প্রকৃতির রাজ্যের অনাচার থেকে বাঁচতে মানুষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র তৈরি করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, রাষ্ট্রকাঠামোতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আর নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার নিশ্চিত করতে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের উপর পরবর্তীতে বাধ্যবাধকতা এসেছে অর্থনৈতিক সাম্য নিশ্চিত করার, বাধ্যবাধকতা এসেছে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার। এরপরে একটা দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন উত্তরাধিকারসূত্রে, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল ক্ষুদ্র একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছে।
সীমিত সম্পদের মধ্যে এরকম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীর উপস্থিতি রাষ্ট্রকে ক্রমাগত বিচ্যুত করেছে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা পূরণের জায়গা থেকে, রাষ্ট্রের সুবিধাগুলো সীমাবদ্ধ থেকেছে ক্ষুদ্র স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে। রেনেসাঁর যুগে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতাগুলো নতুন করে উঠে আসে থমাস হবস, জ্যা-জ্যাক রুশো, জন লকের রাজনৈতিক দর্শনে। এদের দর্শনে উদ্ধুদ্ধ হয়ে শুরু হয় আটলান্টিক রেভ্যুলুশন, শুরু হয় আধুনিক গণতন্ত্রের যাত্রা।
আটলান্টিক রেভ্যুলুশনের পরে আধুনিক গণতন্ত্রের ধারাবাহিক বিবর্তনের আলোচনায় উঠে এসেছে দাসদের স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির ইতিহাস, এসেছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। ধারাবাহিক আলোচনায় উঠে এসেছে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনে ফ্রান্সের নাগরিকের ত্যাগের ইতিহাস, এসেছে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোও। স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে রঙিন বিপ্লবের ঘটনাবলি, গণতান্ত্রিক ইতিহাসে আলোচিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্তকে নিয়েও।
আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায়ের দর্শনে আরব বসন্ত আলোচিত হয়েছে ত্রয়োদশতম ঢেউ হিসেবে, তার ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্স্পেক্টিভ’ নিবন্ধে।
আরব বসন্ত
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লবের মতো মোড় পরিবর্তনকারী অনেকগুলো আন্দোলন বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে, প্রত্যক্ষ করেছে আরব বসন্তের মতো রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনকারী মুহূর্তও। ২০১১ সালে ছড়িয়ে পড়া এই বিপ্লবের প্রভাবে আলোড়িত হয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্য, বৈশ্বিক ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে। পরিচিত হয়েছে ‘আরবের জাগরণ , ‘আরবের পুনরুজ্জীবন’, ‘আরবের বসন্ত ও শীত’ নামে। পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের দাবিতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া এ বিপ্লব একের পর এক পতন ঘটিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ধরে থাকা স্বৈরশাসকদের, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বুর্জোয়াদের বৃত্ত ভেঙেছে ।
২০১০ সালে তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া আরব বসন্ত শুরুতেই পতন ঘটায় আবেদিন বেন আলির, পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিসরের হোসনি মোবারকের। আস্তে আস্তে বিপ্লব ছড়িয়ে যায় পাশের দেশগুলোতে। আট মাসের গৃহযুদ্ধের শেষে পতন হয় লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির, পতন হয় ইয়েমেনের আলি আব্দুল্লাহ সালেহরও। এদিকে গৃহযুদ্ধের বৃত্তে ঢুকে যায় বাশার আল আসাদের সিরিয়া। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে বাহরাইন, কুয়েত, লেবানন আর ওমানে। বিপ্লবের প্রভাব পড়েছে সৌদি আরব আর সুদানের মতো দেশেও।
পটভূমি
গণতন্ত্রের সুবাতাস মধ্যপ্রাচ্যে বিংশ শতাব্দীতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। সামরিক কায়দায় একের পর এক দেশে শাসকেরা ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতার পরিবর্তনও হয়েছে সামরিক কায়দায়। দেশের যুগান্তকারী পরিবর্তন আর উন্নত জীবনের বাণী শুনিয়ে আসা শাসকেরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে স্বৈরাচারী হয়েছেন।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা বিরুদ্ধমতকে কঠিনভাবে দমন করেছেন, রাজনীতির মাঠে গড়ে উঠতে দেননি কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতৃত্ব। ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার।
পশ্চিমা গোষ্ঠীগুলোর সাথে শাসকদের বৈরি সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির বিকাশের পথে বাধা তৈরি করে রেখেছিল। ফলে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি, বেকারত্ব বেড়েছে, উচ্চহারে হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। ফলে কমেছে জীবনমান, বেড়েছে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের।
দীর্ঘদিন একই শাসক ক্ষমতায় থাকার ফলে ক্ষমতার বৃত্তে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর তৈরি হয়, দেশের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে দুর্নীতি। আরব দেশগুলোতেও এই সত্যই বারবার উঠে এসেছে। জনগণের বাকস্বাধীনতার জায়গাটি বারবার খর্ব হয়েছে, সীমিত হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার। এর সাথে নাগরিক অধিকারের বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ শাসকদের জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। প্রস্তত হয় বিপ্লবের ক্ষেত্র।
প্রত্যাশা
লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি বা মিসরের হোসনি মোবারকের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ শাসকই দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছিলেন ক্ষমতা। দীর্ঘদিনের এই শাসনের অবসানই ছিলো আরব বসন্তের বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য। উদ্দেশ্যে ছিলো পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
বিপ্লব চলাকালে আরব বসন্ত অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলোর মতো পশ্চিমা প্রভাবক দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে, প্রভাবিত হয়েছে স্থানীয় ধর্মীয় গোষ্ঠী দ্বারাও। ফলে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামোর একটি মিশ্রিত রূপরেখা বেরিয়ে আসে বিপ্লবের মেনোফেস্টো হিসেবে, যাকে অনেকে তুরস্ক মডেল হিসেবেও অভিহিত করেন।
প্রথমত, বিপ্লবীদের প্রথম দাবি ছিলো পরিপূর্ণ গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচন যার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন, জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করবেন।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা দীর্ঘদিন ধরে আরব জনগণকে ভুগিয়েছে। ফলে স্বভাবতই, দ্রুত বিকাশমান এবং মুক্ত অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, বিপ্লবে সেক্যুলার এবং ইসলামপন্থী, দুই ভাবধারার মানুষেরই মিশ্রণ ঘটেছিলো। ফলে তুরস্কের মডেলে সেক্যুলার সংবিধান, ইসলামি ভাবধারার সরকার প্রতিষ্ঠাও লক্ষ্য ছিলো বিপ্লবীদের।
বাস্তবতা
আরব বসন্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এটি পুরো বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নামে হাজার হাজার মানুষ, সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলে প্রতিটি শহরে। সরকারের ব্যাপক নিপীড়ন আর সামরিক বাহিনীর একের পর এক হামলা সত্ত্বেও গণ-আন্দোলন অব্যাহত থাকে, এগিয়ে যেতে থাকে বিপ্লব।
আরব বসন্তে মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন তরুণেরা, মূল পরিবর্তনকামীও ছিলেন তারা। কেন্দ্রীয় কোনো নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠিত হওয়া এ বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো। প্রথাগত গণমাধ্যমের বাইরে এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমেই যোগাযোগ করেছেন বিপ্লবীরা, সংগঠিত করেছেন পরিবর্তনকামীদের।
কিন্তু যে প্রত্যাশা আর স্বপ্ন নিয়ে আরব বসন্ত এসেছিলো, তার খুব বেশি পূরণ হয়নি। একের পর এক স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটেছে, কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জায়গাটি অপূর্ণই রয়ে গেছে। বিপ্লবের অন্যতম কেন্দ্র মিসরে গণতান্ত্রিক সরকার টিকেছে মাত্র এক বছর, পুনরায় ফিরে এসেছে সামরিক সরকার।
আট মাসের গৃহযুদ্ধ লিবিয়ার অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিয়েছে বিশ বছর। অন্তহীন গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হচ্ছে সিরিয়া আর ইয়েমেনে। কুয়েত, লেবানন, ওমানে সরকার পরিবর্তন হলেও শাসকদের কোনো পরিবর্তন আসেনি। আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়েছে সৌদি আরব, মরোক্কো আর জর্ডানের মতো দেশগুলোতেও। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের পরে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নানা মতপার্থক্যের পরেও প্রথম সরকার গণতান্ত্রিক উপায়েই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনও সীমাবদ্ধ অবশ্য।
কেন লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ আরব বসন্ত
যতগুলো স্বপ্ন আর লক্ষ্য নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা বিপ্লবের অংশ হয়েছিলেন, আরব বসন্ত তার অধিকাংশই পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের যাত্রা এখনো কোনো দেশেই শুরু হয়নি, অর্থনীতির অবস্থা আরো নাজুক হয়েছে, আর কয়েকটি দেশ প্রবেশ করেছে অন্তহীন গৃহযুদ্ধে। নতুন করে উত্থান ঘটেছে উগ্রপন্থা, মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে আইএস এর মতো সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর। প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বৈশ্বিক নিরাপত্তাকেই।
প্রথমত, দীর্ঘদিনের শাসনকালে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকেরা রাজনৈতিক কাঠামোকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছেন, নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন এমন সকলকে সরিয়েছেন কাঠামো থেকে। লিবিয়া বা মিসরের সামরিক সরকার পতনের পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামো চালিয়ে নেওয়ার মতো কার্যকর নেতৃত্ব পাওয়া যায়নি। ফলে, সামরিক বাহিনী পুনরায় হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়েছে, বিশৃঙ্খল অবস্থা ঠেলে দিয়েছে গৃহযুদ্ধের দিকে।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ শাসনামলে কর্তৃত্ববাদী আরব শাসকেরা সিভিল সোসাইটির প্রভাবকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছিলেন, রুদ্ধ করেছিলেন সকল মতামত প্রকাশের সুযোগ। ফলে, এই শাসকদের পতনের পরেও কাঠামো আর অভিজ্ঞতা না থাকায় সিভিল সোসাইটি দেশ গঠনে কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি।
তৃতীয়ত, আরব বসন্তের পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও এর কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিলো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা সংগঠিত হয়েছেন, রাজপথে নাগরিক অধিকারের দাবিতে গর্জন তুলেছেন।
কিন্তু এই ধরনের আন্দোলন, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলে এবং কাঠামোগত পরিবর্তন করে, সুসংগঠিত নেতৃত্ব না থাকলে আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয় এবং বিশৃঙ্খল অবস্থার তৈরি করে। আরব বসন্তের পরেও সেটাই হয়েছে ।
চতুর্থত, বিপ্লবে সেক্যুলার তরুণেরা ভূমিকা রেখেছে, প্রভাব ছিলো ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোরও। ফলে পরবর্তীতে এই আদর্শিক দ্বন্দ্বও বিপ্লবের লক্ষ্য পূরণকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
পঞ্চমত, বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য ছিলো শাসক পরিবর্তন করা। পরবর্তীতে সরকার পরিচালনা, রাষ্টকাঠামো চালানোর অনভিজ্ঞতা দেশগুলোর সামরিক বাহিনী, আমলাদের সুযোগ করে দিয়েছে রাষ্ট্রকাঠামোতে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের; বাধাগ্রস্ত করেছে বিপ্লবের লক্ষ্যপূরণকে।
আরব বসন্ত কি ব্যর্থ হয়েছে?
আরব বসন্তের চারটি সম্ভাব্য ফলাফল এখন পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সিরিয়া, লিবিয়ার মতো দেশগুলোতে আরব বসন্তের ঘটনাপ্রবাহ গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছে, আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাছে ইয়েমেন, চলমান গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে দূর্ভিক্ষের সম্ভাবনা। মিসরে নতুন স্বৈরশাসক প্রায় অর্ধযুগ ধরে টিকে আছে ক্ষমতায়, রাজনৈতিক কর্মীদের উপর চালাচ্ছে অকথ্য জুলুম আর নির্যাতন। শুধুমাত্র তিউনিসিয়াতে এসেছে দূর্বল গণতন্ত্র, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের অভাবে যেখানে ধুঁকছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে, মোটাদাগে যে স্বপ্ন আর লক্ষ্য নিয়ে আরব বসন্তের আগমন হয়েছিলো, তার অধিকাংশই অপূর্ণ রয়ে গেছে।
তবুও, আরব বসন্ত কি ব্যর্থ হয়েছে? ব্যর্থ হয়েছে আরব তরুণদের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার স্বপ্ন? উত্তরটি হচ্ছে, না। আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়নি।
প্রথমত, আধুনিক গণতন্ত্রের দীর্ঘ আলোচনায় আমরা ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকার জাতিরাষ্ট্রের উদাহরণগুলো মূল্যায়ন করতে বলতে পারি, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, প্রয়োজন কয়েক প্রজন্মের ত্যাগ। মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্তের যে ফলাফলগুলো আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সেগুলো উদার গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও, এটি শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া।
দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকদের একটা বড় অংশই অশিক্ষিত, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা না থাকায় অভাব রয়েছে রাজনৈতিক পরিপক্কতারও। আরব বসন্তের যে ঘটনাগুলো এবং এর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেছি এই নিবন্ধে, সেগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় আরব বসন্তের প্রথম পর্ব হিসেবে। পরবর্তী পর্যায়ে এই পর্বের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহগুলো পথ দেখাবে আরবের নতুন প্রজন্মকে, ত্বরান্ত্বিত করবে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।
আফ্রিকাতে বিউপনিবেশায়নের পরে আরব মাধ্যমেই রাষ্ট্রকাঠামোতে অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এখনও বিদ্যমান রয়েছে আরব বসন্তের প্রভাব, আস্তে আস্তে আসবে আরো বহু পরিবর্তন। আন্দোলনকারীদের স্বপ্ন পূরণে কতটা সফল হবে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো, তা দেখার জন্য আরো অপেক্ষার প্রয়োজন আছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন একদিনে হয় না, স্বল্প সময়ে হয় না। প্রয়োজন সকল পক্ষের সহযোগিতা আর জাতীয়তাবাদ, প্রয়োজন দীর্ঘ সময়।
পৃথিবীর সবগুলো দেশে জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে, মানুষের নাগরিক অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ নিশ্চিত করতে আধুনিক গণতন্ত্রকে হয়তো আরো অনেকগুলো পর্বের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতে। রাষ্ট্রের যেমন চরম উৎকর্ষ নেই, তেমনি নেই কোনো পরম পরিণতি। মানুষের সবসময়ই চেষ্টা বজায় থেকেছে এই বাধ্যবাধকতাগুলোকে পূরণ করে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের সেই প্রচেষ্টার সর্বশেষ পর্ব ছিল আরব বসন্তের ঘটনাপ্রবাহ। ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রকে নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবে, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বদলে দেবে রাষ্ট্রের মূল্যবোধ। সময়ের সেই আলোচনার প্রতি উষ্ণ নিবেদনে আধুনিক গণতন্ত্রের উপর ধারাবাহিক আলোচনার সমাপ্তি হচ্ছে।