ফটোগ্রাফি বা আলোকচিত্রবিদ্যা বর্তমানের একটি জনপ্রিয় বিষয়। একটি ছবিকে আমরা যতটা সুন্দরভাবে দেখতে পাই, এর পেছনে থাকে অনেক না জানা অধ্যায়। ছবিকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার জন্য আলোকচিত্রশিল্পীরা অনেক উদ্ভাবনী কাজ করেন। তাদের এই উদ্ভাবনী শক্তির কারণেই আমরা চোখজুড়ানো সব ছবি দেখতে পাই। তবে আলোকচিত্রশিল্পীদের মধ্যে যারা খাবারের ছবি তোলেন, তাদের উদ্ভাবনগুলো আসলেই বিস্ময়কর।
খাবারের বিজ্ঞাপনগুলোতে আমরা খাবারের অনেক আকর্ষণীয় ছবি দেখতে পাই। রেস্তোরাঁতে খেতে গেলে সেখানকার মেন্যুতে অনেক সুন্দর ছবি দেখি। টিভির বিজ্ঞাপনেও খুব আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু ছবির সাথে বাস্তবের মিল পাওয়া যায় না। খাওয়ার সময় আমরা দেখতে পাই- ছবিতে এগুলো যত সুন্দর দেখায় চোখের সামনে ততটা মনে হয় না। এর কারণ হচ্ছে আলোকচিত্রীদের ছবি তোলার কিছু কৌশল। খাবারের ছবি তোলার সময় একে আমাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য তারা কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে ধরনের ছবি দেখা যায় তার মধ্যে খাবারের ছবি অন্যতম। ইন্সটাগ্রামে সেলফির পর খাবারের ছবিই বেশি দেখা যায়। তবে খাবারের ছবি তোলা কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার পর শুরু হয়নি। বরং এটি প্রায় ২০০ বছর ধরে হয়ে আসছে! ২০১৭ সালে প্রকাশিত লেখিকা সুসান ব্রাইটের ‘ফিস্ট ফর দ্য আইস’ বইতে খাবারের ছবি তোলার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। ১৮৩৯ সালে সর্বপ্রথম খাবারের ছবি তোলা হয়। এর আগে খাবার হাতে আঁকা ছবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৮৪৫ সালে উইলিয়াম হেনরি ফক্স একটি খাবারের ছবি তোলেন। একটি ঝুড়ির মধ্যে আনারস ও কিছু ফল দেখা যায় ছবিতে। এটি ছিল শুধুমাত্র খাবারকে ছবির মূল বিষয়বস্তু হিসেবে রাখা প্রথম ছবিগুলোর একটি। উনবিংশ শতাব্দীতে খাবারের ছবিগুলোকে শুধু শৈল্পিকভাবেই দেখা হতো। বিংশ শতকে এর বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়।
১৯৪০ সালে ক্রিসকো, আন্ট জেমিমা ইত্যাদি আমেরিকান ব্রান্ডগুলো ‘কুকবুকলেট’ ছাপানো শুরু করে। এগুলোর মাধ্যমে তারা খাবারের ছবি দিয়ে প্রচারণা করতো। বর্তমানে এটি রেস্তোরাঁ কিংবা খাবারের ব্র্যান্ডগুলোর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে এই ছবি তোলা খুব কঠিন একটি কাজ। কারণ গরম খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়, আর্দ্র খাবার শুকিয়ে যায়, জমাট খাবার গলে যায়, ফলের রঙ বদলে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে ছবি তোলার প্রয়োজন হয় বলে খাবারের চেহারা বদলে যায়। এই অসুবিধা দূর করার জন্য আলোকচিত্রীরা কিছু অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন করে। তারা খাবারের সাথে কিছু কৃত্রিম বস্তু মিশিয়ে ছবি তোলে। এগুলোর মধ্যে রঙ, সাবানের ফেনা থেকে জুতার কালি উল্লেখযোগ্য। কীভাবে তারা কাজটি করে জেনে নেয়া যাক।
সাবান দিয়ে কফির বুদবুদ
কফিতে বিশেষ করে ক্যাপুচিনো কফিতে উপরের অংশে বুদবুদ দেখা যায়। এটা বেশি সময় থাকে না। কিন্তু ছবি তোলার কাজ অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই একে অনেক সময় ধরে রাখার জন্য সাবানের ফেনা রাখা হয়। এতে কফির ছবিটি সুন্দর আসে। শুধু কফি নয়; দুধ, মিল্কশেক, কোমল পানীয়গুলোতেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
আলু দিয়ে আইসক্রিম
ক্যামেরা ও এর লাইটের কারণে আইসক্রিম বেশি সময় তার আকার ধরে রাখতে পারে না। গরম হয়ে গলে যায়। এ কারণে ছবি তোলার সময় আইসক্রিমের জায়গায় আলুর মন্ড ব্যবহার করা হয়। রঙ দিয়ে বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম হিসেবে আলুকে দেখানো হয়। এতে আকার ঠিক থাকে। আলু ছাড়াও চর্বি, চিনির গুঁড়া এগুলোও ব্যবহার করে দৃষ্টিভ্রম করা হয়।
মাংসে জ্বালানি তেল
মাংসের সাথে জ্বালানি তেল মেশানো হয়। এতে ছবিতে মাংসকে চকচকে দেখায়। শুধু মাংস নয়, প্যানকেকের ছবি তুলতেও এই তেল দেয়া হয়।
বার্গারে জুতার কালি
বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের ফেসবুক পেজে জিভে জল এনে দেওয়ার মতো বার্গারের ছবি দেখা যায়। এগুলোর সব কিন্তু বাস্তবে এমন নয়। এদের দেখতে সুন্দর লাগানোর জন্য অনেক সময় জুতার কালিও ব্যবহার করা হয়। এতে খাবার হয়তো খাওয়ার যোগ্য হয় না, কিন্তু দেখতে সুন্দর হয়ে ওঠে।
তুলা দিয়ে গরম ধোঁয়া
খাবারের বিজ্ঞাপনে আমরা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ কিংবা চায়ের কাপ দেখতে পাই। কিন্তু ছবি তোলার সময় গরম খাবারের ছবি তোলা হয় কি? না, কারণ খাবার বেশি সময় গরম থাকে না। আর ছবি তোলার জন্য এগুলো বারবার গরম করাও হয় না। তাই তখন তুলাকে ভিজিয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করা হয়। তখন এটা থেকে ধোঁয়া উড়তে থাকে। এই ধোঁয়া অনেক সময় থাকে। তুলাকে ছবি তোলার সময় খাবারের পেছনের দিকে রাখা হয়। তাই ছবিতে মনে হয় ধোঁয়া খাবার থেকেই উড়ছে।
প্লাস্টিকের বরফ
বিভিন্ন পানীয়ের বিজ্ঞাপনে বরফের চাকতি দেখা যায়। কিন্তু বরফ কিছু সময় পরই গলে যায়। তাই এগুলোতে প্লাস্টিকের বরফ চাকতি ব্যবহার করা হয়। এসব চাকতি খুবই স্বচ্ছ এবং পানিতে ভাসে।
দুধের জায়গায় গ্লু
সিরিয়াল বা কর্ন ফ্লেক্স জাতীয় খাবারকে দুধে রাখলে কিছুক্ষণ পর নরম হয়ে ডুবে যায়। এজন্য ছবি তোলার সময় দুধের জায়গায় সাদা রঙের গ্লু বা আঠা ব্যবহার করা হয়। এতে খাবার ডুবে যায় না এবং তাদের মূল চেহারা অপরিবর্তিত থাকে।
রঙ দেয়া মুরগি
টার্কি মুরগির ছবিতে যে ছবি দেখা যায় তা আসলে রান্না করা মুরগি থাকে না। কাঁচা মুরগিকে রঙ করে রান্না করা মুরগি হিসেবে দেখানো হয়। মুরগিকে বড় দেখানোর জন্য এর ভেতর কাগজ বা কাপড় ঢোকানো হয়।
পানীয়ের সাথে অ্যান্টাসিড
কফির সাথে মেশানো হয়েছিল সাবানের ফেনা। একই কাজ করা হয় পানীয়ের সাথেও। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট। কোমল পানীয় গ্লাসে রাখলে উপরে যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বুদবুদ থাকে সেটা ছবিতে দেখানোর জন্য এটা করা হয়। পানীয়ের সাথে অ্যান্টাসিড এর রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে এই বুদবুদ অনেক সময় ধরেই থাকে।
কেকের মাঝে কার্ডবোর্ড
অনেক সময় কেক বা স্যান্ডউইচের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, অনেকগুলো কেক বা স্যান্ডউইচ পাশাপাশি বা উপর-নিচ করে রাখা। সাধারণভাবে রাখলে এরা একসাথে আটকে থাকে না। তাই ধরে রাখার জন্য এদের মাঝে শক্ত কার্ডবোর্ড ব্যবহার করা হয়। দাঁত পরিষ্কারের কাঠিও ব্যবহার করা হয় এই কাজে।
স্ট্রবেরিতে লিপস্টিক
স্ট্রবেরিকে বেশি লাল দেখানোর জন্য এর সাথে লিপস্টিক মেশানো হয়। এ কারণে দেখা যায়, স্ট্রবেরিগুলো ছবিতে যতটা লাল দেখায় বাস্তবে ততটা লাল নয়।
সামুদ্রিক খাবারে গ্লিসারিন
সামুদ্রিক খাবারকে সতেজ দেখানোর জন্য এর সাথে গ্লিসারিন মাখানো হয়।
ফলের সাথে সুগন্ধি
ফলের সাথে সুগন্ধি মেশানো হয় একে আরো চকচকে ও সতেজ দেখানোর জন্য।
নুডলসের সাথে গ্লুকোজ
নুডলস রান্না করতে সময় কম লাগলেও এরা খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়। এজন্য এর সাথে গ্লুকোজ সিরাপ মেশানো হয়।
সসের সাথে মোম
সসকে ঘন দেখানোর জন্য আলোকচিত্রীরা এর সাথে বিভিন্ন রঙের গলিত মোম ব্যবহার করেন। এতে সসগুলোকে ছবিতে আকর্ষণীয় দেখায়।