১৯৪০ সালের ৪ নভেম্বর। সোমবার। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। কানাডার পূর্ব-মধ্য সাসকাচোয়ানের ফোম লেক, এলফ্রস এবং শেহো অঞ্চলে তখন ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছে। অনেকে ঘুমিয়েও গিয়েছেন। হঠাৎ ঘরের ছাদে কিছু আঁছড়ে পড়ার শব্দ হতে শুরু করলো। একটি দুটি নয়, অনেক। অনবরত হতেই থাকলো সে শব্দ। একের পর এক কী যেন উপর থেকে পড়তে লাগলো ঐ এলাকার সবার ঘরের ছাদে। যেন আকাশ থেকে বৃষ্টির বদলে বড় বড় বরফখন্ড পড়ছে অনবরত। সবাই ভয় পেয়ে গেলেন। কী হচ্ছে কেউ বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও চলছিল। ফলে কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহসও পাচ্ছিলেন না। যদি শত্রুপক্ষের গুলি বা বোমা হয় সেই ভয়ে।
এর মাঝে কেউ হয়তো সাহস করে বাইরে এসে দেখলেন কী হচ্ছে। চার ঘন্টারও বেশি সময় ধরে ভয়াবহ সেই ’বৃষ্টি’ চলতেই থাকল। যখন ’বৃষ্টি’ থামল একে একে সবাই বাইরে এলেন। অনেকটা ভয় নিয়ে বাইরে এসে যা দেখলেন তা দেখার কথা কেউ কখনো ভাবেননি। চারদিকে শুধু হাঁস আর হাঁস। পড়ে আছে এখানে সেখানে। দুই-একটা বাদে সবগুলোই মৃত। কেউ বুঝে উঠতে পারছিলেন না এই চার ঘন্টায় কীভাবে কী হলো, কেন হলো?
আসলে সেই রাতে ‘হাঁস-বৃষ্টি’ হয়েছিলে। বৃষ্টির মতো আকাশ থেকে হাঁস এসে পড়েছিল রাতে। একটি বা দুটি নয়। প্রায় পাঁচ হাজার হাঁস। তা-ও আবার সবগুলো একই প্রজাতির- বাফেলহেড হাঁস
পরদিন সকাল বেলায় স্থানীয় পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হলো- ‘আগামী এক সপ্তাহ সবার খাবার টেবিলে হাঁস থাকতে পারে।’ এ নিয়ে চারদিকে বেশ কৌতুকের ছড়াছড়িও হলো। হাঁস শব্দটাই ওই কমিউনিটির কাছে আলাদা অর্থ ধারণ করে ফেলল।
কিন্তু আসলে এটি ছিলে খুবই ভয়ার্ত এক রাত। কারণ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল দিন চলছে। চারদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ। উপর থেকে হাঁস পড়া নিয়ে একেকজন একেক মতবাদ দিতে লাগলেন। কেউ বলছিলেন উপর থেকে অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। কেউ বলছিলেন হাঁসগুলোতে বোমা ভরে এই এলাকায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। কারো মতে, হাঁসগুলো বিষাক্ত কিছু খেয়েছিল। এজন্য কিছু দূর উড়ে আর উড়তে পারেনি। কেউ বলছিল, ডাফোতে অবস্থিত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাঁটি থেকে এ কান্ড ঘটতে পারে। কিন্তু কারো কাছেই এই ‘হাঁস-বৃষ্টি’র আসল কারণ জানা ছিল না।
স্থানীয়রা মোটামুটি যুক্তিযুক্ত একটি কারণ খুঁজে বের করলেন এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, বাফেলহেড হাঁসগুলো কুয়াশার মধ্যে দিক হারিয়ে ফেলেছিলে এবং ফোম লেকের আলো দেখে একে শিমারিং লেক মনে করেছিল। দিকভ্রান্ত হওয়ার কারণে পথেই তাদের মৃত্যু ঘটে। তারপর বিশ্বযুদ্ধের আলোচনায় এই হাঁস বৃষ্টির বিষয়টি একরকম চাপা পড়ে যায়। পরে এই বিষয় আবার আলোচনায় নিয়ে আসেন কেরি ফিনলে। তিনি সাসকাচোয়ানের লুসল্যান্ডের মানুষ। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে এই এলাকা দেখে বড় হয়েছেন এবং এর পরিবেশ সম্পর্কে তার ধারণা গাঢ় হয়েছে।
কেরি ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে আর্কটিকে জীববিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সিডনিতে স্থায়ী হওয়ার আগে বাফিন বে-তে ‘বোহেড তিমি’ বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। ছোটবেলাতেই তিনি এই হাঁস সম্পর্কে জেনেছেন এবং তার ক্যারিয়ারেও এই বাফেলহেড হাঁস নিয়েও কাজ করতে হয়েছে। ফলে তিনি ১৯৪০ সালের সেই রাতের হাঁস-বৃষ্টির বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হন। এর রহস্য উদঘাটন করতে তিনি প্রায় ১৬ বছর ব্যয় করেন এবং গ্রহণযোগ্য একটি কারণ খুঁজে পান। কী কারণে সেই রাতে হাঁস-বৃষ্টি হয়েছিল সেটি জানার আগে বাফেলহেড সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা জরুরি।
বাফেলহেড হাঁস
বাফেলহেড একটি ছোট সামুদ্রিক হাঁস। এটি কানাডার বোরিয়াল বনের গাছগুলোতে প্রজনন করে থাকে এবং শীতকাল এর পাশের উপকূলবর্তী জলেই কাটায়। একে ‘স্পিরিট ডাক’ বলেও ডাকা হয়। পুরুষ হাঁসটি সাদা-কালো হয়ে থাকে এবং এর মাথায় চিত্রাভ দাগ থাকে যা বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন বর্ণের দেখায়। মাথায় ভিন্ন রকমের রং থাকার কারণেই একে বাফেলহেড হাঁস বলা হয়ে থাকে। তবে বাফেল শব্দটি এসেছে বাফেলো (buffalo) এবং হেড (head) এর সংমিশ্রণে।
বাফেলহেড হাঁস আসলে পরিযায়ী পাখি। এরা প্রজননের সময় পশ্চিম আমেরিকা, কানাডা এবং আলাস্কার বোরিয়াল ফরেস্ট এবং অ্যাস্পেন পার্কল্যান্ডে বসবাস করে। এরা সাধারণত জলে ডুব দিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী, ক্রাস্টেসিয়ানস এবং মলাস্ক। জলের নিচে থাকা অবস্থাতেই এরা খাবার খেয়ে থাকে। এক ডুবে এরা ১২-২৫ সেকেন্ড পর্যন্ত জলের নিচে থাকে। উপরে উঠে ১২ সেকেন্ডের মতো থেকে আবার ডুব দেয়। তবে জলের উপরে ভাসমান পোকা এবং পতঙ্গও খেয়ে থাকে।
যেসব হাঁস প্রজনন শেষে প্রজনন ক্ষেত্র ছেড়ে চলে যায় তাদের মধ্যে বাফেলহেড অন্যতম। এরা যখন স্থান পরিবর্তনের প্রস্তুতি নেয় তার আগে এত বেশি পরিমাণে খাবার খেয়ে থাকে যে এদের শরীরের ওজন আরো ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তবে এরা বেশ সময়নিষ্ঠ পরিযায়ী পাখি। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে এরা শীতের আবাসভূমিতে চলে আসে। সিডনিতে ১৫ অক্টোবর হচ্ছে বাফেলহেড হাঁস দিবস। শীতের সময় এরা লেকে পৌঁছাতে সমুদ্রের দেড় কিলোমিটার উপর দিয়ে ঘন্টায় ৬৫ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে ছুটে চলে। মাঝে মাঝে তা ১০০ কিলোমিটার পর্যন্তও হয়ে থাকে।
কেন হয়েছিল হাঁস-বৃষ্টি?
বাফেলহেড সম্পর্কে পড়তে গিয়ে ১৯৪০ সালের নভেম্বরে ঘটা হাঁস বৃষ্টির বিষয়টি কেরির নজরে আসে। আপাতদৃষ্টিতে অভূতপূর্ব এই ঘটনায় উত্সাহিত হয়ে তিনি সেই সময় উপস্থিত ছিলেন এমন কারো সাক্ষাৎকার নিতে বেরিয়ে যান। তিনি যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাদের অনেকেই মনে করতো এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনা। বাকিরা এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল- সেই রাতে প্রচন্ড কুয়াশায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়েই হাঁসগুলো মারা পড়ে। হাঁসগুলো আসলে ফোম লেকের আলোর দিকে আসছিলো। ফলে অন্য এলাকায় এই হাঁসবৃষ্টি না হয়ে ফোম লেক, এলফ্রস এবং শেহো অঞ্চলেই হয়েছিল।
কিন্তু কেরির সন্দেহ তাতে দূর হলো না। কারণ হাঁসগুলো আরো অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলেও পড়েছিল যেখানে কোনো বিদ্যুতের আলো ছিলো না। ফলে হাঁসগুলো যদিও ফোম লেকের আলো দেখেই এসব এলাকায় আসতো তাহলে সেসব বিদ্যুতহীন গ্রামীণ এলাকায় তাদের যাওয়ার কথা না এবং সেখানে তাদের মৃতদেহ পাওয়ার কথা না। তাই কেরি আরো বিস্তর গবেষণা করতে চাইলেন।
এরপর তিনি নেমে পড়লেন আবহাওয়া নিয়ে গবেষণায়। তিনি সেসময়কার সকল আবহাওয়ার রিপোর্ট সংগ্রহ করলেন। সুইডেনের একজন আবহাওয়াবিদের কাছ থেকে ১৯৪০ সালে জার্মানি থেকে প্রকাশিত একটি আবহাওয়া রিপোর্ট পেপার সংগ্রহ করলেন। তিনি তাতে দেখতে পেলেন, সেসময় প্রায় সারা পৃথিবীর আবহাওয়াই একটু ভিন্ন রকম ছিল। ওই সময় আবহাওয়াকেন্দ্রিক যেসব ঘটনা ঘটেছিল তার তথ্যও সংগ্রহ করলেন। হাঁস-বৃষ্টির পাঁচদিন পর ট্যাকোমা ব্রিজটি দুলতে শুরু করে এবং ভেঙে পড়ে। এর এক সপ্তাহ পরে ১১ নভেম্বর আমেরিকান মিডওয়েস্টে এক ভয়াবহ তুষারপাত হয় যার কারণে ১০০ জনেরও বেশি লোক হতাহত হয়।
১৬ বছর ধরে গবেষণা শেষে কেরি ওই সময়ের আবহাওয়া রিপোর্ট এবং সকল ঘটনা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন- খারাপ আবহাওয়ার কারণেই হাঁসগুলো মারা গিয়েছিল। স্থান পরিবর্তনের সেই সময়ে হাঁসগুলো বেশি খাওয়ায় তাদের ওজন বেড়ে গিয়েছিল। হাঁসগুলো যখন স্থান পরিবর্তন করছিল তখন এমনিতেই শীতকাল ছিল, তার মধ্যে হুট করেই সেই রাতে তাপমাত্রা আরো কমে যায়। ফলে ফোম লেক, এলফ্রস এবং শেহো অঞ্চলের কাছাকাছি আসার সময় তাদের পাখায় বরফ জমে যায় এবং তারা আর উড়তে পারেনি। প্রচন্ড ঠান্ডায় উপরেই তাদের মৃত্যু হয় এবং মৃত অবস্থায় নিচে আছড়ে পড়তে থাকে।