১৬ শতকের দিকে জাপান পুরোটাই বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। বিভক্তির এই সময়টাকে বলা হয় সেনগোকু পিরিয়ড। জাপান তাদের যে ঐতিহ্যগত সামন্ততান্ত্রিক গঠনের জন্য বিখ্যাত ছিলো তা পুরোপুরি ভেঙ্গে যায় এই সময়টিতেই। চারিদিকে ছিলো না কোনো প্রকারের শৃঙ্খলা। সেই সাথে ঘন ঘন যুদ্ধবিগ্রহ তো লেগেই ছিলো।
শক্তিশালী নেতারা এবং তাদের অনুসারী সামুরাইগণ প্রায়ই একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। আবার ঠিক সেই সময়েই জাপান ইউরোপিয়ানদের দ্বারা প্রবর্তিত উন্নত সব জ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতেও হিমশিম খাচ্ছিলো। এককথায় পুরো বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে জাপান তাদের সময় অতিবাহিত করছিলো।
ঠিক সে সময়েই আবির্ভাব হয়েছিলো ওডা নবুনাগার, যিনি সেই বিভক্ত জাপানকে এক করতে চেয়েছিলেন। নবুনাগার দুটি প্রকৃতিজাত গুন ছিলো। তার মধ্যে শাসন করার ইচ্ছে ছিলো প্রবল, আর তিনি সঠিক সময়ে প্রচণ্ডভাবে কঠোর হতে পারতেন। এই দুই নিজস্ব গুণকে সম্বল করে নবুনাগা তখনকার ভেঙে পড়া সেই জাপানকে যুক্ত করার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় নেমে পড়েন।
তবে মজার ব্যাপার হলো, নবুনাগাকে কেউই জাপানের যুক্তকারী শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে ভাবতে পারেনি প্রথমে। কারণ ছোটবেলা থেকে নবুনাগা ঠিক অন্য নামে পরিচিত ছিলো সকলের মাঝে। আর তা হলো, ‘ওয়ারীর বোকা ছেলে’। এর পেছনে কারণও ছিলো যথেষ্ট!
ওডা নবুনাগার বাবা ছিলেন কেন্দ্রীয় জাপানের সামরিক বাহিনীর মিলিটারি গভর্নর। বাবার এমন ক্ষমতার জন্যই হোক বা অন্য কিছু; নবুনাগাকে ছোটবেলা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা ছিলো বেশ মুশকিলের একটি কাজ। এলাকার অন্যান্য ছেলেদের সাথে সে চারপাশ চষে বেড়াতো এবং বিভিন্ন ধরনের হাঙ্গামা বাধিয়ে সকলের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতো। সেসময়ে আবিষ্কার হওয়া ম্যাচলক রাইফেল নিয়ে দাঙ্গাবাজী করাটাও ছিলো তার নিত্যদিনের রুটিন। তার এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে, এই অল্প বয়সে ধড়িবাজ হওয়া ছেলেকে তখন সকলে নাম দিয়েছিলো ‘ওয়ারীর বোকা ছেলে’ নামে।
তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে, যখন নবুনাগার বাবা মারা গেলেন, তখন তার বাবার খুব কম সংখ্যক যোদ্ধারাই ইচ্ছুক ছিলো তার মতো উচ্ছৃঙ্খল কাউকে অনুসরণ করতে। আর এই সুযোগটা পেয়ে নবুনাগার চাচা নবুতোমো নিজেকে ওয়ারীর নেতা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দেন। কিন্তু নবুনাগা বোকা হোক বা যা-ই হোক, সে লড়াই ছাড়া তা কখনোই হতে দেয়ার মতো পাত্র ছিলো না।
নবুনাগা হাতেগোনা কয়েকজন অনুসারী জোগাড় করে কিয়োসু কেল্লার পাশে তার চাচাকে লড়াইয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। লড়াইয়ে তার চাচা সম্মতি জানায়। আর সে লড়াইয়ে নবুনাগা তার চাচাকে পরাজিত করে। পরাজিত হবার পর নবুতোমো আত্মহত্যা করেন। ফলে নবুনাগার একচ্ছত্র শাসনকার্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এমন একজন কমে যায়।
নবুনাগা যে কতখানি নির্মম স্বভাবের ব্যক্তি ছিলেন তা তার পরবর্তী কাজ থেকে জানা যায়। পরবর্তী শাসনামলে যাতে কোনো প্রকারের হুমকির মুখে না পড়েন সেই চিন্তা করে তিনি তার আপন ছোট ভাইয়ের গুপ্তহত্যারও ব্যবস্থা করেন। আর তার ভাইয়ের মৃত্যুর ফলে তার শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করার মতো আর কেউই থাকলো না ওয়ারীতে। তিনিই হয়ে উঠলেন সেখানকার একচ্ছত্র অধিপতি।
নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান করে নবুনাগা এবার রাজ্যের বাইরের দিকে নজর দিলেন। প্রথমেই মনোযোগ দিলেন তাদের শত্রু ইমাগাওয়া গোষ্ঠীর দিকে। ইমাগাওয়া জাতির নেতা ছিলেন ইমাগাওয়া ইয়োশিমতো, যিনি ছিলেন তৎকালীন জাপানের সবচেয়ে শক্তিশালী সামন্ততান্ত্রিক নেতাদের মধ্যে একজন। ১৫৬০ সালের দিকে ইয়োশিমতো সিদ্ধান্ত নিলেন, তার ‘শোগান’ (দেশের অন্যতম বিরাট জমিদার বা অধিরাজ) হওয়ার মতো উপযুক্ত সময় এসে গিয়েছে। কিন্তু নবুনাগা অবশ্যই তা এত সহজে হতে দিতে পারেন না!
তাই যখন ইয়োশিমতো ৪০,০০০-এর বিরাট এক সেনাদল গঠন করলেন রাজধানী শহর কিয়োটো আক্রমণ করার লক্ষ্যে, নবুনাগা নিজে তার এক সৈন্যদল গঠন করলেন ইয়োশিমতোকে থামানোর জন্য। কিন্তু সমস্যা যা হয়েছিলো তা হলো নবুনাগা মাত্র ৪,০০০ সৈন্য যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সংখ্যায় অনেক কম হওয়ায় নবুনাগা সিদ্ধান্ত নিলেন শহর রক্ষা করার থেকে বরং তিনি ইয়োশিমতোকেই সরাসরি আক্রমণ করবেন!
হিসেব করলে ইয়োশিমতোর ১০ জন সৈন্যের বিপক্ষে নবুনাগার ছিলো শুধু ১ জন করে। তাই মনে হতে পারে, এ ধরনের আত্মঘাতী আক্রমণ করা শুধু পাগল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সম্ভব! কিন্তু আসলে নবুনাগার মাথায় অন্যরকম পরিকল্পনা সাজানো ছিলো আগে থেকেই।
নবুনাগা প্রচুর পুতুলের সামুরাই সৈন্য তৈরি করেছিলেন খড় দিয়ে ও উপযুক্ত পোষাক পরিয়ে। তারপর সেগুলোকে তার সেনাদলের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে দূর থেকে শত্রুরা মনে করে প্রচুর সামুরাই শত্রুসেনা তাদেরকে আক্রমণ করছে। সব প্রস্তুতি শেষে নবুনাগা তার সৈন্যদল নিয়ে দ্রুত আক্রমণ করে বসেন ইয়োশিমতোর শত্রুশিবিরে।
নবুনাগার ছোট্ট এই সেনাদল ঝড়ের বেগে সরাসরি আক্রমণ করে বসে। ইয়োশিমতো প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো তার নিজের দলের মধ্যেই কোনো গণ্ডগোল লেগে যুদ্ধ লেগে গিয়েছে। কারণ নবুনাগার দলটি ছিলো অনেক ছোট। কিন্তু তার এই ধারণা খুব দ্রুতই ভুল প্রমাণিত হয় যখন নবুনাগার দুজন চতুর সৈন্য সারির মধ্যে থেকে বের হয়ে ইয়োশিমতোর ছাউনিতে গিয়ে তাকে আক্রমণ করে বসে এবং তার দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। দলনেতার এমন মৃত্যুর পর ইয়োশিমতোর বাকি সৈন্যরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
তার পরবর্তী দুই যুগ ধরে নবুনাগা তার কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করে গিয়েছেন দেশজুড়ে। যারা তার বিরোধিতা করার চেষ্টা করেছে এবং যাকেই তার শত্রু বা হুমকিস্বরূপ মনে হয়েছে তাকেই তিনি সরিয়ে দিয়েছেন নিজের পথ থেকে। নবুনাগার এই সফলতার পেছনে একটি অন্যতম কারণ ছিলো তার আগ্নেয়াস্ত্রের সঠিক ব্যবহার। যদিও জাপানে তখন আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচলন চালু হয়ে গিয়েছিলো, নবুনাগা সেগুলো অত্যধিক মাত্রায় ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন নিজেদের সেনাদলের মধ্যে।
তিনি তার সৈন্যদের সারিসারিভাবে নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাতেন। যেহেতু তখনকার অস্ত্রগুলোর রিলোড টাইম ছিলো অনেক বেশি, তাই তিনি যে প্রচলনটি চালু করেছিলেন তা হলো প্রথম সারি প্রথমে গুলি করবে। রিলোড করার সময় তারা বসে পড়ে রিলোড করবে এবং সে সময়ে পেছনের দ্বিতীয় সারি গুলি করবে শত্রুদের দিকে। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে সবসময় গুলি চলতেই থাকবে।
সেই সাথে নবুনাগা তাদের সৈন্যদের পরিচালনা করার চিরাচরিত ঐতিহ্যও ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি দল পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সেনাদের ক্ষমতার প্রাধান্য দিয়েছেন, তাদের বংশের উত্তরাধিকার ক্ষমতার বিপরীতে। অর্থাৎ পরিবারের সম্পৃক্ততার বদলে তার যাকে উপযুক্ত মনে হয়েছে তাকেই তিনি সেনাদল পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। যেমন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেনারেল ছিলেন টয়োটমি হিডেয়োশি, যিনি শুরুটা করেছিলেন সাধারণ একজন নীচু শ্রেণীর কৃষক পর্যায়ের সেনা হিসেবে। কিন্তু তার অসাধারণ যুদ্ধকৌশল এবং শাসন করার গুণ থাকায় তিনি পরবর্তীতে নবুনাগা কর্তৃক উচ্চপদস্থ লেফটেন্যান্ট হন।
১৫৮২ সালের দিকে নবুনাগা অর্ধেক জাপানের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যান। তিনি ছিলেন তখনকার অন্যতম শক্তিশালী সামন্ততান্ত্রিক নেতাদের একজন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এজন্য তার শত্রুরও অভাব ছিলো না। এবং তারা তখন সবাই একজোট হয়ে পরিকল্পনা করা শুরু করেছিলো যে কিভাবে নবুনাগাকে তার পদ থেকে নামানো যায়।
সে বছর নবুনাগা তার একজন জেনারেল থেকে একটি বার্তা পান। ওকায়ামার নিকটবর্তী একটি কেল্লার দখল নিতে অতিরিক্ত সৈন্যের আবেদন চেয়ে বার্তাটি পাঠানো হয়েছিলো। নবুনাগা একটি সৈন্যদল নিয়ে সেদিকে রওনা দেন। কিয়োটোর কাছাকাছি হোন্নো-জির একটি মন্দিরে তিনি বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামেন এবং তার সৈন্যদলকে এগিয়ে যেতে বলেন।
পরের দিন সকালে যখন তিনি ঘুম থেকে উঠলেন, দেখলেন তার সেই মন্দিরটির চারপাশ সামুরাই দিয়ে ঘেরা। যোদ্ধাদের সেখানে এনেছিলো নবুনাগার নিজেরই একজন জেনারেল, একেচি মিতসুহিদে। মিতসুহিদের অনেক আগে থেকেই নবুনাগার উপর রাগ ছিলো, কারণ নবুনাগা তাকে কয়েকবার সবার সামনে অপমান করেছিলেন। প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পেয়ে মিতসুহিদে মন্দিরটিতে আগুন লাগিয়ে দেন।
মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নবুনাগা প্রচলিত আনুষ্ঠানিক আত্মহত্যা সম্পন্ন করেন। নবুনাগার মৃত্যুর পর মিতসুহিদে নবুনাগার আসনে আসীন হবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা ইতোমধ্যে টয়োটমি হিদেয়োশির কাছে পৌঁছে যায়। তিনি দ্রুত তার সেনাদল নিয়ে কিয়োটোর দিকে অগ্রসর হন ও পরবর্তীতে মিতসুহিদের সেনাদের পরাজিত করেন। মিতসুহিদে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে কিছু সামুরাইয়ের হাতে ধরা পড়ে মারা যান। নবুনাগা এবং তার ছেলে হোন্নো-জিতে মারা যাওয়ায় হিদেয়োশি এরপর জাপানের সর্বোচ্চ অধিরাজের আসনে আসীন হন।
হিদেয়োশি শাসন পেয়ে নবুনাগার সেই মিশন অর্থাৎ বিভক্ত জাপানকে এক করার কাজ চালিয়ে যান। যে কাজটি তার নিজের উত্তরাধিকারী টকুগাওয়া ইয়েয়াসু পরবর্তীতে সফলভাবে পরিপূর্ণ করেছিলেন। এ নিয়ে জাপানী একটি উক্তিও প্রচলিত রয়েছে, “নবুনাগা জাতীয় চালগুলো পিষেছিলো, হিদেয়োশি সেগুলো দিয়ে কেক বানিয়েছিলো এবং ইয়েয়াসু বসে সেই কেক খেয়েছিলো!”
আর এই ছিলো নবুনাগার সাফল্যগাথা। প্রথমদিকে যে ব্যক্তিটিকে সবাই বোকা বলে ডাকতো, জানতো; জাপানে এখন তাকেই সবাই জাপানের ‘মহান সংযুক্তকারী’ হিসেবে চেনে।
ফিচার ইমেজ: konangan.tk