আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন বছর আগের কথা, একটি নেকড়ে সদৃশ প্রাণী ক্ষুধার্ত হয়ে সমুদ্র উপকুলে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। ক্ষুধার্ত প্রাণীটির তখন শিকারের অভাবে মর-মর অবস্থা। এমন সময় তার নজর গেল জলের দিকে। কয়েকটি মৃত মাছ সেখানে ভেসে ছিল। প্রাণীটির কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না। ত্বরিত বেগে সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মৃত মাছ ভক্ষণে উদরপূর্তি করতে করতে হঠাৎ সেটি বুঝতে পারল, আরে ডাঙা থেকে জলে খাবারের সন্ধান পাওয়া তো আরো সহজ! এরপর ধীরে ধীরে সে স্থলের চেয়ে জলকেই তার খাদ্য সংগ্রহের জায়গা হিসেবে বেছে নিল।
প্রাণীটি আর কিছুই নয়। আজকের নীল তিমিদের পুর্বপুরুষ ওরা পাকিসেটাস। এ পর্যন্ত পড়ে কেউ চোখ রগড়ে বলতে পারেন, দাঁড়ান। আপনি বলতে চাচ্ছেন নীল তিমিরা এক সময় ডাঙ্গায় বসবাস করতো? তা হয় নাকি?
লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন, আপনার জিজ্ঞাসার জবাব পেয়ে যাবেন।
সূত্রের সন্ধানে
পাকিস্তানের সুলেমান মাউন্টেইন একসময় সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। অতীতের সেই সামুদ্রিক পরিবেশের চিহ্ন আছে সুলেমান পর্বতমালার ফসিলের বুকে। মাটির প্রতিটি স্তর যেন একেকটি সময়ের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। হাজার হাজার ফসিলের অনন্য সমাহার। বিজ্ঞানীদের কাছে তাই এই জায়গাটির গুরুত্ব অন্যরকম।
১৯৭৮ সালে একদল বিজ্ঞানী সেখানে ফসিল অনুসন্ধান করছিলেন। হঠাৎ হাতুড়ির আঘাতে একখণ্ড পাথর ছিটকে বেরিয়ে এল। সেদিকে তাকাতেই অনুসন্ধানী চোখগুলোতে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। তার ভেতরে একটি হাড়ের টুকরো ফসিল হয়ে অপেক্ষা করছিল সভ্যতার আলোয় উন্মুক্ত হওয়ার জন্য। সেটি যে কোনো স্থন্যপায়ী প্রাণীর খুলির অংশ, এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেল। কিন্তু কোন প্রাণীর? সমস্যা দেখা গেলো পরিচয় নির্ধারণ করতে গিয়ে। জানা কোনো প্রাণীর সাথে মিল ছিল না অদ্ভুত গোছের সেই হাড়টির।
প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতা ফিলিপ গিংরিচ স্থলজ স্থন্যপায়ীদের উপরে রীতিমত বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তিনিও হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হতেন, যদি না পরবর্তীতে ফসিলের আরো কয়েকটি অংশ পাওয়া যেত। প্রাপ্ত বাকি হাড়গুলির সাহায্যে প্রাণীটির কঙ্কাল পুনর্গঠন করা হলো। দেখা গেল, সেটি নেকড়ে ধরনের কোনো প্রাণীর আকার লাভ করেছে। কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় তখনও লুকিয়ে রইল কালের গহ্বরে।
কিন্তু আচমকা একটি আবিষ্কার হতভম্ব করে দিল সবাইকে। তাতে এমন একটি হাড় খুঁজে পাওয়া গেল, যা এ যুগে জলে বাস করা স্তন্যপায়ীদের শরীরে, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, নীল তিমিদের শরীরে দেখা যায়। ফলে সন্দেহের অবকাশ রইল না, প্রাণীটি আর যা-ই হোক না কেন, এর সাথে আজকের আধুনিক তিমিদের সম্পর্ক রয়েছে। আরো গবেষণা করে যা পাওয়া গেলো তা একটাই অর্থ বহন করে, আজকের তিমিদের পূর্বপুরুষেরা কোনো এক সময় মাটিতে বসবাস করতো!
কিন্তু তাহলে তারা জলে বিবর্তিত হলো কীভাবে? চলুন আমরাও সেই অভিযাত্রায় শামিল হই!
পানিতে প্রথম পদক্ষেপ
আজ থেকে পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর পূর্বে আজকের পাকিস্তান অঞ্চলের তাপমাত্রা হঠাৎ শুষ্ক হয়ে উঠতে লাগলো। পরিবেশ রুক্ষ আর প্রাণহীন হতে থাকলো। সেখানে বসবাসকারী মাঝারী ধরনের শিকারী প্রাণী পাকিসিটাসদের সামনে হঠাৎ একটি সংকট ঘনীভূত হলো- খাদ্য সংকট।
নেকড়ের মতো দেখতে পাকিসেটাস মূলত উদ্ভিদ আর ছোট ছোট প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিবেশে তারা খাদ্যের উৎস হারিয়ে বিপাকে পড়ল। একমাত্র অবশিষ্ট উৎস ছিল পানি। ধীরে ধীরে তারা খাদ্যের জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। কিন্তু তাতে বিপদ কম হলো না। পাকিসিটাসরা তাদের স্থলজ গঠনের জন্য সাঁতারে স্বভাবতই পারদর্শী ছিল না। এটাই কাল হয়ে দাঁড়াল তাদের জন্য। জলের হিংস্র শিকারীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে তাকে নতুন কিছু করতে হতো। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে তারা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলো। তারপর কী হলো তাদের?
সেই উত্তর পাওয়া গেলো আরো ১৬ বছর পরে, ১৯৯৪ সালে।
ফিলিপ গিংরিচের দুজন প্রাক্তন ছাত্র পাকিস্তানে আবার খনন কাজ চালান। তাদের একজন হান্স থিওসেন। সৌভাগ্যক্রমে তারা এবার প্রায় একটি পূর্ণ ফসিল খুঁজে পেলেন। প্রাণীটির পাগুলো ডাঙ্গায় চলাচল করার মতো, কিন্তু পায়ের পাতার গঠন দেখে তারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন। সেগুলোর সাথে হাঁসেরই বরং বেশি মিল।
বিবর্তনের পথ ধরে
ভাগ্য আবারও সহায় হলো। সেই ফসিলের ভেতরে পাওয়া গেলো আজকের তিমিদের কর্ণাস্থি সদৃশ এক টুকরো হাড়। এবার সমস্ত সন্দেহের অবকাশ ঘটল। এরা আসলে পাকিসিটাসই। শুধু বিবর্তনের ধারায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে নিজেদের।
দুর্বল সাঁতারুরা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিবর্তনের ধারায় লাভ করেছে চওড়া একজোড়া পেছনের পা, মোটা মাংসল লেজ আর সরু দেহ। এর নামকরণ করা হলো অ্যামবুলোসিটাস। অর্থাৎ এরা একইসাথে ডাঙ্গায় হাঁটতে পারে আবার পানিতেও সাঁতরাতে পারে।
কিন্তু যাত্রাপথের তখনও অনেক বাকি।
উভচর হলেও অ্যামবুলোসিটাস স্থলের উপর নির্ভরশীল ছিল। কেননা অতিরিক্ত লবণাক্ত সমুদ্রের পানি পান করার ক্ষমতা তখনও তারা লাভ করেনি। সুতরাং জল পান করার জন্য তাদেরকে মাটিতে উঠে আসতে হত। কিন্তু বিবর্তনের ধারায় ইতোমধ্যে তারা ডাঙ্গায় থাকার ক্ষমতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল। অপরদিকে জলেও তাদের জন্য বিপদ কম ছিল না। হিংস্র হাঙ্গর আর ভয়াল কুমিরের তাড়া থেকে পালিয়ে বাঁচতে হতো তাদের। এমতাবস্থায় ৪৯ মিলিয়ন বছর আগে তাদের শেষ চিহ্ন পাওয়া যায়।
তারপর কী হলো?
জলজ জীবনের হাতছানি!
ডক্টর গিংরিচ এবার নিজেই উঠেপড়ে নামলেন। আবার এলেন সুলেমান পর্বতমালায় অভিযান চালানোর জন্য। অবশেষে তিনি এমন কিছু ফসিল খুঁজে পেলেন, যেগুলো এই বৃহৎ প্রাণীটির জলজ যাত্রাপথের একটি ধাঁধাঁর সমাধান করে দিলো।
রোডাসিটাস, তিমিদের আদিপুরুষ পানিতে তার প্রথম পদক্ষেপ ফেলার চার মিলিয়ন বছর পরে যারা মাটির মায়া পুরোপুরি ত্যাগ করে পানিতে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল। রোডাসিটাসদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের পূর্ববর্তী এমবুলোসিটাসদের মতোই। কিন্তু প্রকৃতি তাদের একটি অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়েছিল- একটি শক্তিশালী কান। বহু দূর থেকেই এরা অন্য প্রাণীর উপস্থিতি বুঝতে পারত। সুতরাং শত্রুর মুখোমুখি পড়ার পথ সহজেই এড়িয়ে চলতে পারত তারা।
তবে বিপদের তাতে শেষ হলো না। জলের শত্রুদের তারা এড়ানোর উপায় শিখলো বটে, কিন্তু যাকে কখনো হারানো যায় না, সেই জলবায়ুর ভয়ঙ্করভাবে পরিবর্তন হওয়া শুরু করলো। এই পরিবর্তিত চরম আবহাওয়ায় তারা টিকতে না পেরে হারিয়ে গেল। তাদের জায়গা নিল তাদের উত্তরপুরুষ ব্যাসিলোসরাস আর ডরুডন। এদের চিহ্ন মিলল গ্রাগৈতিহাসিক টেথিস সাগরের তলায়, যা আজকের সাহারা মরুভূমির অংশ।
পঞ্চাশ ফুট লম্বা ও চৌদ্দ হাজার পাউন্ড ওজনের ব্যাসিলসরাসকে টেক্কা দেওয়ার মতো খুব কম প্রাণীই সাগরজলে অবশিষ্ট ছিল। এতদিন যারা তাকে শিকার করত, আজ তারাই লুকিয়ে বেড়াতে লাগলো ভয়ংকর সাগর দানব থেকে। অপরদিকে খানিকটা ডলফিনের মতো দেখতে ডরুডন ছিলো অপেক্ষাকৃত ছোট। এমনকি তারা মাঝে মাঝে ব্যাসিলোসরাসের শিকারে পরিণত হতো।
এদের মাঝে শেষমেশ কে টিকে থাকবে? ব্যাসিলোসরাস নাকি ডরুডন?
শেষ হাসি
শিকার আর শিকারীর অসামঞ্জস্য প্রতিযোগিতায় অপ্রত্যাশিত জয় ঘটলো শিকারেরই। অতিকায় ব্যাসিলোসরাস হারিয়ে গেলো পৃথিবী থেকে। কিন্তু কেন?
এর উত্তর দেবে পৃথিবী নিজেই। ৩৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীর আবহাওয়া হঠাৎ পরিবর্তন হতে শুরু করে। ব্যাসিলোসরাসের দেহ ছিল অতিকায় এবং সরু। মোটাসোটা একটি ইল মাছকে দেখতে যেমন দেখায় খানিকটা তেমন। উপকূল ছিল তাদের বিচরণের আদর্শ জায়গা। কিন্তু আচমকা আবহাওয়া পরিবর্তনে উপকূল গেল শুকিয়ে। ফলে শিকারীরা বিলুপ্ত হয়ে গেল আর ডরুডনরা রাজত্ব শুরু করলো। এরা আজকের তিমিদের পূর্বপুরুষ!
ডরুডনরা রাজত্ব ফিরে পেলো বটে কিন্তু তিমিদের অভিযাত্রায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারীর সাথে মোকাবেলা করা তখনও বাকি ছিলো। সেটি হলো ন্যুনতম ১০,০০০ কেজি ওজনের অতিকায় রাক্ষুসে হাঙ্গর, যার নাম মেগালোডন। সমুদ্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক শিকারী, যার এক একটি দাঁত পূর্ণবয়স্ক মানুষের হাতের সমান। বায়ান্ন ফুট লম্বা ভয়ানক শিকারীদের কাছে ষোলো ফুট লম্বা ডরুডন ছিল যেন বাচ্চা শিশু!
সেই মুহুর্তেও ডরুডনেরা টিকে গেল পূর্বপুরুষদের বদৌলতে। স্থলজ স্তন্যপায়ীদের রক্ত উষ্ণ। প্রচন্ড ঠাণ্ডায়ও তা জমে যায় না, ফলে তারা পালিয়ে গেলো বরফশীতল জলে। অপরদিকে মেগালোডনরা শীতল রক্তের, তাই এদের ঠাণ্ডায় রক্ত জমে গিয়ে শরীর অকেজো হয়ে যাবার ভয়ে ছিল।
নতুন এই শীতল যুগ তাই আশীর্বাদ হয়ে এলো ডরুডনদের জন্য। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিবেশে তারা নীল তিমিতে বিবর্তিত হতে থাকলো আপন গতিতে, যতদিন না এক বুদ্ধিমান দু’পেয়ে জীব তাদের সাক্ষাৎ পাচ্ছে!