এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কে? চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর যদি বলা হয় সবচেয়ে বেশি সমালোচনা সহ্য করতে হয় কাকে? এটাও নিশ্চয়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প। অটল মনোভাব কিংবা বেহায়াপনা, যে যেভাবেই বলুক না কেন, তিনি ইতোমধ্যে জীবনের লম্বা এক সফর শেষ করে ফেলেছেন। পারিবারিক সূত্রেই ব্যবসা তার মনন আর মগজে মিশে আছে। জীবনের আভিজাত্য তাকে এভাবেই গড়ে তুলেছে। তাই টাকা-পয়সা নিয়ে তাকে কখনোই তেমন ভাবতে হয়নি। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। এমন কোনো ব্যবসা নেই, যেখানে তিনি হাত দেননি। এগুলোর ফলাফলও তিনি হাতেনাতে পেয়েছেন। প্রায় সবগুলো উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পড়েছে তার। তারপরও থেমে না গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করার প্রচেষ্টা ছিল সবসময়। আজকের লেখায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫টি অসফল ব্যবসা এবং সেগুলো আলোর মুখ না দেখার কারণ আলোচনা করা হবে।
১. ফুটবল ক্লাব
১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ‘নিউ জার্সি জেনারেল’ নামে একটি ক্লাবের অস্তিত্ব ছিল। যে ক্লাবটি কেবল যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল লিগ খেলত। ট্রাম্প ১৯৮৪ সালে ৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ক্লাবটি কিনে নেন। কিন্তু সেই সময় টিভিতে ক্লাবটির খেলা দেখানোর তেমন সুযোগ ছিল না। ফলে আর্থিক ক্ষতির কথা ভেবে ট্রাম্প তাদের খেলা বসন্ত থেকে সরিয়ে শরতে নিয়ে যেতে চাইলেন। যাতে তারা এনএফএল গেমস এর আদলে খেলতে পারে। তার মতে এনএফএল এর চেয়ে ইউএসএফএল অনেক বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু এনএফএল এর কারণে তাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এজন্য লিগ কর্মকর্তাদের এনএফএল এর বিরুদ্ধে মামলা করতে উৎসাহিত করলেন তিনি। মামলার যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন ট্রাম্প। প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা এটা!
মামলা চালাতে গিয়ে ইউএসএফএল-এর বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় সবটা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ট্রাম্প বিশ্বাস করতেন, তিনি এই মামলায় জিতবেন। এনএফএল সমঝোতার জন্য ইউএসএফএলে দল কিনতে বাধ্য হবে। এভাবেই ট্রাম্প লাভের মুখ দেখবে। কিন্তু তার এমন পরিকল্পনাকে মাটি করে দিয়ে এনএফএল কোনো দল কিনল না।
মামলাটির নিস্পত্তি করতে ১৯৮৪ সালে প্যাট্রিসিয়া সিবিলিয়া নামক একজন জুরি দায়িত্ব নেন। তিনি ও তার সঙ্গি জুরিরা ট্রাম্পকে একজন অহঙ্কারী ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেন। তাদের মতে, ট্রাম্প আসলে এই চুক্তির আড়ালে এনএফএলে কম দামে দল কিনতে চাইছেন। অথচ এই লিগে খেলা একেকটি দলের দাম এক বিলিয়ন ডলারের মতো।
তবে নাটকীয়ভাবে ট্রাম্প অন এয়ারে যাওয়ার ব্যাপারে মামলাটি জিতে যান। কিন্তু ততদিনে নিজেদের লিগের ভেতর ভাঙন শুরু হয়। খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ এবং লিগের অর্থাভাবের কারণে ১৯৮৬ সালে ইউএসএফএল এর সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে নিজেও ক্ষতির মুখে পড়েন ট্রাম্প।
২. ট্যুর ডি ট্রাম্প
১৯৮৬ সালে ফুটবলে লোকসানের মুখোমুখি হওয়ার পরও ট্রাম্প আশাহত হননি। এবার তিনি চিন্তা করলেন, ‘ট্যুর ডি ফ্রান্সের’ আদলে আমেরিকানদের সাইক্লিং খেলা উচিত। যার নাম হবে ‘ট্যুর ডি ট্রাম্প!’ তবে এই খেলা ফ্রান্সের চেয়ে জনপ্রিয় হবে এখানে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে যা হতো, সেখানকার দর্শকরা সরাসরি খেলা দেখার চেয়ে টিভিতে সাইক্লিং দেখতে পছন্দ করত। ফলে টুর্নামেন্টটি সেখানে মিলিয়ন ডলার স্পন্সর পেত।
সবকিছু ঠিকঠাক করার পর সাইক্লিং রেসটি আলোর মুখ দেখে আমেরিকায়। নিউ ইয়র্কের অ্যালবানি থেকে শুরু করে নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটি পর্যন্ত বিশাল ট্র্যাক সাজানো হলো। টুর্নামেন্টে ভালো খেলার জন্য, নগদ বিপুল পরিমাণ অর্থ পুরষ্কার দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ফলে বিশ্বের নামিদামি অনেক সাইক্লিস্ট টুর্নামেন্টে যোগ দিয়েছিল। আমেরিকান দর্শকদের আকৃষ্ট করতে এনবিসিতে খেলাগুলো সম্প্রচারেও ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে টুর্নামেন্টটির দ্বিতীয় আসর বসে। ট্রাম্প সেখানে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প কোনো লাভের মুখ দেখেননি। ফলে টুর্নামেন্টের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তিনি। ট্রাম্পের পর ডুপন্ট পরিবার টুর্নামেন্টটির দায়িত্ব নেয়। পর্যাপ্ত লাভ না হওয়ায় তারাও ১৯৯৬ সালে টুর্নামেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ।
৩. ট্রাম্প এয়ারলাইন্স
খেয়ালি ট্রাম্পের মাথায় একসময় ভূত চাপল, তিনি এয়ারলাইন্সের ব্যবসা করবেন! যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। ১৯৮৮ সালে ‘ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স’ নামে একটি কোম্পানি কিনে নেন তিনি। বোয়িং-৭২৭ সিরিজের ২১টি বিমানের গায়ে থেকে বোয়িং এর নাম মুছে দিয়ে, সেখানে নিজের নাম সেঁটে দেন ট্রাম্প।
মজার ব্যাপার হলো, এত কিছু করে ফেলার পরও ট্রাম্প এয়ারলাইন্সের কিছুই বুঝতেন না। ফুয়েলের দাম, বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, এমনকি টিকিটের দামের ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না তার। তারপরও সাহস করে তিনি বিমান ভ্রমণের জন্য প্রচারণা শুরু করেন। ২০১১ সালে একজন ভ্রমণ লেখক ট্রাম্প এয়ারলাইন্সে নিজের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি লেখেন,
বিমানের কর্মীরা যথেষ্ট আন্তরিক। তাছাড়া খাবারগুলোও ছিল উঁচুমানের। কিন্তু আমার বুঝে আসে না, ট্রাম্প কেন কতগুলো পুরোনো বিমানে এমন জাঁকজমকের আয়োজন করেছেন, যা দেখতে একেবারেই বেমানান।
শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এয়ারলাইন্স ব্যবসাতেও ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। তিনি কোম্পানিটি কেনার সময় ২৪৫ মিলিয়ন ডলার লোন নিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানি লাভের মুখ না দেখায়, বিল বাবদ আরও ১ মিলিয়ন ডলার যোগ হয়। ট্রাম্পের এমন দুর্দিনে তার বন্ধুরা হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না তার। এয়ারলাইন্স ব্যবসার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ট্রাম্প বলেন, “এটা অনেক কঠিন ব্যবসা। তবে আমি নতুন হিসেবে যথেষ্ট ভালো করেছি!’’
৪. ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়
ট্রাম্প যখন ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার চিন্তা করলেন, ততদিনে ব্যবসা জগতের নানা বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান আহরণ করেছেন। মোটামুটি অনেকগুলো ব্যবসায় হাত দিয়ে শিক্ষা হওয়ার কথা তার! কিন্তু একগুঁয়ে ট্রাম্প হয়তো নিজের চিন্তাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তাছাড়া বাবার বিশাল রিয়েল এস্টেট বিজনেসের কারণে ট্রাম্পকে কখনো মূলধন নিয়ে ভাবতে হয়নি। ফলে সাহস করে ট্রাম্প রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শেখানোর জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন।
কথা ছিল সেখানে সেরা রিয়েল এস্টেট গুরুরা দিক্ষা দিতে আসবেন। বাস্তবে এমন সব শিক্ষকদের আনা হলো, যাদের রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই নেই! পরিকল্পিত কোনো সিলেবাসও ছিল না তাদের। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অবশেষে দেখা গেলো শিক্ষার্থীরা ৩৫,০০০ ডলার জলে ফেলে দিয়েছেন। সেই তুলনায় তারা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ের কিছুই শিখতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে ৩টি মামলা করা হয়। ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বিরুদ্ধে একটি জালিয়াতি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি দাবি করেন, যেসব শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়েছেন, তাদের সব টাকা ফেরত দিতে হবে। ট্রাম্পের আইনজীবীরা আদালতের কাছে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়ার আর্জি জানান। যাতে তারা প্রমাণ করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি সঠিক পথেই এগোচ্ছে। প্রায় ৭,০০০ প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চিঠি প্রেরণ করে। কিন্তু চিঠির জবাবে মাত্র দুজন সাড়া দিয়েছিল। যারা লিখিত আকারে বলেছেন, এখানকার শিক্ষা তাদের ক্যারিয়ার গঠনের কাজে লেগেছে।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ট্রাম্প আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেননি। মামলার রায়ে ট্রাম্পকে ২৫,০০০ ডলার পরিশোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যে পরিমাণ অর্থ প্রায় ৬,০০০ শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেন, এই মামলার রায় তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। বিচারক ছিলেন একজন মেক্সিকান। তিনি ইচ্ছে করেই ট্রাম্পকে দোষী হিসেবে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন।
৫. ট্রাম্প নেটওয়ার্ক
এসিএন- একটি ডিজিটাল ফোন পরিসেবা প্রতিষ্ঠান, যার নাটাই ছিল ট্রাম্পের হাতে। কোম্পানির পণ্যের প্রচার সম্মেলনে ট্রাম্প সবাইকে বেশি বেশি ফোন কেনার আহবান জানান। কোম্পানির ডিলারদের একজন সেই সম্মেলনে নিজের সফলতার গল্প শোনান। পরে দেখা যায়, সেই ডিলার একজন মাদক ব্যবসায়ী! ফোন বিক্রির আড়ালে লোকটি টাকা পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
একটা সময় দেখা যায়, কোম্পানির বেশিরভাগ ডিলার তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের বাৎসরিক আয় মাত্র ৭০০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরকম অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে ঘরে-বাইরে অনেক আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ট্রাম্প এসবের তোয়াক্কা না করেই নিজের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার মতে, রিয়েল এস্টেট ব্যবসার তুলনায় এই ব্যবসায় মুনাফা বেশি! কোম্পানিটি যে নীতিমালা নিয়ে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল, সেটা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ ছিল না। কারণ, এই ধরনের ব্যবসায় মানুষকে ঠকানোর সুযোগ তৈরি হয়।
ইতোমধ্যে কোম্পানির উদ্দেশ্য মানুষের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা রাজ্য থেকে সর্বপ্রথম এসিএনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তাদের দেখাদেখি অনেকগুলো রাজ্য থেকেই অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আদালত তেমন কোনো প্রমাণ পায়নি। ফলে সেই যাত্রায় কোম্পানিটি ছাড় পেয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্প আসলে এরকম কিছু করার মানসিকতা নিয়ে কোম্পানিটি চালু করেননি। ট্রাম্প মূলত একটি বহু স্তরের বিপণন সংস্থা (এমএলএম) খুলতে চেয়েছিলেন। গ্রাহকদের জন্য ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট সরবরাহ করার মাধ্যমে একটি বৃহৎ নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা ছিল তার। টালমাটাল আমেরিকার অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার মাধ্যমে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া না পেয়ে কোম্পানিটি বারবার পরিকল্পনা বদলেও শেষ বাঁচতে পারেনি। ২০০৯ সালে চালু হওয়ার পর মাত্র দুই বছরের মাথায় কোম্পানিটি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় ট্রাম্প অসংখ্য ব্যবসায় পুঁজি খাটিয়েছেন। মদ, ক্যাসিনো, ভার্চুয়াল গেম, হোটেল, খাবার পানি বিপণন নিয়েও ব্যবসা করেছেন ট্রাম্প। বরাবরের মতো সবগুলোতেই নিয়মিতভাবে অসফল হয়েছেন তিনি। তারপরও জেদি আর একগুঁয়ে এই বিশ্বনেতা হার মানতে নারাজ। তিনি কোথায় গিয়ে থামবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।
রোর বাংলা এর বই সমূহ কিনতে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কে:
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে