অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৩: নিকোলাস ফ্লামেলের রহস্যময় জীবন

‘ইহুদী যুবরাজ আব্রাহাম’ এর লেখা ২১ পৃষ্ঠার বইটি হাতে পেয়ে উলটে পালটে দেখলেন নিকোলাস ফ্লামেল। কোণাগুলো ছিল সোনায় মোড়ানো। নিকোলাস যেহেতু এ ক’দিনে আলকেমি নিয়ে পড়েছেন, তাই সেই বইয়ের চিহ্ন দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না তার যে এটা আলকেমি নিয়ে বই। 

“আমি কি পারবো এ বইটি পড়তে?” ভাবলেন নিকোলাস। বইয়ের সব ভাষা যে তিনি পড়তে পারছেন না। তিনি সেই বই এর কিছু পাতার লেখা নিজে লিখে নিলেন আর সেই লেখা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এমন কারো খোঁজে যিনি বলতে পারবেন কী লিখা আছে এখানে।

কিন্তু পদে পদে তিনি অবিশ্বাসীদের বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই পেলেন না। শোনা যায়, একুশটি বছর কেটে গিয়েছিল এভাবে। বইটি পাওয়ার আগে একদিন নিকোলাস স্বপ্নে দেখেছিলেন, এক ফেরেশতা এসে তাকে বই দেখিয়ে বলছেন, “এ বইটা দেখ, নিকোলাস। প্রথমে তুমি এ বইয়ের কিছুই বুঝবে না, কেউই বুঝবে না। কিন্তু একদিন তুমি এমন কিছু উদ্ধার করবে এ বই থেকে, যা কেউ পারবে না।”

বইটির গোড়াতেই লেখকের নামের পরে অভিশাপ লেখা ছিল এমন যে কারও উদ্দেশ্যে যে কি না এ বইটি পড়বার চেষ্টা করবে অথচ কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি বা পুরোহিত নন। এটা বরং নিকোলাসকে আরও উস্কেই দিয়েছিল।

প্যারিসে নিকোলাসের বাসা; Source: Wikimedia Commons

প্যারিসে এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে তিনি সাহায্য পাবেন এ বইয়ের ব্যাপারে। ইতোমধ্যে তিনি জেনে গেছেন, এ বইয়ের অনেক লেখাই প্রাচীন হিব্রুতে। সেটি স্বাভাবিক, কারণ একজন ইহুদীর লেখা এ বই। তাকে এখন বের হতে হবে জ্ঞানী কোনো একজন ইহুদীর খোঁজে।

নিকোলাস জানতেন, ফ্রান্স থেকে ইহুদিদের বহিষ্কার করা হয়েছে তখন। অনেক ইহুদি পালিয়ে গিয়েছে স্পেনে- স্পেনের মালাগা আর গ্রানাডাতে। সেখানে তখন অনেক ইহুদীর বাস। মুসলিম রাজত্বের অধীনে তারা সেখানে বসবাস করছে শান্তিতেই। সেখানে তারা প্লেটো আর অ্যারিস্টটল এর বইসহ অনেক নিষিদ্ধ বইও অনুবাদ করছিল, প্রচারও করছিল।

নিকোলাস ভাবলেন, স্পেনে গেলে তিনি হয়তো কাব্বালাতে (ইহুদি আধ্যাত্মিক জাদুবিদ্যা) পারদর্শী কাউকে পেয়ে যাবেন। তার সহায়তায় তিনি হয়তো বইটা অনুবাদ করে ফেলবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। সেকালে এত দূরে ভ্রমণ অনেক কষ্টের আর বিপজ্জনক ছিল। তিনি তীর্থযাত্রার নাম করে বেরিয়ে পড়লেন। প্রতিবেশীরাও জানলেন, তিনি তীর্থে যাচ্ছেন। কেউ জানলো না, তার আসল উদ্দেশ্য কী। একমাত্র জানতেন তার স্ত্রী পেরেনেল ফ্লামেল।

নিকোলাসের বাসার ফলক; Source: Wikimedia Commons

নিকোলাস সাথে নিয়ে গেলেন সাবধানে কপি করা সেই বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা। তা-ও আবার লুকিয়ে। নিকোলাসের সেই ভ্রমণে আদৌ কোনো বিপদ এসেছিল কি না আমরা জানি না। কারণ, তিনি সেই সম্পর্কে কিছুই লিখে যাননি। হয়তো কোনো ঝামেলাই হয়নি। হলে হয়তোবা লিখতেন। তিনি কেবল বলেছেন, তিনি তীর্থের নামে বেরিয়ে পড়েন।

তিনি স্পেনে পৌঁছে ইহুদীদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। কিন্তু, ইহুদীরা খ্রিস্টানদের সন্দেহের চোখে দেখতো, তা-ও আবার ফরাসি! ফরাসি খ্রিস্টানরাই তো ইহুদীদের দেশছাড়া করেছিল।

কিন্তু নিকোলাসের হাতে সময় বেশি নেই, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেশে তার জন্য অপেক্ষা করছে তার স্ত্রী, তার বইয়ের দোকান। অনেক চেষ্টা করেও নিকোলাস পেলেন না এমন কারো সান্নিধ্য। হয়ত শেষ পর্যন্ত কেউই তাঁকে বিশ্বাস করেনি। তিনি ফিরতি যাত্রা শুরু করলেন।

যাত্রাপথে তিনি থামলেন লিওন নামের জায়গায়। সেখানে এক পানশালাতে রাত কাটাবেন। রাত্রে খাবার টেবিলে বসলেন, সাথে এক ফরাসি ব্যবসায়ী, বোলোন থেকে আসছেন। দুঃখের কথা শোনালেন তাকে নিকোলাস।

ভাগ্যের ব্যাপার, সেই ব্যবসায়ীর সাথে এক জ্ঞানী ইহুদীর খাতির ছিল- মায়েস্ত্রো কানশেস। লিওনেই থাকেন; বুড়ো মানুষ। নিকোলাস সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, যাবেন তিনি তার কাছে।

অবশেষে তিনি দেখা করতে গেলেন মায়েস্ত্রো কানশেসের সাথে, কথাও বলা শুরু করলেন। একটু আধটু হু হা করলেন বুড়ো, কিন্তু তেমন একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেন না তার নিকোলাস। নিকোলাস বললেন, ইহুদীদের বইগুলো পড়ে কত কিছু জানতে পেরেছেন তিনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। বুড়ো মানুষ এরপরও কিছু বলেন না।

তখন নিকোলাস উচ্চারণ করলেন আব্রাহামের নাম- ঐ বইয়ের লেখক। ইহুদী আব্রাহাম ইলিয়েৎসার। সাথে সাথে বুড়ো মানুষ চমকে তাকালেন তার দিকে!

নিকোলাস খুশি হয়ে গেলেন! এ বুড়ো জানেন আব্রাহামের কথা!

পরে বুড়ো ভদ্রলোক বলা শুরু করলেন, কে এই আব্রাহাম ইলিয়েৎসার। ইহুদী যুবরাজ, কাব্বালার উচ্চসাধক। সবচেয়ে বিখ্যাত আলকেমির জন্য। তার বিখ্যাত বই ছিল একটি। কিন্তু শত বছর আগেই সেটা হারিয়ে গিয়েছে। কেউ জানে না বইটি কোথায় এখন। বুড়ো কানশেস সারা জীবন খুঁজেছেন সে বই, কিন্তু পাননি। এখন তো বয়স হয়ে গেছে। স্বপ্ন ছিল সে বই খুঁজে বের করবেন। 

তখন নিকোলাস বের করে দিলেন পাতাগুলো। বুড়ো তো লেখাগুলো দেখে খুশিতে আর বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেন। জীবনের গোধূলিলগ্নে এসে সন্ধান পেলেন এই রত্নের।

সারা রাত কেটে গেল দুজনের আলোচনায়। সেই কবে থেকে মায়েস্ত্রো অনুবাদ করে আসছেন হিব্রু, তাই তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না সেটা। তিনি নিকোলাসকে শিখিয়ে দিলেন কী কী করতে হবে, প্রতীকগুলোর অর্থ কী।কিন্তু যে ক’টা পাতা নিকোলাস সাথে এনেছিলেন সেগুলো যথেষ্ট ছিল না, বুড়োর আরও জানা লাগবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিকোলাসের সাথে প্যারিস যাবেন। কিন্তু ইহুদীরা তো ফ্রান্সে যেতে পারবে না। তাহলে কী করার?

ফ্লামেলের একটি পোর্ট্রেইট; Source: Wikimedia Commons

বুড়ো শেষ বয়সে এসে খ্রিস্টান হলেন। এরপর রওনা দিলেন প্যারিসের উদ্দেশ্যে। কিন্তু, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। অরলিন্সের কাছে আসতেই খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন বুড়ো। ফ্লামেল অনেক চেষ্টা করলেন তাকে সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু সে আর হলো না। সাত দিনের মাথায় বুড়ো মারা যান। সান্তা ক্রক্স চার্চে তিনি তার কবর দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।

ব্যথিত নিকোলাস ফ্লামেল বাকি যাত্রা শুরু করলেন অরলিন্স থেকে। এরপর প্যারিস এসে পৌঁছালেন। অনেক দিন পর স্ত্রী পেরেনেলের সাথে দেখা। তার দোকান, তার কর্মচারীরা, তার পাণ্ডুলিপিগুলো- সবই ঠিক আছে। কিন্তু মন মানে না, তিনি যে পারলেন না পুরোটা জানতে।

তখনই তার মনে হলো, তিনি যতটা শিখেছেন সেটা দিয়েই তো রহস্য অনেকটা সমাধান করতে পারেন। তাই তিনি বসে পড়লেন কাজে। তিনি পুরোটা না বুঝলেও যথেষ্ট বুঝে ফেললেন তিন বছরে। এই তিন বছরে তিনি ব্যাপক গবেষণাও করে ফেললেন। হাতে-কলমে কাজ করলেন।

এ সময়ই তিনি তার জীবনের প্রথম ট্রান্সমিউটেশন করেন বলে শোনা যায়। ট্রান্সমিউটেশন মানে এক ধাতু থেকে অন্য ধাতুতে রূপান্তর। সম্ভবত সালটি ১৩৭৯; নিকোলাস ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমবারের মতো প্রায় ০.২৩ কেজি পারদকে রূপোয় পরিণত করলেন। আর, তিন বছর বাদে ১৩৮২ সালে পরিণত করলেন নিখাদ সোনায়।

ঠিক এ সময়টায়, আমরা জানতে পারি, নিকোলাস ফ্লামেল অনেক ধনী হয়ে যান। সামান্য একজন বই-দোকানী হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গরিবদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প, কবরস্থান, বিনে পয়সার হাসপাতাল আর অনেক চার্চ। কিন্তু, ফ্লামেল নিজে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করেননি। তার সব কাজের সাথী ছিলেন তার স্ত্রী পেরেনেল। “স্বামী-স্ত্রী নিকোলাস আর পেরেনেল ফ্লামেল দুজনে মিলে সমাজকল্যাণে ব্রতী হন, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সেইন্ট জাক্স লা বশেরি চার্চে ১৭৮৯ সাল পর্যন্তও লোকসমাগম ছিল,” বলেন ইতিহাসবিদ লুই ফিউগুয়ের। জাদুঘরে সংরক্ষিত নিকোলাসের দলিিল থেকে দেখা যায়, তিনি অনেক দানশীল ছিলেন, তবে লোককথায় যে অসম্ভব রকমের ধনী নিকোলাস হয়ে গিয়েছিলেন বলে দেখানো হয়, তা ইতিহাস থেকে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত- কোনোটাই হয় না। ইতিহাসবিদগণ এ কাহিনীগুলোকে কে সপ্তদশ শতকের উদ্ভাবন বলে থাকেন। 

প্যারিসের লুভর (ল্যুভ) মিউজিয়ামের কাছের রাস্তাটি যেমন নিকোলাস ফ্লামেলের নামে করা হয়েছে, তেমনই সে রাস্তাটির সংলগ্ন আরেকটি রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে তার স্ত্রী পেরেনেলের নামে!

নিকোলাস ফ্লামেল রোড; Source: Wikimedia Commons

যা-ই হোক, এ সময় নিকোলাস ঠিকই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন অন্য ধাতু থেকে সোনা প্রস্তুত কীভাবে করা যায় তা নিয়ে। তবে, তিনি তার দৈনন্দিন কাজ বন্ধ রাখেননি। ঠিকই তিনি আসতেন তার দোকানে, পাণ্ডুলিপি কপি করতেন, কর্মচারীদের কাজ তদারকি করতেন। আর সোনা তৈরি কিন্তু মোটেও নিকোলাসের আসল উদ্দেশ্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল আরও বড়, আলকেমির আসল লক্ষ্য দীর্ঘায়ু অর্জন সম্ভব কি না সেটা নিয়ে গবেষণা করা। তিনি কি পেরেছিলেন সেটা নিয়ে সফল গবেষণা চালাতে? পেরেছিলেন সেই সুধা তৈরি করতে? এলিক্সির অফ লাইফ? 

ফ্লামেল; Source: Wikimedia Commons

ইতিহাস আমাদের কিছুই বলে না এটা নিয়ে, কিন্তু লোককথায় যে কাহিনীগুলো যুগের পর যুগ ধরে চলে এসেছে, সেগুলো আমাদের জানায় অনেক কিছুই! লোককথাই যদি হয়, বিজ্ঞানী নিউটন যে ফ্লামেলের কথা লিখেছিলেন তা তো সত্য, কিন্তু কেন লিখেছিলেন? নিউটন তার জীবদ্দশায় নিজের আলকেমির কাজগুলো গোপনে করেছিলেন কেন? 

 

চলবে পরের পর্বে, পড়তে ক্লিক করুন:

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৪: নিকোলাস ফ্লামেলের ‘রহস্যময়’ অন্তর্ধান

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৫: যুগের শেষ ‘জাদুকর’ স্যার আইজ্যাক নিউটন

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৬: স্যার আইজ্যাক নিউটনের বাইতুল মুকাদ্দাস গবেষণা

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৭: অমরত্বের সুধার খোঁজে

আগের পর্ব:

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-১: আলকেমি আর পরশমণি

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-২: পরশমণির খোঁজে আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল

This article is in Bangla language and deals with the myths of the super-natural pursuits of mankind. For references, please visit the hyperlinked websites. 

Featured Image: Wallpapers

Related Articles

Exit mobile version