- বিষয়টি সবক্ষেত্রে এমন না-ও হতে পারে। নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের জন্য, নিজের মাঝে নতুন দক্ষতা বা গুণের সঞ্চার করার জন্য একাকিত্ব হতে পারে আদর্শ পরিবেশ। একাকিত্ব সবসময়ই মানসিক ক্ষতির জন্য দায়ী নয়, বরং উল্টোটাও সম্ভব।
প্রশ্ন আসতে পারে, এতটা দীর্ঘ সময়ের জন্য সাধারণ জীবন থেকে দূরে থেকেও ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সে অর্থে ততটা ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনকারী কেন নয়? ব্যক্তিত্বের ধারণাটিকে সাধারণত প্রকৃতিপ্রদত্ত বা সহজাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, ব্যক্তিত্ব সাধারণত অপরিবর্তনীয় বা চিরস্থায়ী- এমনটিই আমরা ভেবে থাকি। ব্যক্তিত্বের কিছু মৌলিক দিক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিরস্থায়ী হয়ে থাকে, তবে সামগ্রিক বিচারে ব্যক্তিত্বের কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়- এটি দাবি করা অত্যুক্তি হয়ে যাবে।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের কারণে নেটফ্লিক্স, প্রাইম ভিডিও ইত্যাদি বেশ কিছু তুমুল জনপ্রিয় স্ট্রিমিং সাইটের উদ্ভব হয়েছে। এসবের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় যেকোনো অঞ্চলে বসেই অন্য প্রান্তের চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক, প্রামাণ্যচিত্র উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল সেট টপ বক্সের কারণে এখন পরিবারের সদস্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শতাধিক চ্যানেল দেখতে পাচ্ছেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তো চ্যাট, পোস্ট, অডিও-ভিডিও কল বর্তমানে ডালভাত সকলের কাছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এ দিকটি থেকে ভেবে দেখলে লকডাউনের মাঝেও কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থেমে যায়নি একেবারে। যোগাযোগ, অনুভূতি আদান-প্রদান, কথাবার্তা ইত্যাদির ধরন হয়তো অনেকটা বদলে গেছে, তবে শেষ হয়ে যায়নি একেবারে। ঘরবন্দী জীবন কেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে চরম নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারেনি, তার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে গবেষকরা এ বিষয়ের প্রতিই আলোকপাত করেছেন; সামাজিকীকরণ হচ্ছে, তবে সরাসরি নয়, ভার্চুয়ালি।
তবে এই একাকিত্বের মাত্রাটিই যদি চরমে ওঠে, তখন অবশ্য ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন অত্যন্ত বাজে হয়। দু’টি গবেষণা থেকে এ কথাটির সত্যতা বোঝা সহজ হবে। অ্যান্টার্কটিক গবেষণা ঘাঁটিতে যারা বসবাস করেন, তাদের ওপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাদের দৈনন্দিন জীবনে তীব্র শীত আর অন্ধকারের উপস্থিতি এতটাই প্রকট যে এগুলো তাদের মানসিক নকশাকে বদলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী।
চরম পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তারা মানসিকভাবে অসম্ভব গুটিয়ে যায়, যেটিকে গবেষণার পরিভাষায় ‘সাইকোলজিক্যাল হাইবারনেশন’ বা মানসিক শীতনিদ্রা বলা হয়। ঠিক একই প্রভাব লক্ষ করা যায়, যাদের ওপর মঙ্গল গ্রহের সিমুলেশন চালানো হয়, তাদের ক্ষেত্রে। এ গবেষণাতেও একাকিত্বের অত্যধিক উপস্থিতির কারণে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য মানসিক এবং আচরণগত পরিবর্তন দেখা গিয়েছে।
করোনাকালের জীবন মানুষের মাঝে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এনেছে, এ বিষয়ে গবেষকদের কোনো দ্বিমত নেই। ব্যক্তিত্বের এ পরিবর্তন সত্যিই কতটা স্থায়ী, কতটা প্রভাব বিস্তারকারী, কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক এবং সত্যিই কি আমাদের পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো উচিত নাকি আগের সত্ত্বায় ফিরে যাওয়াই শ্রেয়- এসব প্রশ্নই বর্তমানে বিজ্ঞান আর গবেষণার জগতে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রচুর তথ্য এবং পর্যাপ্ত সময় পরেই কেবল এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর মিলবে।