একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। একবার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বেশ খেপে গেলেন একটি কাকের ওপর। কাকটি তার প্রাসাদের ওয়াচটাওয়ারে বাসা বানিয়েছিল। ভদ্রলোক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন, “যে করেই হোক এ বজ্জাত কাকটিকে শেষ করেই ছাড়ব।” সমস্যা হলো তিনি যতবারই ওয়াচটাওয়ারে যান, কাকটি উড়ে পাশের একটি গাছের ডালে গিয়ে বসে থাকে। তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত সে আর বাসায় ফেরে না।
বারবার ব্যর্থ হয়ে তিনি একটি বুদ্ধি বের করলেন। তিনি ওয়াচটাওয়ারে তার দুজন লোক পাঠালেন। কাকটি স্বভাবত উড়ে গেল। এরপর একজন লোক ওয়াচটাওয়ার ছেড়ে ফিরে আসলো। অন্যজন লুকিয়ে রইল সেখানে। দেখা গেল কাকটি তবুও বাসায় ফিরছে না। অর্থাৎ সে জানে দুজনের একজন তখনো আছে ওয়াচটাওয়ারে। দুজন ব্যক্তি আর একজন ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা রয়েছে তার।
পরেরবার তিনজন লোক পাঠানো হলো। দুজন ফিরে আসলো, লুকিয়ে রইল একজন। কাকটি এবারও বুঝতে পারলো বিষয়টি। তবে বেশিদূর আর এগোতে পারবে না সে। পাঁচ/ছয় জন লোক পাঠালেই ধরা পড়ে যাবে। কারণ চার-এর বেশি পরিমাণের ক্ষেত্রে মধ্যে গুলিয়ে ফেলে কাকেরা। পাঁচজন আর ছয়জন লোকের মধ্যে পার্থক্য করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
অধিকাংশ পশু-পাখির অবস্থা এ কাকের মতোই। তাদের তো আর মানুষের মতো সংখ্যা-পদ্ধতি নেই যে জটিল সব অঙ্ক কষবে। তবে একধরনের নাম্বার-সেন্স বা সংখ্যা-বোধ আছে বলা যায়। অনেক প্রাণী এক, দুই,তিন, চার পর্যন্ত বুঝতে পারে। এরপর যা-ই আসুক তা ‘বেশি’ হয়ে যায় তাদের জন্যে।
যেমন- সিংহের কথা বলা যায়। তারা দলবদ্ধ প্রাণী। নিজেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে একসাথে থাকতে পছন্দ করে। অন্য কোনো গোত্র কিংবা দলকে তারা তখনই আক্রমণ করে, যখন নিজেরা সংখ্যায় বেশি থাকে। অর্থাৎ ছোট-বড় পরিমাণের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের।
লাউড-স্পিকার থেকে সিংহের গর্জন বাজিয়ে তাদের এই আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন গবেষকরা। দেখা গেল, স্পিকারে গর্জন শুনে তারা বুঝতে পারে, কতটি সিংহের কণ্ঠ ভেসে আসছে। তারপর তারা তাকায় নিজেদের দলের দিকে। সংখ্যায় নিজেরা বেশি থাকলেই কেবল এগিয়ে আসে। তবে গবেষকদের মতে, গর্জনের সংখ্যা পাঁচ-ছয়ের ঘরে গেলে এটি আর ঠিকঠাক করতে পারে না তারা। সিংহের সীমিত সংখ্যা বোধ গুবলেট পাকিয়ে ফেলবে এর পর।
এদিক দিয়ে পোষা কুকুরের অবস্থা আরো খারাপ। তারা ০ ও ১ সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে কেবল। হয়তো ধরুন কোনো পাত্রে খাবার আছে নাকি নেই এটুকুই বুঝতে পারে তারা। এর বেশি পরিমাণে গেলে তাদের পক্ষে আর আলাদা করা সম্ভব হয় না। অনেকের মতে, কুকুরকে পোষ মানানোয় তারা সংখ্যা-বোধ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তাদের নিকটতম প্রজাতি নেকড়ের মধ্যে যথেষ্ট উন্নত সংখ্যা-বোধ দেখা যায়।
এ দাবি যৌক্তিক, কারণ গণনার বিষয়টি প্রাণীজগতে প্রয়োজনীয়তা থেকেই এসেছে। যেমন ধরুন ব্যাঙ; স্ত্রী ব্যাঙ তাদের যোগ্য সঙ্গী বাছাই করার জন্যে পুরুষ ব্যাঙের ডাকের স্পন্দন সংখ্যা গুনে থাকে। অবশ্য ডাকের সময়কাল, স্বরও বিবেচনায় রাখে। তবে স্পন্দন গণনা তাদের মিলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিংবা মৌমাছির কথা ধরুন, পথ চেনার জন্যে তাদের রাস্তায় বিভিন্ন চিহ্নের হিসেব রাখতে হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রাণী প্রয়োজনের তাগিদেই গণনার চর্চা জারি রেখেছে। কিন্তু কুকুর পোষা প্রাণী বনে যাওয়ার পর হয়তো সেরকম প্রয়োজন পড়েনি তার। তাই এ দক্ষতায় তারা পিছিয়ে পড়েছে অন্যান্যদের থেকে।
পাখিদের সংখ্যা বোধের বলতে গেলে অ্যালেক্স নামের একটি টিয়া পাখির গল্প দিয়ে শুরু করা উচিৎ। মনস্তত্ত্ববিদ আইরিন পেপারবার্গ তার প্রিয় এ পাখিটিকে দশকের পর দশক ধরে অনেক বিষয় শিখিয়েছিলেন। তন্মধ্যে ছিল গাণিতিক দক্ষতাও। সে সর্বোচ্চ ছয় পর্যন্ত গণনা করতে পারতো।
তাকে পরীক্ষার জন্যে আইরিন একটি ট্রেতে বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির বস্তু রাখতেন। ধরুন, গোলাপী রঙের চারটি বল, পাঁচটি সবুজ ফলক এবং তিনটি গোলাপী ফলক রাখা হলো। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কয়টি গোলাপী বল আছে ট্রেতে? সে ঠিকঠাক জবাব দিতে পারতো। এজন্য তাকে স্রেফ গণনা করলেই চলতো না, ভিন্ন রঙ ও আকৃতির মধ্যেও তফাৎ করতে হতো।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, কয়েক দশকের প্রশিক্ষণ ছিল অ্যালেক্সের ঝুলিতে। কিছু পাখিকে দেখা যায় জন্মগতভাবেই তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতা পেয়ে থাকে। যেমন- মুরগীর বাচ্চা স্রেফ তিনদিন বয়স থেকেই গুনতে শিখে যায়। তারা সমান ও ছোট-বড় পরিমাণ চিহ্নিত করতে পারে। এটুকু তো মানা যায়, কিন্তু ইতালিয়ান গবেষক রোজা রুগানি যে দাবি করেছেন তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, মুরগীর ছানাদের মানুষের মতো সংখ্যারেখার ধারণা রয়েছে।
সংখ্যারেখার কথা মনে আছে তো? যেটি সংখ্যাকে বাম থেকে ডানে সাজায়। রুগানি ষাটটি মুরগীর বাচ্চার ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। প্রথমে পাঁচটি ডট সম্পন্ন একটি কার্ডের সাথে পরিচয় করানো হয় তাদের। এরপর তাদের যখন দুটি ডট সম্পন্ন কার্ড দেখানো হয়, তখন তারা বাঁ দিকে হাঁটতে শুরু করে। আটটি ডট সম্পন্ন কার্ড তাদের নিয়ে যায় ডানে। এখান থেকেই রুগানি ধারণা করেন তারা সংখ্যারেখায় দেখে সংখ্যাকে।
কিন্তু অনেকেই রুগানির এ দাবির সাথে একমত হতে পারেননি। সমালোচকদের মতে, মুরগী-ছানাদের ডানে বা বাঁয়ে যাওয়ার প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক থাকে। সেটিকে সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত করেও এ ধরনের উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব। গবেষকদের এ মতবিরোধের ফলে এখনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না, মুরগী-ছানারা সংখ্যারেখা কল্পনা করতে পারে কী না। তবে এটি সত্যি হলে বুঝতে হবে, আমরা মানুষেরাও সংখ্যারেখার ধারণা জন্মগতভাবেই পেয়েছি।
অনেক প্রমাণ বলে গণনা করার দক্ষতা প্রাইমেটরা জন্মগতভাবেই পায়। তন্মধ্যে একটি হলো আমাদের নিকটাত্মীয় কিছু প্রাণীর চমৎকার গননার দক্ষতা। আই (Ai) নামের একটি জাপানি শিম্পাঞ্জির কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রথম প্রাণী হিসেবে সে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি (0, 1, 2, …, 9) শিখতে সক্ষম হয়। কম্পিউটারের পর্দায় পাঁচটি ডট দেখে সে ‘5’ সংখ্যাটি চাপতে জানে। এটি বিশাল কৃতিত্বের বিষয়। গণনা ছাড়াও ছোটখাট গাণিতিক সমস্যারও সমাধান করতে পারে শিম্পাঞ্জীরা। অবশ্য সেজন্যে আপনাকে কিছু চকলেট উপহার দিতে হবে।
১৯৮৭ সালে গবেষকরা এমন একটি পরীক্ষা চালান। শিম্পাঞ্জির সামনে দুই জোড়া পাত্র রাখেন তারা। প্রত্যেকটিতে কিছু সংখ্যক চকলেট ছিল। পুরষ্কার জেতার জন্যে শিম্পাঞ্জিদের প্রথমে প্রত্যেক জোড়া পাত্রে কতটি চকলেট আছে তা যোগ করতে হতো। এরপর তুলনা করতে হতো কোন জোড়ায় বেশি চকলেট রয়েছে। এরপর বাছাই করতে হতো সেট। দেখা গেল ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তারা সঠিক পাত্র জোড়া বাছাই করতে সক্ষম হয়েছে।
এসব তথ্য থেকে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়, পশু-পাখিদের সংখ্যাজ্ঞান সম্পর্কে। কিন্তু এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলা গল্পটিই বলা হয়নি এখনো, যে ঘটনার পর থেকে গবেষকরা প্রাণীদের সংখ্যাজ্ঞান নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন।
এ গল্পের নায়ক ‘ক্লেভার হ্যান্স’ নামের একটি ঘোড়া। ১৮৯১ সালের কথা। জার্মান স্কুল শিক্ষক উইলহেম ভন ওস্টেন ঠিক করলেন, তার ঘোড়াকে গণিত শেখাবেন। যোগ-বিয়োগ দিয়ে শুরু করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত উন্নতি লক্ষ্য করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই ঘোড়াটি গুন, ভাগ, এমনকি ভগ্নাংশ পর্যন্ত শিখে গেল।ঘোড়াটির সামনে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের মতো করে প্রশ্ন দেওয়া থাকতো। খুর দিয়ে সে বাছাই করতো সঠিক উত্তরটি। ক্লেভার হ্যান্স নামে পরিচিত হয়ে উঠলো ঘোড়াটি।
হ্যান্সের সুখ্যাতি ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় নিলো না। দলে দলে মানুষ ভিড়তে লাগলো গণিতবিদ ঘোড়াটিকে দেখার জন্য। প্রশ্নও উঠলো- ঘোড়াটি কি আসলেই অঙ্ক কষতে সক্ষম? নাকি কোনো চালাকি রয়েছে এতে? বিষয়টি তদন্ত করার জন্যে তেরোজন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জার্মান শিক্ষা বোর্ড।
তদন্ত কমিটি মনস্তাত্ত্বিক অস্কার ফাংস্টকে নিয়ে আসে ঘোড়াটির সক্ষমতা বিচারের জন্যে। বারবার পরীক্ষার পর একটি সন্দেহজনক বিষয় নজরে পড়ে তার। ঘোড়াটিকে যিনি প্রশ্ন করছেন, তার সঠিক উত্তর জানা থাকলেই কেবল ক্লেভার হ্যান্স সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হয়। ফাংস্ট দেখান যে, ঘোড়াটি আসলে প্রশ্নকর্তার থেকে পাওয়া কিছু সূক্ষ্ম সংকেতকে কাজে লাগাচ্ছে। যখনই সে সঠিক উত্তরের দিকে যায়, কাছে দাঁড়ানো প্রশ্নকর্তার শারীরিক ভাষায় অবচেতনভাবেই কিছু সংকেত ফুটে ওঠে। সেগুলো ব্যবহার করেই সে সঠিক উত্তর বাছাই করে। এ বিষয়টি হ্যান্সের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেও তার গাণিতিক সক্ষমতার প্রমাণ কিন্তু মেলে না এতে।
অবশ্য এসব বলে ওস্টেনকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তার গণিতবিদ ঘোড়াটিকে নিয়ে তিনি জার্মানি ঘুরে বেড়াতে থাকেন। উৎসাহী জনতাকে দেখাতে থাকেন তার কৃতিত্ব। কিন্তু এ ঘটনাটি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছিল গবেষকদের। পশু-পাখিদের সংখ্যা-বোধ নিয়ে আগ্রহী গবেষকরা নতুন করে শুরু করেছিলেন তাদের অনুসন্ধান।
জীবজগত সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো