সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রশংসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপমাটির নাম ‘ফুল’। আর ফুলের রানী, গোলাপ। গোলাপ পছন্দ না- এরকম কথা কেউ কখনো বলেছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই, কোনো না কোনো ধরনের গোলাপ প্রায় সারা বছর ধরেই পাওয়া যায়। আর গোলাপের রয়েছে অসংখ্য প্রজাতি- কিছু প্রকৃতির তৈরি, আর কিছু নার্সারিতে বছরের পর বছর ধরে গবেষণার মাধ্যমে মানুষের দ্বারা তৈরি। গোলাপ চাষের এই খুব সাধারণ বিষয়টিকেই রীতিমতো বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত করেছেন ডেভিড অস্টিন। গোলাপ প্রজননে অবদানের কারণে, তার তৈরি গোলাপের প্রজাতিসমূহকে সাধারণভাবে ‘অস্টিন রোজেস’ বলা হয়ে থাকে।
ব্যক্তিগত জীবন ও বাগান করার হাতেখড়ি
বাবা চার্লস্ অস্টিন ও মা লিলিয়ান অস্টিনের পুত্র, ডেভিড চার্লস্ হেনশ অস্টিন, ১৯২৬ সালে ইংল্যাণ্ডের শ্রপশায়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তার পরিবার ৮০০ বছরেরও বেশি সময় যাবৎ নিজেদের জমির এক অংশে আলু আর বার্লি চাষ করত, আর অপর অংশে ভেড়া চড়াত। এই জমিটিই পরবর্তীতে ডেভিডের নার্সারিতে পরিণত হয়। শ্রুবারি স্কুলের লাইব্রেরিতে ডেভিড, ‘গার্ডেন ইলাস্ট্রেটেড’ ম্যাগাজিনের কয়েকটি কপি হাতে পান এবং সেগুলো পড়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে সেসময়েই তার বাগান করার প্রতি ঝোঁক জন্মায়। জেমস্ বেকার নামক একজন পারিবারিক বন্ধু নিজের নার্সারিতে ডেভিডকে হাতে-কলমে বাগান করা শেখান।
২১তম জন্মদিনে তার বোন তাকে ‘এডওয়ার্ড এ. বানিইয়ার্ড’ এর লেখা ‘ওল্ড গার্ডেন রোজেস’ বইটি উপহার দেয়। এই বইটি থেকেই তার গোলাপ প্রীতি শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ডেভিড পারিবারিক জমিতে চাষবাসের কাজ করতে শুরু করলেও একপর্যায়ে বাবার মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি বাগান করাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন।
গোলাপের প্রজননের পাশাপাশি ডেভিড বইও লিখেছেন। ১৯৮৮ সালে তার প্রথম বই ‘দ্য হেরিটেজ অফ রোজেস’ প্রকাশিত হয়। এর পাঁচ বছর পরে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ইংলিশ রোজেস’ এর প্রথম সংস্করণ। আর ২০১৪ সালে নিজের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও প্রকৃতি প্রেমের কথা তুলে ধরে, ‘দ্য ব্রিদিং আর্থ’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে ডেভিড অস্টিন নিজ বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করেন।
গোলাপ সম্রাটের যাত্রাপথ
আর দশটা কিংবদন্তীতুল্য সাফল্যগাঁথার মতোই ডেভিডের জীবনেও দীর্ঘ সময়ের সাধনা ও পরিশ্রমের পরেই সাফল্যের দেখা মিলেছে। ৬০ বছরেরও বেশি দীর্ঘ কর্মজীবনের গবেষণায়, ক্লাসিক্যাল যুগের বাগানের গোলাপ ও আধুনিক গোলাপের সমন্বয়ে সৃষ্টি হওয়া নতুন প্রজন্মের গোলাপগুলোকে ডেভিড সাধারণভাবে নামকরণ করেন- ‘ইংলিশ রোজেস’। তিনি কখনোই ‘অস্টিন রোজেস’ বলা পছন্দ করতেন না। নিজের উদ্ভবিত বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপের নামকরণের জন্য ডেভিড শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিতেন। এমনকি পছন্দের মানুষদের নামেও তিনি তার গোলাপের নামকরণ করতেন। স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার নামে নামকরণ করেন ‘প্যাট অস্টিন রোজ’ এর।
১৯৬২ সালে, ‘কন্সট্যান্স স্প্রাই’ নামে একটি গুল্ম জাতীয় গোলাপের প্রজাতি সৃষ্টির মাধ্যমে ডেভিড প্রথমবার প্রকৃত সাফল্যের দেখা পান। এই গোলপটির নামকরণ করা হয় একজন মানুষের নামে, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ লেখক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুলের নকশার ডিজাইনার। এই প্রজাতিটি তৈরিতে ‘বেল আইসিস’ নামক ১৮৪৫ সালের গ্যালিকা হাইব্রিড ও ‘ডেন্টি মেইড’ নামক ২০ শতকের ফ্লোরিবাণ্ডা হাইব্রিড ব্যবহার করা হয়। ওয়েস্টমিনস্টারের নিউ হলে অনুষ্ঠিত ‘রয়েল হর্টিকালচারাল সোসাইটি’র প্রদর্শনীতে এই নতুন প্রজাতিটি ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। আন্তর্জাতিভাবে, নতুন এই প্রজাতিটিকে ‘অসফার্স্ট’ সাংকেতিক নাম দিয়ে রেজিস্টার করা হয়।
সেই থেকেই প্রজননের পথে সাফল্যগাঁথার শুরু। কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় লেগেছিল। সেসময়কার বেশিরভাগ নার্সারিই এই নতুন প্রজাতির গোলাপের চারা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের ধারণা ছিল যে, এই ধরনের চারার জন্য যথেষ্ট ক্রেতা পাওয়া যাবে না। সেসকল নার্সারিকে উপেক্ষা করে ডেভিড নিজেই তার উৎপন্ন প্রজাতিগুলোর প্রচারণা ও সরবরাহের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় তিনি শ্রপশায়ারে তার বাড়ির কিচেন টেবিলটিকেই চারা সরবরাহ করার কাজের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেন।
১৯৮৩ সালে তিনি নতুন তিনটি গোলাপের প্রজাতি উপস্থাপন করেন। এই তিনটির একটির নামকরণ করা হয়েছিল তার প্রিয় হর্টিকালচারিস্ট গ্রাহাম থমাসের নামানুসারে। হলুদ রঙের গোলাপের এই প্রজাতিটির গন্ধ ছিল সদ্য তুলে আনা চা-পাতার মতো সজীব। এই নতুন তিনটি প্রজাতিই সংশ্লিষ্ট মহলে বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আর এর ফলে তার ব্যবসায়িক সাফল্যেরও শুরু হয়। আর এর মাধ্যমেই, ‘ইংলিশ রোজেস’ সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে।
ডেভিড অস্টিন ২০০ এরও বেশি প্রজাতির গোলাপের সৃষ্টি করেছেন। আর এর সবগুলোই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে ‘ডেভিড অস্টিন রোজেস’ নামক প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে। সরাসরি বিক্রি, বিভিন্ন বাগান থেকে ও অনুমোদিত সরবরাহকারীর মাধ্যমে বিক্রি করে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সমর্থ হয়। কথিত আছে, স্টিভ জবস্, ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত অ্যাপল ইনকর্পোরেটেড এর কর্পোরেট অফিসের ১০০ মিটার পায়ে হাঁটার পথটির পুরোটাই কয়েক শত ‘কন্সট্যান্স স্প্রাই’ দিয়ে সাজিয়েছিলেন।
‘ডেভিড অস্টিন রোজেস’- একটি পারিবারিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান
বেশ অনেকদিন পর্যন্ত গোলাপ নিয়ে গবেষণা এবং প্রজননের কাজ করার কথা ডেভিড কেবল স্বপ্নেই ভাবতেন। সেটাকে বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার কথা তার মাথায় আরও পরে আসে, যখন বিভিন্ন আধুনিক ফুলের চারা ও ক্লাসিকযাল যুগের বাগানের গোলাপের চারার সবচেয়ে ভাল দিকগুলো নিয়ে তিনি গবেষণা করতে শুরু করেন। সেখান থেকে যাত্রা শুরু হয় আজকের বিশ্বখ্যাত ‘ডেভিড অস্টিন রোজেস’ নামক রোজ ব্রিডিং কোম্পানির, তথা বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপের মাঝে প্রজনন ঘটিয়ে নিত্যনতুন ধরনের প্রজাতি সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের।
১৯৫৬ সালে তিনি প্যাট্রিসিয়া ব্রেইথওয়েট নামক ভাস্কর ও চিত্রশিল্পীকে বিয়ে করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৯৬৯ সালে তাদের প্রতিষ্ঠানটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবসায়ে রূপ দেন। ডেভিড সিনিয়রের সাথে তার বড় ছেলে ডেভিড জুনিয়র এবং নাতি রিচার্ডও এই প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেন। ডেভিড জুনিয়র ১৯৯০ সালে বাবার সাথে যোগ দেন, আর রিচার্ড যোগ দেন ২০১০ সালে। ডেভিড অস্টিন পরিবারের সদস্যরা সিনিয়র ডেভিডকে ভালবেসে ‘মি. এ’ নামে ডাকত।
১৯৯২ সালে ‘কাটা ফুল’ এর বেশ কিছু নতুন প্রজাতির উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করা হয় এবং এই প্রজাতির প্রথম ব্যাচটি ২০১৪ সালে বাজারে আনা হয়। কিন্তু এবারও পিতা-পুত্রকে নতুন এই গোলাপ বিক্রির জন্য ঝক্কি পোহাতে হয়। বর্তমানে, এই কাটা গোলাপ ব্যক্তিগত উপহার ও বিয়ের সাজসজ্জার জন্য বেশ জনপ্রিয়। এমনকি রাজপরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠানেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। আব্রাহাম ডার্বি, এগ্ল্যান্টাইন, ফিশারম্যান্স ফ্রেণ্ড, জ্যুড দ্য অবস্কিউর এবং সোফি’স রোজ- এই কাটা প্রজাতির অন্যতম আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় গোলাপ। সিনিয়র ও জুনিয়র ডেভিড মিলে তাদের এই প্রতিষ্ঠানটিকে যুক্তরাজ্যের বাইরে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে বিস্তৃত করার মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
ডেভিড অস্টিন গোলাপের প্রজননে তার অবদানের জন্য বিশ্বখ্যাত ‘আরএইচএস চেলসিয়া ফ্লাওয়ার শো’তে ২৪টি স্বর্ণপদকসহ বেশ কিছু প্রসিদ্ধ পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এগুলোর মধ্যে ‘অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ (ওবিই) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। আরও একটি উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি হলো ‘আরএইচএস ভিক্টোরিয়া মেডেল অফ অনার’। এছাড়াও আছে ‘আরএইচএস অ্যাওয়ার্ড অফ গার্ডেন মেরিট’, ‘আরএনআরএস (রয়্যাল ন্যাশনাল রোজ সোসাইটি) ডীন হোল মেডেল’। গ্রাহাম থমাস গোলাপের জন্য ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ রোজ সোসাইটি’ থেকে পেয়েছেন ‘ওয়ার্ল্ড ফ্যাভারিট রোজ ২০০৯’ ও ‘অ্যাওয়ার্ড অফ গার্ডেন এক্সিলেন্স’ পদক।
ডেভিড অস্টিন রোজ গার্ডেন
১৯৬৯ সালে প্রজনন গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য বাড়তি চারা রাখার উদ্দ্যেশ্যে শুরু হলেও, দর্শকদের চাহিদার কারণে, বর্তমানে ‘ডেভিড অস্টিন রোজ গার্ডেন’ ‘লং গার্ডেন’, ‘ভিক্টোরিয়া গার্ডেন,’ ‘রেনেসাঁ গার্ডেন,’ সহ আরও কয়েকটি বাগানের সমন্বয়ে তৈরি একটি বিশাল আকারের ফুলের বাগানে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপে পরিপূর্ণ এই বাগানটি সত্যিই অসাধারণ। এপ্রিলের শেষ বা মে মাসের শুরুতে এই বাগানে ফুল ফুটতে আরম্ভ করে। এটি পরিদর্শনের জন্য জুনের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত এবং তারপরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সবচেয়ে ভাল সময়। এমনকি নভেম্বর মাসেও এখানে ভালই ফুল দেখা যায়।
‘ইংলিশ রোজেস’ এর উদ্ভাবন ও গোটা পৃথিবী জুড়ে গোলাপের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য, বিশ্বের সকল গোলাপ প্রজননকারী ডেভিড অস্টিনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। গোলাপের প্রজননকারীদের এককথায় ‘স্বর্গীয় গোলাপের স্রষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কিন্তু ডেভিড অস্টিনের কাজের পরিধি ও ব্যাপকতা এতটাই বেশি যে, তার কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ঐ অ্যাখ্যাটিও যথেষ্ট নয়। তার জীবনের গল্প, যুগের পর যুগ ধরে মানুষকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার মতোই আকর্ষণীয় ও সুন্দর।