কখনও কি আপনার এমন মনে হয়েছে যে, আপনি শুধু ভাগ্যের ডানায় চড়েই সাফল্যের মুখ দেখেছেন? জীবনের যত অর্জন কেবলই দৈববলে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা? আপনার কি প্রায়ই মনে হয়, আপনি আজকে যে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছেন, প্রকৃতপক্ষে তার যোগ্য নন? যেকোনো সময় আপনার চারপাশের মানুষের কাছে এটি খোলাসা হয়ে যাবে যে, আপনি আদতে একজন প্রতারক? সাফল্য, অর্জন, দক্ষতা, যোগ্যতা এসবই আপনার চূড়ান্ত ভণ্ডামি?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকলে আপনি সম্ভবত ইম্পোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন। নিজের দক্ষতা,মেধা, শিক্ষা, প্রতিভা ইত্যাদির ওপর কোনো ধরনের বিশ্বাস না থাকার এ প্রবণতা সর্বপ্রথম আলোচিত হয় ১৯৭৮ সালে। মনোবিজ্ঞানী পলিন রোজ ক্ল্যান্স এবং সুজান ইমস তাদের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে এটি নিয়ে আলোকপাত করেন। তবে আমাদের আজকের এ আলোচনার বিষয়বস্তু ইম্পোস্টার সিনড্রোম নয়, বরং পলিন এবং সুজানের করা কাজটি যে বিষয়টির সূচনা করে, তা নিয়ে। পলিন এবং সুজান তাদের প্রবন্ধে একটি প্রস্তাবনা রাখেন যে, সম্ভবত নারীরা খুব বিশেষভাবে ইম্পোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও নিজেদের যোগ্যতার প্রতি আস্থাহীনতা এবং স্বীয় কর্মগুণে অর্জিত সাফল্যকে নিজের বলে ভাবতে না পারার চর্চা করে থাকেন, তবে নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটির ইতিবৃত্ত বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে আলাদা।
‘দ্য সিক্রেট থটস অভ সাক্সেসফুল ওম্যান’ বইয়ের লেখক ভ্যালেরি ইয়াং একজন ইম্পোস্টার সিনড্রোম বিশেষজ্ঞ। ইম্পোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আচরণে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন:
- পার্ফেকশনিস্ট ব্যক্তিরা নিজেদের জন্য অতি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ৯৯ শতাংশ অবধি অর্জন করলেও তারা খুঁতখুঁত করেন। খুবই সামান্য ভুল হলেও তারা নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন।
- বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা যেকোনো প্রজেক্ট শুরু করার আগে সম্ভাব্য প্রতিটি কোর্স, প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে চান। তারা অনুভব করে থাকেন যে, তাদের একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পৃথিবীর সকল তথ্য, জ্ঞান অর্জন করতেই হবে; এর কোনো অন্যথা হতে পারবে না। একটি চাকরির বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত সকল দক্ষতা, গুণাবলি না থাকলে তারা সে চাকরির জন্য আবেদন করেন না। কর্মক্ষেত্রে যেকোনো মিটিং চলাকালে তারা কোনোরকম প্রশ্ন করতে ভয় পান এবং আলোচনায় অনুৎসাহিত বোধ করেন এই ভেবে যে ভুল কিছু বলে ফেললে ভীষণ লজ্জা পেতে হবে সকলের সামনে।
- প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু অভ্যন্তরীণ বা বিল্ট ইন দক্ষতা থাকে অর্থাৎ এমন একটি জায়গায় পারদর্শিতা, যা তাকে অর্জন করতে হয়নি। সহজাতভাবেই প্রাপ্ত কোনো দক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই জীবনের সবক্ষেত্রে কাজে লাগবে না। ঠিক তখনই প্রশ্ন আসে অর্জিত দক্ষতার। তখন এসব ব্যক্তিকে সমস্যা সমাধানে বেগ পেতে হয়, কেননা, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রায় কোনো ধরনের অতিরিক্ত শ্রম, চিন্তা, প্রয়াস ছাড়াই সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। কিন্তু এবার বিধিবাম, তাদেরকে সচেতনভাবে শ্রম দিতে হচ্ছে, এই বিষয়টিই তাকে নাজেহাল করে দেয়। তিনি ভাবতে শুরু করেন যে, তিনি আসলে সে অর্থে ততটা দক্ষ নন বা একজন ইম্পোস্টার।
- ‘একলা চলো’ নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা কখনও অন্যের সাহায্য চাইতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। যেকোনো কাজ তারা সম্পূর্ণ নিজের উপর নির্ভর করেই করতে চান। সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি তাদের জন্য এ কারণে কঠিন, কারণ তখন তারা মনে করেন যে, তারা বাস্তবে প্রতারক বা অযোগ্য।
- সুপারম্যান বা সুপারওম্যান ঘরানার ব্যক্তিরা নিজেদেরকে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সফল দেখতে বদ্ধপরিকর থাকেন। আশেপাশের মানুষের থেকে সবসময় তারা একধাপ বেশি পরিশ্রম করতে চান শুধু এ কারণে যে তাদেরকে প্রমাণ করতেই হবে, তারা অযোগ্য নন। একজন ইম্পোস্টার নই আমি- শুধু এ ধারণাটি প্রতীয়মান করার জন্য তারা সবসময় নিজেদের উপর চাপ তৈরি করতে থাকেন।
নারীরা, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ইম্পোস্টার সিনড্রোমের শিকার হয়ে থাকেন মারাত্মকভাবে। ঠিক একইভাবে এলজিবিটিকিউ কিংবা আদিবাসী জনগণও এই সিনড্রোমে ভোগার ঝুঁকিতে থাকেন। এবারে এর কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
লিন ইন এর গবেষণামতে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট সংস্কৃতি নারীদের ইম্পোস্টার সিনড্রোমের উর্বরভূমি। তাদের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক পদে নারীদের নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির হার খুবই কম। ২০১৯ সালে তাদের পরিচালিত এক জরিপানুযায়ী, কোনো দলে প্রতি ১০০ জন পুরুষ নিয়োগের বিপরীতে মাত্র ৭২ জন নারী নিয়োগ পান। ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত পদগুলোর ৬২ শতাংশ পুরুষদের দখলে, যেখানে নারীরা অধিকার করে আছেন অবশিষ্ট ৩৮ শতাংশ। ক্যাটালিস্টের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে পরিচালকের মতো পদগুলোতে নারীদের উপস্থিতি ২৬.১ শতাংশ, যেটি ২০১৬ সালে ছিল ২০.৩। যুক্তরাজ্যে অবস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিছুটা অধিকতর সন্তোষজনক। ২০১৯ সালে নারীদের উপস্থিত ছিল ৩১.৭ শতাংশ, যেটি ২০১৬ সালে ছিল ২৫.৩।
নারীরা কোনো রোল মডেল খুঁজে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ, তাদের সামনে অনুসরণীয় কোনো নারী নেই। থাকলেও সেটা প্রচারের অভাবে বা সংখ্যার বিচারে প্রভাব বিস্তারকারী কিছু হতে পারছে না। এর ফলে কী হচ্ছে? কোনো একজন নারী সম্পূর্ণভাবেই তার নিজস্ব মেধা, শ্রমের মাধ্যমে যখন খুব উঁচু একটি পদে আসীন হচ্ছেন, তখন তিনি একধরনের অনিরাপদ বোধ করতে শুরু করেন। কারণ, পুরুষ যেখানে তার চারপাশে অসংখ্য রোল মডেল বা তারই মতো প্রচুর ‘হাই অ্যাচিভার’ দেখতে পাচ্ছেন, সেখানে নারী নিজেকে আবিষ্কার করছেন একদম একাকী। কর্পোরেট দুনিয়ায় তিনি যত উপরে উঠছেন, লৈঙ্গিক বিচারে তিনি নিজের সহচারী খুঁজে পাচ্ছেন না বললেই চলে। এই যখন শ্বেতাঙ্গ নারীদের অবস্থা, তখন ওম্যান অভ কালারস বা কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ঠিক কোথায় আছেন, বোঝাই যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার পরও পরিচালক পদে তাদের উপস্থিতি মাত্র ৫ শতাংশ। ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেড প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাসে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়া একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী হলেন জেরক্সের উরসুলা বার্ন্স, যিনি এ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৬ সালে।
বর্ণবাদী মনোভাব এবং লিঙ্গভিত্তিক তথাকথিত চিন্তাভাবনার প্রচার-প্রসার নারীদের ইম্পোস্টার সিনড্রোমের শিকার হওয়ার আরেকটি বড় কারণ। নারীরা গণিতে বা বিজ্ঞানে ভালো না, নারীদের বুদ্ধিমত্তা কম, আবেগ দিয়ে চিন্তা করার কারণে নারীরা বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, আদিবাসী এবং কৃষ্ণাঙ্গরা খুবই অলস, মাথামোটা এবং তাদের মাঝে ঐক্যের অভাব ইত্যাদি প্রচলিত ধারণাগুলো বহুল চর্চার ফলে মানুষের মনে পাকাপাকিভাবে অবস্থান করে নিয়েছে। এগুলোও নারীদের নিজেদেরকে ইম্পোস্টার ভাবতে বাধ্য করে।
সারা বিশ্ব জুড়ে নারীদের রূপের প্রশংসা একটি তুমুল জনপ্রিয় চর্চা। পশ্চিমা দেশগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে আকাশচুম্বী খ্যাতি অর্জন করলেও নারীদের প্রতি তাদের মনোভাব সেই তুলনায় খুব একটা প্রশংসনীয় নয়। বাহ্যিক রূপ কিংবা সৌন্দর্যের প্রশংসা করা হয় দু’ভাবে। প্রথমত, একজন নারীর চেহারার গুণকীর্তন করে তাকে পটানোর চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত, তাকে আকারে ইঙ্গিতে এটা বোঝানো যে, আপনার সাফল্য, অর্জন সবই আপনার শারীরিক সৌন্দর্যের দান। কর্মক্ষেত্রে এ বিষয়টি এত বেশি প্রচলিত যে, নারীরা নিজেরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটিকেই সত্য বলে বিশ্বাস করা শুরু করেন, বিশেষত তিনি যদি সত্যিই রূপবতী হয়ে থাকেন। অর্থাৎ দক্ষতা, জ্ঞান, মেধা ইত্যাদির প্রশংসা না করে রূপের প্রশংসা করার প্রথাও নারীদেরকে ইম্পোস্টার ভাবতে প্রেরণা যোগায়।
স্রেফ নারী হওয়াই কখনও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কীরকম? নারী-পুরুষ সমতা রক্ষা করতে গিয়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কখনও কখনও ইচ্ছাকৃতভাবেই নারীদেরকে নিয়োগ প্রদান করে। এখানে লক্ষ রাখা দরকার যে, এই কাজটি কেউ কেউ করে থাকে মানে এই নয় যে, এটিই সর্বক্ষেত্রের স্বীকৃত বাস্তবতা। নারীদের এহেন নিয়োগযোগ্য নারীদেরকেও একই কাতারে ফেলতে প্রলুব্ধ করে। নিজের যোগ্যতা, মেধা, প্রতিভা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার পরও অনেক নারীই বিশ্বাস করেন যে, তিনি শুধু আজ নারী বলেই এ জায়গায়। প্রতিষ্ঠানের নারী-পুরুষ ভারসাম্য রক্ষা নীতির আশীর্বাদেই তিনি আজকের অবস্থানে।
ইম্পোস্টার সিনড্রোম থেকে মুক্তি মিলবে তবে কী করে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সম্পূর্ণ মুক্তি মেলে না এ অনুভূতি থেকে। ইতিবাচক চিন্তাও কাজে দেয় না এক্ষেত্রে। মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ হচ্ছে, নিজেদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। নিজেদের বিশ্বস্ত কাউকে নিজের অনুভূতির পুরোটা খুলে বলতে পারলে তাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, যা কিনা খুবই সহায়ক হয়ে থাকে। নিজের সকল সফলতা, অর্জন, খ্যাতি খাতায় লিখে ফেললে তখন নিজের যোগ্যতা, মেধা, আন্তরিকতা, শ্রম ইত্যাদির মূল্য একদম স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখের সামনে। নিজের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার ক্ষেত্রে একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতেই হবে এমন নীতি অনুসরণ না করাটাই নিজের জন্য মঙ্গলজনক।