নাই কি রে সুখ? নাই কি রে সুখ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলই কি নর জনম লয়?
কামিনী রায়ের ‘সুখ’ কবিতাটির মতো আপনিও কি সুখ খুঁজছেন? ‘সুখ তুমি কী, বড় জানতে ইচ্ছে করে/ আমার জানতে ইচ্ছে করে’- এটি কি আপনার প্রিয় গান? তাহলে আগে একটি প্রশ্নের উত্তর দিন, সুখ আসলে কী? কাকে বলে সুখ? কী করলে হওয়া যায় সুখী?
অর্থবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি কখনোই সুখ বয়ে আনে না, এ কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছি। তবুও সুখী দেশ যারা খুঁজতে গিয়েছিলেন, তারা কিন্তু ঠিকই নাগরিকদের মাথাপিছু আয়কে সুখের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনায় রেখেছেন। পাশাপাশি বিবেচনায় রেখেছেন বিনয়, সুস্থ জীবনযাপনের রীতি, গড় আয়ু, বন্ধুত্ব, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার স্বাধীনতা, দুর্নীতিমুক্ত থাকার স্বাধীনতা আর সর্বোপরি সুখকে অন্তর থেকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা। বিশ্বের ১৫৫টি দেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট সুখী দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। চলুন তবে পরিচিত হওয়া যাক সুখী দেশ আর তাদের মানুষদের সাথে।
১০. সুইডেন
কফিপ্রেমী নির্ঝঞ্ঝাট জাতি সুইডিশরা। দিনের যেকোনো সময় শত কাজের ভিড়ে একটু ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়ে অন্তত একবার হলেও কফি তাদের পান করতেই হবে। সাথে সঙ্গী-সাথী জুটে গেলে তো কথাই নেই। সতেরো শতক থেকে সামরিক শক্তি আর অস্ত্র উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা অংশগ্রহণ করেনি প্রধান দুটি বিশ্বযুদ্ধের একটিতেও। সব মিলিয়ে ৪৮০ দিন বৈতনিক অভিভাবকত্ব ছুটি কাটায় সুইডিশ পিতা-মাতারা। সাহিত্যে সাতজন নোবেল বিজয়ী রয়েছে তাদের দেশে। এই অব্দি ৬২৫টি অলিম্পিক মেডেল অর্জন করেছে তারা। এত এত সাফল্য যে দেশটিকে ঘিরে রেখেছে, তারা সুখী দেশের তালিকায় থাকবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?
৯. অস্ট্রেলিয়া
মানুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি ভেড়া দখল করে আছে গোটা অস্ট্রেলিয়াকে। ইমু পাখি, প্লাটিপাস, বক্স জেলিফিশ, কোয়ালা থেকে শুরু করে নানান সব প্রাণী- কী নেই এখানে? জীবদ্দশায় একেকজন অস্ট্রেলিয়ান গড়ে ১৮টি গরু আর ৯০টি ভেড়া গলাধঃকরণ করে। জিনা রাইনহার্ট, অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ধনী নারী, প্রতি আধা ঘণ্টায় ১ মিলিয়ন ডলার আয় করেন! সৌদি আরব তাদের উটের চাহিদার বেশ বড় একটি অংশ আমদানি করে অস্ট্রেলিয়া থেকে। সুখী মানুষদের দেশের তালিকায় অস্ট্রেলিয়ানরা আছে নয় নম্বরে।
৮. নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডকে দেশ না বলে দ্বীপ বলাই ভালো। অসাধারণ সব পেঙ্গুইনের বাস এখানে। হলদে চোখের পেঙ্গুইন, ছোট্ট নীল পেঙ্গুইনের মতো বিরল সব প্রজাতির দেখা পাওয়া যায় নিউজিল্যান্ডে। এখানকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% মানুষ, বাকি সব পশুপাখি! দুর্নীতিপ্রবণ দেশগুলোর তালিকায় নিউজিল্যান্ডের নাম থাকে একদম শেষের দিকে। ট্রিপ অ্যাডভাইজর ডট কমের পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্রমণপিপাসুদের বেড়ানোর স্থানের তালিকায় নিউজিল্যান্ড থাকে শুরুর দিকে। এভারেস্টজয়ী প্রথম ব্যক্তি স্যার অ্যাডমন্ড হিলারিও কিন্তু নিউজিল্যান্ডেরই অধিবাসী ছিলেন।
৭. কানাডা
পুরো পৃথিবীর মোট বনভূমির ১০ শতাংশ একা দখল করে আছে কানাডা। এখানকার বায়ু যে নির্মল হবে আর লোকজনের গড় আয়ু বেশি হবে, তা না বললেও চলে। চার্চিল অঞ্চলের লোকজন ঘরে ঢোকার আগে গাড়ির দরজা লক করে না। ভাবছেন ওসব দেশে আর চোর কোথায়? আসলে হঠাৎ করে মেরু ভাল্লুক আক্রমণ করলে প্রতিবেশিরা যেন পালিয়ে বাঁচতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা! প্রতি বছর নেদারল্যান্ড হাজার হাজার টিউলিপ ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানায় কানাডাকে, আর সেসব ফুল নিয়ে হয় বার্ষিক টিউলিপ উৎসব। তাদের সাধারণ পানির মান বোতলজাত মিনারেল পানির চেয়েও ভালো। শিক্ষার দিক থেকে পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি নাম লিখিয়েছে সুখী মানুষদের তালিকায় সাত নম্বরে।
৬. নেদারল্যান্ড
লম্বা লম্বা মানুষের আবাসস্থল নেদারল্যান্ড। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই যে মেয়োনিজ দিয়ে খাওয়া যায়, তার উদ্ভাবক এদেশের লোকেরা। শুধু তা-ই নয়, মানসম্মত খাবারের দিক থেকে শীর্ষে আছে দেশটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান ক্যুকোনহফও রয়েছে তাদের দখলে। এখানকার আমস্টারডামেই রয়েছে ১,২৮১টি ব্রিজ, যা ভেনিসের মোট ব্রিজ সংখ্যার চেয়ে কম করে হলেও তিনগুণ বেশি! দেখা হলে পরস্পরের গালে তিনটি করে চুমো খাওয়ার রীতি পালন করে আসা মানুষরা আক্ষরিক অর্থেই সবদিক থেকে বেশ সুখে আছেন।
৫. ফিনল্যান্ড
শারীরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুব সতর্ক ফিনরা। ৫.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটিতে সনা বাথ বা স্টিম বাথের পার্লারের সংখ্যা দুই মিলিয়নেরও বেশি। গোটা বিশ্বে পড়ালেখার জন্যও বেশ প্রসিদ্ধ এ দেশ। প্রতি বছর লাইব্রেরি থেকে বই ধার নেয়ায় বাকিদের ছাড়িয়ে গেছে ফিনরা। দুর্নীতির দিক থেকে তাদের সরকার একেবারেই পেছনের দিকের সারিতে অবস্থানরত। হবু মায়েদের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ দেশ আর দ্বিতীয়টি নেই বলে জানিয়েছে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড’। বিশ্বের সবচেয়ে সৎ শহরের তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি শহরটি।
৪. সুইজারল্যান্ড
আপনি যদি সুইজারল্যান্ডে গিয়ে গিনিপিগ পুষতে চান, তাহলে আপনাকে অন্তত দুটো গিনিপিগ কিনতে হবে। সঙ্গী ছাড়া মানুষ তো বটেই, কোনো পশুপাখিকেও আটকে রাখা এখানে দণ্ডনীয় অপরাধ। সুইসরা প্রতিবছর প্রায় ১১ কেজি চকোলেট খায় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক কোকোয়া সংস্থা। সুইসদের জাতীয় কোমল পানীয়ও তৈরি করা হয় গরুর খাঁটি দুধ থেকে। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই শিথিল যে, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও আরামসে গণ পরিবহনে যাতায়াত করেন। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা এখানে হয় না বললেই চলে। গোটা শহর খুঁজেও একটু ময়লা চোখে পড়বে না আপনার, এতটাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাপ্রেমী হয় সুইসরা। জনসম্মুখে ভোট দেয়ার নীতির কারণে আপনার প্রতিবেশী বা অফিসের বস সবাই আপনার রাজনৈতিক মতামত জানতে পারবে সহজে। লুকোচুরি এখানে শুধু খেলার জন্যই খেলা হয়, বাস্তব জীবনে তার খুব একটা প্রতিফলন নেই। সে হিসাবে সুইজারল্যান্ড এখন বিশ্বের চতুর্থ সুখী দেশ।
৩. আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডের অপর নাম ‘অনল ও বরফের দেশ’। একদিকে যেমন প্রচণ্ড তুষারপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে যেকোনো মুহূর্তে আগ্নেয়গিরির লাভা বিস্ফোরিত হতে পারে সেই ভয়ে দিন কাটে আইসল্যান্ডের অধিবাসীদের। সেখানে শিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় আইসল্যান্ডের বই ছাপানোর সংখ্যা অনেক বেশি। গ্রীষ্মের সময়, সূর্য বলতে গেলে অস্ত যায়ই না। বেশির ভাগ আইসল্যান্ডারের কোনো পদবী থাকে না। স্যান্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, হট ডগ সবকিছুর জন্য ভিন্ন ভিন্ন সস ব্যবহার করে তারা। তাদের ভাটনাজকাল ইউরোপের সবচেয়ে বড় হিমবাহ, আকারে যা পুয়ের্তো রিকোর সমান! দেশটিতে অপরাধের হার এতটাই কম যে পুলিশও বন্দুক ব্যবহার করে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, আইসল্যান্ডে কোনো মশা নেই। সুখী দেশ হওয়ার জন্য এই একটি কারণই কী যথেষ্ট নয়!
২. ডেনমার্ক
আপনার পছন্দের অনেকগুলো পেস্ট্রি কেকের জনক ডেনমার্ক। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে কোনো টাকা লাগে না। চাকরি চলে গেলে পরবর্তী দু’বছর আগের বেতনের ৯০% টাকা সরকার নিজে বহন করে। এখানকার কোপেনহেগেন শহরটি তৈরিই করা হয়েছে বাইসাইকেলপ্রেমীদের জন্য। কোপেনহেগেনের বাসিন্দারা প্রতিদিন প্রায় ২১৭ মাইল রাস্তা বাইসাইকেল চালিয়ে যার যার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছায়। এ দেশের চাকুরীজীবীরা তাদের চাকুরি নিয়ে সবচেয়ে সন্তুষ্ট। হবে না-ই বা কেন? একবারে ৫২ সপ্তাহ মাতৃত্ব বা পিতৃত্বকালীন ছুটি উপভোগ করার সুযোগ আর কোনো দেশে নেই, তা-ও আবার পুরোপুরি সবেতনে! সবাইকে খুশি রাখার উপায় সত্যিই জানে ডেনমার্ক।
১. নরওয়ে
প্রাচীনকালে মানুষ মনে করতো নরওয়েতে যে অরোরা বোরেয়ালিস বা উদীচী ঊষা দেখা যায়, তা স্বয়ং ঈশ্বর পাঠাতেন। প্রতিবছর সে জ্বলজ্বলে আলোর শিখা দেখতে কত মানুষ যে নরওয়েতে আসে, তার ইয়ত্তা নেই। ডিজনির ‘ফ্রোজেন’ মুভিটির প্রাথমিক ধারণা গড়ে উঠেছিল নরওয়েকে ঘিরেই। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চাকুরি টিকিয়ে রাখতে ইংল্যান্ড, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড থেকে আবর্জনা আমদানি করে তারা! কলেজে পড়ার জন্য কোনো টাকা দিতে হয় না এখানে। আর গ্রীষ্মের সময় সূর্য কখনোই নরওয়েবাসীকে বিদায় জানায় না। কাজেই মাঝরাতেও প্রখর সূর্যের আলোতে ক্রিকেট খেলার জন্য নরওয়ে হতে পারে আদর্শ জায়গা। কাজেই জীবনে একবারের জন্য হলেও নরওয়ে থেকে ঘুরে আসা অত্যাবশ্যক।
সুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ তম, যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ১৪ নম্বরে।
ফিচার ইমেজ- nationalgeographic.com