প্রতি বছর পৃথিবীর অজানা জীববৈচিত্র্যের খাতায় যোগ হয় নতুন নতুন প্রজাতি। ২০১৭ সাল মোটেও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। সদ্য শেষ হওয়া বছরে সেই তালিকায় যোগ হয়েছে নতুন আঠারো হাজার প্রজাতি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ অনাবিষ্কৃত প্রজাতি রয়েছে, তার তুলনায় এই আঠারো হাজার সংখ্যাটি নিতান্তই নগণ্য। এই নতুন আবিষ্কারগুলো থেকে বাছাই করা কয়েকটি অদ্ভুত আর রহস্যময় প্রজাতি নিয়েই এই লেখা।
১. চিংড়ির নাম পিংকফ্লয়েডি
জনপ্রিয় ইংলিশ রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের নাম শোনেননি, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু এ বছর আবিষ্কৃত এক চিংড়ির নাম দেওয়া হয়েছে Synalpheus pinkfloydi। কেন এই নাম?
পিংক ফ্লয়েডের গায়কদের মতো সুরেলা কণ্ঠ না থাকলেও এই চিংড়ির আছে উজ্জ্বল গোলাপি রঙের নখর। এই নখর ব্যবহার করে পিংকফ্লয়েডি তৈরি করে নির্দিষ্ট কম্পাংকের শব্দ। আর এই আওয়াজ এতটাই শক্তিশালী যে, এটি ব্যবহার করেই ছোট মাছ কিংবা জলজ জীবকে সহজেই কুপোকাত করে এই চিংড়ি।
২. সাগরের উজ্জ্বল তারামাছ
অস্ট্রেলিয়া উপকূলে কমনওয়েলথের পরিচালিত বৈজ্ঞানিক আর শিল্প গবেষণা সংস্থা (CSIRO) এর গবেষণাকাজের সময় পাওয়া যায় নতুন এক প্রজাতির আলোক বিচ্ছুরণকারী তারামাছ।
৩. আমাজনের এক নিশাচর মাছ
পৃথিবীর বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট আমাজন যে প্রাণপ্রাচুর্য ভরপুর, তা বলাই বাহুল্য। প্রতিবছর আমাজন অরণ্যের গহীন থেকে আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতি। ২০১৭ সাল মোটেই তার ব্যতিক্রম ছিলো না। নতুন আবিষ্কৃত ৩৮১ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে পাওয়া গেছে দুর্লভ এক নিশাচর প্রজাতির মাছ। স্থানীয়ভাবে এই মাছ পরিচিত ‘White-Ball Acari’ নামে। তবে এই দুর্লভ মাছের বাসস্থান জিংগু নদীতে নির্মিত ‘বেলো মন্টে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ এই নদীর জীববৈচিত্র্যকে হুমকির সম্মুখীন করেছে।
৪. মুখবিহীন মাছ
অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে দেখা মিলেছে মুখবিহীন এক অদ্ভুত মাছের। ৪০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এই মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের চার হাজার মিটার গভীর থেকে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সমুদ্রের এত গভীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনায়ও পাওয়া গেছে মানবসৃষ্ট দূষণের প্রমাণ। ধারণা করা হচ্ছে, এই মাছের আবাসস্থলও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই দূষণের কারণে।
৫. তাপানুলি ওরাংওটাং
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে দেখা মিলেছে নতুন প্রজাতির এক ওরাংওটাংয়ের। স্থানীয়ভাবে এরা পরিচিত ‘তাপানুলি ওরাংওটাং’ নামে। ২০১৭ সালে সুমাত্রা দ্বীপের এক জঙ্গলে মোট ৮০০ সদস্যের এই ওরাংওটাং দলকে খুঁজে পায় একদল গবেষক।
৬. গাঢ় নীল ট্যারান্টুলা
গায়ানার রেইনফরেস্ট প্রাণীবৈচিত্র্যের আরেক অনন্য আধার। ২০১৭ সালে এই অরণ্য থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে তিরিশটির মতো নতুন প্রজাতি। এই তালিকায় আছে ‘ট্যারান্টুলা‘ নামের এক বিশেষ ধরনের মাকড়সাও। গাঢ় নীল রঙের এই মাকড়সাটি পৃথিবীর দুর্লভতম মাকড়সাগুলোর একটি।
৭. তালিকায় আছে অর্কিডও
২০১৭ সালে দেখা মিলেছে নতুন অর্কিডেরও। কম্বোডিয়ার কার্ডামম পর্বতশ্রেণী থেকে গবেষকদল খুঁজে বের করেছেন অসাধারণ দেখতে এই অর্কিডকে। দুষ্প্রাপ্য এই অর্কিডের বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘Porpax verrucosa’।
৮. ওবামার নামে পাখি
সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত এক পাখির নামকরণ করা হয়েছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নামে । আমাজনের গহীন অরণ্যে বসবাসরত ছোটখাট গড়নের পাখির নাম দেওয়া হয়েছে Nystalus obamai। শিকার ধরার আগে এক ঘণ্টার চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গাছের ডালে বসে শিকারের উপর নজর রাখা এই পাখির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। পেরু, ব্রাজিল আর ইকুয়েডরের বিভিন্ন অঞ্চলেও ঝাঁকে ঝাঁকে এই পাখিকে দেখা যায়।
৯. নখের ডগায় ব্যাঙ
সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চার প্রজাতির নতুন ব্যাঙের সন্ধান মিলেছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। তবে এর জন্য বিজ্ঞানীদের কাঠখড়ও কম পোড়াতে হয়নি। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই ব্যাঙদের সন্ধান করে যাচ্ছিল গবেষকদের একটি দল। নতুন আবিষ্কৃত ব্যাঙদের মধ্যে একটি এতই ক্ষুদ্র যে, এটিকে অনায়াসে বসানো যাবে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নখের ডগায়।
১০. গুহায় পাওয়া মাছ
মাটির নিচের পরিবেশে যেখানে পানি অনেক কম, সেখানেও বেঁচে থাকতে পারে মাছ। আর এই ধরনের মাছকে বলা হয়ে থাকে ‘Cave Fish‘। শখের বশে ঘুরে বেড়ানো এক জার্মান পর্যটক আবিষ্কার করেছেন এমনই একধরনের মাছ, যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন ইউরোপের প্রথম ‘Cave Fish‘।
১১. অস্ট্রেলিয়ার মাকড়সারা
অস্ট্রেলিয়ার এক গুহায় পাওয়া গেছে নতুন পঞ্চাশ প্রজাতির মাকড়সা। টানা দশ দিন ধরে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার ‘ইয়র্ক‘ নামের এক গুহায় পাওয়া গেছে বিশাল এই মাকড়সার ঝাঁক। লাফিয়ে চলা এই মাকড়সারা দেখতে বেশ রঙিন।
১২. লাল আলোয় দেখা যায় যে মাছ
ইস্টার দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রসীমায় দেখা মিলেছে লাল রঙের এক নতুন প্রজাতির মাছের। সমুদ্রের গভীরে বসবাসরত ক্ষুদ্র এই মাছের ঝাঁককে আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্যই মনে হয়। লাল আলো ছাড়া সামুদ্রিক পরিবেশে এদের দেখা পাওয়া মুশকিল। আর তাই দীর্ঘদিন যাবৎ বিজ্ঞানীদের চোখে অদৃশ্যই ছিলো এই মাছ।
১৩. আলবেনিয়ার অজানা মাছ
আলবেনিয়ার এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ করার সময় সন্ধান পাওয়া গেছে নতুন প্রজাতির এই মাছের। দেখতে অদ্ভুত এই মাছ সংখ্যায়ও বেশ কম। ধারণা করা হচ্ছে, বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মাছটি। এখনও বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়নি এর।
১৪. হারিয়ে যাওয়া লাঠি পোকা
বড়সড় লাঠির মতো দেখতে এই পোকাদেরকে অনেককাল আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। তবে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একটি দ্বীপে এই লাঠি আকৃতির পোকাদের অস্তিত্ব পাওয়ার ঘোষণা দেন একদল গবেষক। তবে তারা নিশ্চিত নন, এটিই সেই হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি, নাকি নতুন কোনো প্রজাতির পতঙ্গ। বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া সেই পতঙ্গটির ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকার কারণেই এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে বলেই গবেষকদলের মতামত।
ফিচার ইমেজ: KTLA