মশা! ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির অত্যাচারে প্রায়ই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে আমাদের জীবন। চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপে মশার দিকেই প্রধানত আঙুল তোলা যায়, কারণ রোগের ভাইরাস ছোট্ট এই পতঙ্গের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তবে কেবল ডেঙ্গু নয়, আরো বেশ কিছু রোগের ভাইরাস বহন করে থাকে মশা, যার মধ্যে আছে চিকুনগুনিয়া (Chikungunya ), ম্যালেরিয়া, এনকেফালাইটিস, ফাইলেরিয়াসিস, জিকা ইত্যাদি।
মশার তিনটি প্রজাতি এসব রোগের ভেক্টর, বা জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। এগুলো হচ্ছে কিউলেক্স, এডিস আর অ্যানোফিলিস। কিউলেক্স তো আমাদের ঘরবাড়ির স্থায়ী বাসিন্দাই হয়ে গেছে বলা যায়, এডিস সেখানে মৌসুমি অতিথি। অ্যানোফিলিস আবার একটু ঘরকুণো, পার্বত্য অঞ্চলেই থাকে বেশি।
চিকুনগুনিয়া
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ভারত উপমহাদেশে অন্তত ১১ বার চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রকোপ লক্ষ্য করা গিয়েছে। ২০০৮ আর ২০১১ সালে বাংলাদেশে ছোট আকারে দেখা দিয়েছিল এই অসুখ, আর ২০১৭ সালে তো পরিণত হয়েছিলো অনেকটা মহামারীতে। এরপর থেকে প্রতি বছরেই গরমের সময় চিকুনগুনিয়া হয়ে আসছে।
এর কারণ একই নামের ভাইরাস (chikungunya virus /CHIKV)। নারী এডিস মশা এই জীবাণু বহন করে, রক্তপানের সময় মানবশরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয় ভাইরাস। সাধারণত উচ্চমাত্রার জ্বর, শরীরে ফোস্কা আর অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (joint pain) এই রোগের অন্যতম লক্ষণ, যা কিনা ডেঙ্গুর সাথেও অনেকাংশে মিলে যায়। চিকুনগুনিয়ার জন্য অস্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এবং রোগ ভালো হয়ে গেলেও সামান্য ব্যথা থেকে যেতে পারে বছরখানেক।
চিকুনগুনিয়া সাধারণত মারাত্মক কিছু নয় এবং এমনিতেই সেরে যায়। তবে স্বল্পসংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে স্নায়ু, হৃদযন্ত্র, লিভার, এমনকি শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এই ভাইরাস শরীরে ঢুকলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়া অথবা ভ্রুনের সংক্রমণ ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে।
ডেঙ্গু
মশাবাহিত আরেক রোগ ডেঙ্গু, যা কিনা ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ঘটে থাকে। চিকুনগুনিয়ার মতো এখানেও বাহক সেই নারী এডিস মশা। মূলত ২০০০ সালের পর থেকে ডেঙ্গু আমাদের দেশে বড় একটা স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, তবে প্রথম রোগী কিন্তু শনাক্ত হয় ষাটের দশকে। তখন একে বলা হতো ঢাকা’র জ্বর (Dacca fever)। বর্তমানে প্রতি বছরই মহামারী আকারে ডেঙ্গু দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশকে ডেঙ্গুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের মতে, জনসংখ্যার অন্তত ৫২% লোক এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে আছে।’
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রায় ১০৩-১০৪° ফারেনহাইট জ্বর, শরীর ব্যথা, হাড়গোড়ে আর মাংসপেশীতে ব্যথা, শরীরে ফোস্কা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। সাধারণত ২-৭ দিনের মধ্যে রোগী ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু লক্ষণ থাকলে রোগীকে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত, যেমন- প্রচণ্ড পেটব্যথা বা পেট ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়া, অবিরাম বমি হওয়া ইত্যাদি। ডেঙ্গু সন্দেহ হলে তাই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ম্যালেরিয়া
ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার আগে মানুষ মশাবাহিত রোগ বলতে বুঝতো ম্যালেরিয়াকেই। পরজীবী বা প্যারাসাইটজনিত এই রোগ ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে নারী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে। আমাদের দেশে ভারত আর মায়ানমারের সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলায় এই রোগ এন্ডেমিক (endemic)। এর মানে সারা বছরই ঐসব এলাকায় ম্যালেরিয়া দেখা যায়। ফলে কেউ সেখানে ঘুরতে যেতে চাইলে ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে যাবার উপর জোর দেয়া হয়।
ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও রোগের সূচনা জ্বর দিয়ে, তবে এখানে ভয়াবহ রকম কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। সাথে থাকে মাথাব্যথা, মাংসপেশীতে ব্যথা আর ক্লান্তি। রোগীর রক্তশুন্যতা আর জন্ডিসও দেখা যেতে পারে। তবে ভয় পাবার কারণ নেই, কারণ ম্যালেরিয়ার খুব ভালো কিছু ওষুধ রয়েছে। রোগী কী ওষুধ খাবেন সেটা চিকিৎসক ঠিক করে দেবেন।
এনকেফালাইটিস
মস্তিষ্কের ইনফ্ল্যামেশনকে এনকেফালাইটিস বলা হয়। বেশ কিছু ভাইরাস থেকে এই রোগ হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে জাপানিজ এনকেফালাইটিস ভাইরাস বা জেই (Japanese encephalitis), এবং ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। দুটোই ছড়ায় কিউলেক্স প্রজাতির মশা দিয়ে, যা কিনা তিন প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
এশিয়াতে জেই ভাইরাস ঘটিত এনকেফালাইটিসই বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে গবেষণা না থাকলেও একেই মূল কালপ্রিট বলে ধরা হয় জীবাণুবাহক মশা কামড়ানোর ৫-১৫ দিনের মধ্যে রোগীর জ্বর, মাথাব্যথা, বমি এসব দেখা যায়। অনেকসময় ঘাড়ব্যথা বা ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি ইত্যাদিও হতে পারে। এনকেফালাইটিস মারাত্মক রোগ, সুতরাং রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে।
জিকা
নারী এডিস কর্তৃক বাহিত আরেকটি ভাইরাস জিকা, যা থেকে উৎপত্তি হতে পারে রোগের। লক্ষণ অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতোই, সাথে চোখ লাল হতে পারে। এক সপ্তাহ পর রোগী সাধারণত ভালো হয়ে যান।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য জিকার সংক্রমণ অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে বাচ্চা জন্ম নিতে পারে নানারকম শারীরিক ত্রুটি নিয়ে, যাকে বলা হয় Congenital Zika Syndrome। অনেক সময় বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, অথবা প্রসব হয়ে যেতে পারে সময়ের অনেক আগেই (preterm birth)।
লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস
একসময় ঢাকা শহরে দেখা মিলত এমন কিছু মানুষের যাদের হাত অথবা পা ছিল ভয়াবহভাবে ফোলা। এর কারণ লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস নামে পরজীবীঘটিত একটি রোগ। কিউলেক্স, এডিস, অ্যানোফিলিস তিন প্রজাতির মশাই এদের বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে। লসিকা গ্রন্থির সংক্রমণ থেকে এই রোগের উৎপত্তি হয়। বাংলাদেশ একসময় লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিসের উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল, তবে বিভিন্ন প্রতিরোধক ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত চিকিৎসায় এখন এই রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। সঠিক ওষুধ প্রয়োগে ভালো হয়ে উঠেছেন বহু লোক।
মশা থেকে ছড়াতে পারে অনেক রকম অসুখ। সেজন্য বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা দরকার, যাতে মশা বংশবৃদ্ধির সুযোগ না পায়। ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমরা থাকতে পারবো সুস্থভাবে।