সম্প্রতি ফারিয়ার সাথে জুনায়েদের দীর্ঘ ছয় বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটেছে। সময়টা তার জন্য খুবই কঠিন। কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না ফারিয়ার সাথে কাটানো সুখস্মৃতিগুলোকে। ফারিয়া যেন তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। যা-ই সে করতে যাচ্ছে, মনে পড়ে যাচ্ছে ফারিয়ার কথা।
বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তাকে খুবই যন্ত্রণা দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই মেমোরি ফিচারটি ফারিয়ার সাথে কাটানো পুরনো কোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে তাকে। কিংবা ফারিয়া বিভিন্ন স্ট্যাটাস বা ছবি পোস্ট করছে, যা তার মনের জ্বালা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফারিয়ার স্ট্যাটাসগুলো দেখলে মনেই হয় না সম্প্রতি তার বিচ্ছেদ ঘটেছে। ছবিগুলোতেও সে বরাবরের মতোই হাস্যোজ্জ্বল।
সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখনো ফারিয়ার ভাবমূর্তি খুবই সুখী একজন মানুষের মতো। আর এ বিষয়টি কিছুতেই মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না জুনায়েদের পক্ষে। সে যেখানে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সইতে না পেরে প্রতিটি সেকেন্ড নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে, সেখানে ফারিয়া কীভাবে এতটা স্বাভাবিক রয়েছে! কেন ফারিয়াও তার মতো সমান কষ্ট পাচ্ছে না!
এসব চিন্তা জুনায়েদের কষ্টকে আরো যেন উসকে দিচ্ছে। রাতের পর রাত সে এসবই ভেবে চলেছে। ফেসবুকের নিউজফিডে বারবার ফারিয়ার বিভিন্ন পোস্ট আসছে। কিংবা কখনো কখনো সে নিজেই ফারিয়ার টাইমলাইনে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, ফারিয়া কোথায় কী লিখেছে। যত দেখছে, তার কষ্ট ততই বাড়ছে। ক্রমাগত বিষণ্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার মন।
দৈনন্দিন জীবনের কোনো কাজকর্মই জুনায়েদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। পড়াশোনা কিংবা পার্ট-টাইম চাকরি, নিজের শখের লেখালেখি অথবা টিএসসিতে স্বপন মামার দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা- সবই যেন লাটে উঠেছে। আবার যখন তার মনে এমন ভাবনা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে যে বিচ্ছেদের ফলে সে নিজে এতটা প্রভাবিত হলেও, ফারিয়া তো ঠিকই আছে, তখন নিজেকে আরো বেশি পরাজিত বলে মনে হচ্ছে তার। প্রচণ্ড ক্রোধ ও আক্রোশ দানা বাঁধছে তার মনে। এভাবে একটার পর একটা নেতিবাচক চিন্তার ফলে জুনায়েদের কষ্ট চক্রবৃদ্ধি হারে কেবল বাড়ছে।
একা একা এই চরম দুঃসময় পাড়ি দিতে না পেরে, একপর্যায়ে জুনায়েদ তার যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের কথা খুলে বলল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাকিবকে। সব শুনে সাকিব বলল, “এখনই ফারিয়াকে ব্লক মেরে দে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম থেকে।” এমন পরামর্শে জুনায়েদ যেন আকাশ থেকে পড়ল, “না না, তা কী করে হয়, এটা তো খুবই ছেলেমানুষি, ইম্যাচিউর একটা কাজ হবে!” উত্তরে সাকিব বলল, “এই যে তুই প্রতিদিন ফারিয়াকে স্টক করছিস আর কষ্ট পাচ্ছিস, এটা বুঝি খুব ম্যাচিউর কাজ হচ্ছে?”
আসলেই তা-ই। আমাদের অনেকের মনেই একটা ভুল ধারণা জন্মে গেছে যে, যেমন করেই হোক নিজেকে সবার কাছে ‘ম্যাচিউর’ প্রতিপন্ন করতে হবে, কিছুতেই নিজের ইগো বিসর্জন দেয়া যাবে না। তাই তো, বিচ্ছেদের পর “সব ঠিক আছে” কিংবা “আমি খুবই শক্ত” প্রভৃতি প্রমাণের উদ্দেশ্যে উঠে-পড়ে লাগে অনেকে। সেই উঠে-পড়ে লাগারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় প্রাক্তনের সাথে সম্পর্ক ছেদ না করা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাক্তনের সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন করতেই হবে, এমনটি কিন্তু একবারও বলছি না। তবে পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে আপনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করছেন না, অথচ প্রাক্তনের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তা আপনার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিছুতেই আপনাকে তার ব্যাপারে ভুলতে দিচ্ছে না, সেরকম ক্ষেত্রে প্রাক্তনকে ব্লক করে দেয়াই যুক্তিযুক্ত।
এর স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের বিখ্যাত রিলেশনশিপ থেরাপিস্ট ড. গ্যারি ব্রাউন। তার মতে, বিচ্ছেদের পর প্রথম যে কাজটি করা উচিত তা হলো প্রাক্তনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লক বা মিউট করে দেয়া।
আমার উপদেশ হবে এটিই যে, কোনো ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তাকে (প্রাক্তনকে) দেখা, তার সাথে কথা বলা বা অন্য কোনো ধরনের যোগাযোগ বজায় রাখা আপনার উচিত হবে না- অন্তত ৯০ দিনের জন্য। এই সময়টুকু আপনার প্রয়োজন হবে শোক কাটিয়ে উঠে, জীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। কোনো কিছু হারানোর পর সঙ্গত কারণেই আমরা সবাই প্রাথমিকভাবে একটা মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাই। এ অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সময়ের কোনো বিকল্প নেই।
অর্থাৎ বিচ্ছেদের পর নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থিত করে তোলার জন্যই প্রয়োজন কিছুটা সময়ের। আর সেই সময়টুকু পাওয়া যাবে প্রাক্তনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লক করে দেয়ার মাধ্যমে। কারণ সে যদি আপনার ব্লকলিস্টে থাকে, তাহলে বারবার তার বিভিন্ন স্ট্যাটাস বা ফটো আপডেট এসে আপনাকে বিরক্ত করবে না, হুটহাট বিভিন্ন মেমোরি দেখিয়ে তার কথা মনে করিয়ে দেবে না। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, প্রাক্তনের টাইমলাইন ঘাঁটা বা স্টকিংয়ের মতো বিষাক্ত একটি কাজ থেকে আপনি বিরত থাকতে পারবেন। এর বদলে আপনি যথেষ্ট সময় পাবেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে, নিজের মতো করে নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়ার।
তবে একটি কথা, নিজের মূল আইডি থেকে প্রাক্তনকে ব্লক করে দিয়ে অন্য কোনো ফেক আইডি খুলে, বা কোনো বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের আইডি থেকে প্রাক্তনকে স্টক করার কথা ভুলেও ভাববেন না যেন!
২০১২ সালে Cyberpsychology, Behavior and Social Networking নামক জার্নালে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখানো হয়েছে যে কীভাবে বিচ্ছেদ পরবর্তী সময়কালে সাবেক রোমান্টিক দম্পতিদের মধ্যকার সম্পর্ককে আরো বিষিয়ে দিয়ে, তাদের জীবনে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা পালন করে ফেসবুক। অবশ্য সেখানে এমন কোনো উপদেশ দেয়া হয়নি যে প্রাক্তনকে আপনার ব্লকই করে দিতে হবে। কিন্তু সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল ফেসবুক স্টকিংয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো। এবং এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, প্রাক্তন যদি ফ্রেন্ডলিস্টে থাকে, কিংবা সাধারণভাবেও তার আইডি ফেসবুকে দৃশ্যমান হয়, তবে তাকে স্টক করার একটি প্রবণতা দেখা দেয়ই। জানতে ইচ্ছা করেই, “দেখি তো ও কী করছে! ওর কি আমার কথা মনে পড়ছে!” আর সেজন্যই, নিজেকে ক্রমাগত স্টকিং থেকে সংযমে রাখার চাইতে, সরাসরি প্রাক্তনকে ব্লক করে দেয়াই হবে বেশি সহজ কাজ।
তাছাড়া বিচ্ছেদের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার প্রাক্তনকে দেখতে পাওয়া ভগ্নহৃদয় প্রেমিক বা প্রেমিকাকে দ্বিধান্বিতও করে তুলতে পারে, এবং তাদের মনে অফুরন্ত আফসোসের জন্ম দেয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ বিষয়ে কথা বলেছেন নিকোল রিচার্ডসন, যিনি একজন নিবন্ধিত কাউন্সেলর এবং ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামিলি থেরাপিস্ট। বিচ্ছেদের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাক্তনকে দেখতে পেলে কী হয়, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
আপনি তখন বারবার নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে থাকবেন। আপনার মস্তিষ্ক এমনভাবে গঠিত হয়েছে যে সে সব সময় স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে বেড়ায়। আপনি যদি কখনো সঠিক কাজটিও করে থাকেন, তারপরও আপনার মস্তিষ্ক সে সম্পর্কে সন্দিহান থাকে, এবং বারবার আপনার সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। বারবার সে আপনাকে আপনাদের প্রেমের আনন্দময় মুহূর্তগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, এবং আপনার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়- আসলেই কি আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নাকি আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
ইউনিভার্সিটি অব নেভাদার অধ্যাপক কোর্টনি ওয়ারেনের মতে, প্রাক্তনের সাথে বিচ্ছেদের পরও বন্ধু হয়ে থাকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তার সাথে যোগাযোগ টিকিয়ে রাখা আদৌ উচিত কি না, সে বিষয়ে গভীরভাবে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ক্রমাগত প্রাক্তনের ব্যাপারে নিত্যনতুন তথ্য লাভ করা আপনার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আপনি যতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন না কেন, প্রাক্তনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখার পর সে বিষয়ক নানা চিন্তা আপনাকে পিছন থেকে টেনে ধরতে পারে, আপনার “মুভ অন” করার প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিতে পারে। এমনটিই যদি হয়, সেক্ষেত্রে নিজে থেকেই প্রাক্তনকে ব্লক করে দেয়া হবে বুদ্ধিমানের মতো কাজ।
বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভুলতে প্রাক্তনকে ফেসবুক থেকে ব্লক করার মাধ্যমে সুফল পাওয়া একজন হলেন হাফিংটন পোস্টের লেখক ক্রিস্টেন কোঙ্গার। তিনি তার এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে লিখেছেন,
ফেসবুক ব্লকের বিষয়টিকে শুরুতে আমার প্রাক্তন ধরে নিয়েছিল ভার্চুয়াল জগতেও আমার প্রতিক্রিয়া দেখানো ও কিছু একটা প্রমাণের প্রচেষ্টা হিসেবে। কিন্তু আমার কাছে মূল ব্যাপারটি হলো: বিচ্ছেদই তো যথেষ্ট কষ্টের একটি বিষয়, তাহলে আমাদের কি উচিত না ফেসবুকেও যেন সেটির রেশ বজায় না থাকে তা নিশ্চিত করা?
সুতরাং এ বিষয়টি তো বোঝাই যাচ্ছে, বিচ্ছেদের পর ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাক্তনকে ব্লক করা যে কারো জন্য স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথে খুবই সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিচ্ছেদ মানে তো মানুষটির সাথে সম্পর্ক ছেদ করেই ফেলা, তাই না? তাহলে আপনি তাকে ব্লক করায় সে আপনাকে ইম্যাচিউর ভাবল কি না বা আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করল কি না, তাতে কি আদৌ কিছু যায় আসে? আসে না। এবং এতে আপনার আত্মসম্মানও এতটুকু কমে না। অন্য সব কিছুর আগে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই ভাবা উচিত। আপনার প্রাক্তন ভালো আছে না মন্দ, সে ব্যাপারে ভাবার আগে প্রয়োজন নিজের জীবনকে, নিজের ভালো থাকাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া।
তবে এখনো অনেকের মনেই ছোট একটি খটকা থেকে যেতে পারে: শুধু প্রাক্তনকে ব্লক করাই কি যথেষ্ট, যদি আপনি তার অন্যান্য কাছের বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথেও সংযুক্ত থাকেন? তাদের বিভিন্ন পোস্ট থেকেও তো প্রাক্তনের ব্যাপারে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার আপনার সামনে চলে আসতে পারে। তাছাড়া যেহেতু আপনার চেয়ে আপনার প্রাক্তনের সাথেই তাদের সম্পর্ক বেশি গভীর, তাই আপনাদের দুজনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে তারা আপনার প্রাক্তনের পক্ষই নেবে, এবং আপনাকেই দায়ী করবে। তাই পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আগে তাদেরকেও ব্লক না করুন, অন্তত সাময়িকভাবে আনফলো বা মিউট করে রাখতেই পারেন। আর যদি ব্লকও করেন, আপনার উচিত হবে আগে এ ব্যাপারে তাদের কাছে নিজের অবস্থান পরিষ্কার নেয়া।
একদম শেষ কথা হলো: প্রাক্তনকে কি আজীবন ব্লক করে রাখবেন? সেরকম কোনো প্রয়োজনীয়তা কিন্তু নেই। আপনার কাছে তার গুরুত্ব বা প্রাধান্যও সারা জীবন একই রকম থাকবে না। যখন আপনি আপনার প্রাক্তনকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন, তার প্রতি আপনার মনে প্রচণ্ড রকমের বিদ্বেষ বা ক্রোধ থাকবে না, এবং সে আপনার জীবনে “ম্যাটার” করার মতো ব্যক্তিও আর থাকবে না, তখন তাকে আনব্লক করে দেয়াটাই উচিৎ হবে। এবং তারপর মন চাইলে একটি স্বাস্থ্যকর দূরত্ব বজায় রেখে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা বা কুশলাদিও বিনিময় করতে পারেন, যেমনটি আমরা করে থাকি পরিচিত যে কারো সাথে।
লাইফস্টাইলের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/