অজস্র কাজের চাপে যখন ক্লান্তি এসে ভর করে তখন হয়তো আপনি আপনার কোনো প্রিয় গান শোনেন। শুনতে শুনতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ডুব দিতে চান অন্য কোনো ভুবনে। আবার বৃষ্টিতে পথঘাট যখন কাদায় পূর্ণ, তখন হয়তো পিছলে পড়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে কোনোমতে খেই ধরলেন। এসব ক্ষেত্রে যে জিনিসটি আপনাকে সাহায্য করে থাকে তাকে কিন্তু আপনি খুব একটা মনে করেন না। সেটি হলো আপনার মাথার দুই পাশে থাকা দুটি কান।
দেহের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবেদি অঙ্গ হলো কান। সাধারণত কান বলতে আমরা মাথার দুই দিকে বেরিয়ে থাকা অঙ্গটিকে বুঝি। আর এটা জানি যে, কানের ভেতর একটা পর্দা আছে, এটি ছিড়ে গেলে আর কিছু শুনতে পাবো না। তবে বাইরের অংশ আর ভেতরের পর্দা, এমন সরল নয় কানের গঠন। এতে বেশ কয়েকটি অংশ আছে, যা স্তরে স্তরে আমাদের শ্রবণ ও ভারসাম্যের কাঠামো তৈরি করে। তাই কানের শ্রবণ ও ভারসাম্যের প্রক্রিয়া বুঝতে হলে কানের গঠন সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই।
গঠন
আমরা কান বলতে শুধু বাইরের অংশটিকে বোঝালেও কানের ভেতরে আরও অংশ রয়েছে। কানকে মোট তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। বহিঃকর্ণ, মধ্যঃকর্ণ এবং অন্তঃকর্ণ। নিচের ছবিতে দেখলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। বহিঃকর্ণের আবার তিনটি অংশ রয়েছে। আমরা কানের বাইরে যে অংশটি দেখি তাকে পিনা বা কর্ণচ্ছত্র বলে। কানের এই অংশটি স্থিতিস্থাপক তরুণাস্থি দিয়ে তৈরি। এজন্যই একে আমরা ভাঁজ করতে পারি। তাই ছোটবেলায় কোনো পড়া না পারলে শিক্ষক যখন কান মলে দিতেন, তারপর কিন্তু ওটা আবার আগের জায়গায় চলে আসতো। পিনার পরে একটি সরু ছিদ্র পথ চলে গেছে কানের ভেতরে, আর সেই ছিদ্রপথের শেষ অংশে রয়েছে একটি পর্দা। কানের ভেতরে চলে যাওয়া সরু ছিদ্রপথটিকে বহিঃঅডিটরি মিটাস বা কর্ণকুহর বলে এবং ঐ পর্দাটিকে টিম্পেনিক পর্দা বা কর্ণপটহ বলে। নামগুলো শুনতে খটমটে লাগলেও বিষয়টা খুবই সহজ।
মধ্যকর্ণে তিনটি অংশ রয়েছে; কর্ণাস্থি, ইউস্টেশিয়ান নালী এবং কর্ণ ছিদ্র। শুনতে অবাক লাগলেও আমাদের কানের ভেতর তিনটি হাড় বা অস্থি আছে। হাড়গুলোর নাম ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস এবং ঠিক এই ক্রমেই তারা সজ্জিত থাকে। হাড়গুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। আমরা নিচের চিত্রে খেয়াল করলে দেখবো ম্যালিয়াস টিম্পেনিক পর্দার সাথে যুক্ত অবস্থায় থাকে। ম্যালিয়াস দেখতে হাতুড়ির মতো। ইনকাস দেখতে নেহাইয়ের মতো এবং স্টেপিস দেখতে ঘোড়ার জিনের পা দানির মতো। আমরা অনেকে নেহাই কী তা জানি না। কামাররা গরম লোহা যে জিনিসের উপর রেখে পেটায় তাকে নেহাই বলে। স্টেপিস মানবদেহের সবচেয়ে ছোট হাড়।
আমাদের মধ্যকর্ণে দুটি ছিদ্রও আছে। তাদের নাম ফেনেস্ট্রা ওভালিস এবং ফেনেস্ট্রা রোটান্ডা। আমাদের কানের হাড় স্টেপিস কানের ছিদ্র ফেনেস্ট্রা ওভালিসের সাথে লাগানো অবস্থায় থাকে। মধ্যকর্ণের আরেকটি অংশ হলো ইউস্টেশিয়ান নালী। ইউস্টেশিয়ান নালী গলবিলের সাথে সংযুক্ত থাকে। আমাদের নাক, কান দুটিই কিন্তু গলবিলের সাথে সম্পর্কিত। ইউস্টেশিয়ান নালী আমাদের কানের মধ্যকার চাপ নিয়ন্ত্রণ করে। যদি হঠাৎ কোনো বিকট শব্দ আমাদের কানে প্রবেশ করে, সেক্ষেত্রে ইউস্টেশিয়ান নালী দিয়ে বাড়তি চাপটা বের হয়ে যায়। ইউস্টেশিয়ান নালী না থাকলে বিকট শব্দ হলে আমাদের কানের পর্দা ফেটে যেত।
আমাদের কানের তৃতীয় ভাগ অন্তঃকর্ণে দুটি অংশ রয়েছে। ইউট্রিকুলাস এবং স্যাকুলাস। আমরা প্রথমেই জেনেছি কান দুটি কাজ করে। শ্রবণ এবং ভারসাম্য রক্ষা। ইউট্রিকুলাস আমাদের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে এবং স্যাকুলাস শ্রবণে সাহায্য করে।
এবার ইউট্রিকুলাস এবং স্যাকুলাসের গঠনটা একটু জেনে নেয়া যাক। ইউট্রিকুলাস তিনটি অর্ধ বৃত্তাকার নালী দিয়ে গঠিত। নালীগুলো পরস্পরের সাথে সমকোণে অবস্থান করে। এই তিনটি নালী তিনটি মাত্রায় অবস্থান করে। ফলে আমরা যখন ত্রিমাত্রিক তলে চলাচল করি তখন তিনটি অর্ধ বৃত্তাকার নালী তিনদিকে কাজ করে এবং আমাদের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। নালীগুলো এন্ডোলিম্ফ নামক তরলে পূর্ণ। নালীগুলোর মাঝে ফোলা অংশ থাকে, তাকে অ্যাম্পুলা বলে।
অন্তঃকর্ণের আরেকটি অংশ হলো স্যাকুলাস। স্যাকুলাস শ্রবণে সাহায্য করে। স্যাকুলাসে নালী পেচিয়ে পেচিয়ে শামুকের মতো একটি অংশ সৃষ্টি করে, যাকে ককলিয়া বলে। স্যাকুলাসের ভেতর এন্ডোলিম্ফ এবং পেরিলিম্ফ নামক তরল থাকে। স্যাকুলাসের স্তর মোট তিনটি। স্তর তিনটি হলো স্ক্যালা ভেস্টিবুলি, স্ক্যালা মিডিয়া এবং স্ক্যালা স্টিম্পেনি। যেখানে স্ক্যালা ভেস্টিবুলি সবার উপরে, তারপর স্ক্যালা মিডিয়া এবং তারপর স্ক্যালা স্টিম্পেনি অবস্থিত। স্ক্যালা ভেস্টিবুলি এবং স্ক্যালা টিম্পেনিতে অর্থাৎ উপরের এবং নিচের স্তরে পেরিলিম্ফ নামক তরলে পূর্ণ থাকে। স্ক্যালা মিডিয়া অর্থাৎ মাঝের স্তরে এন্ডোলিম্ফ নামক তরল পদার্থ থাকে। এখানে একটি জিনিস বলে রাখা ভালো। আমাদের অন্তঃকর্ণ তরলে পূর্ণ। আর আমাদের মধ্যকর্ণ বায়ুপূর্ণ।
শ্রবণ কৌশল
আমরা যদি কানের গঠন খুব ভালো করে বুঝে থাকি তাহলে আমরা কানের শ্রবণ কৌশলও খুব সহজেই বুঝতে পারবো। আমরা যদি কানের গঠনটি কল্পনা করি শ্রবণের পুরো কৌশলটিই আমাদের চোখের সামনে ভাসবে। ধরুন, আপনি কোনো রেস্টুরেন্টে বসে আছেন। সেখানে হালকা আওয়াজে বাজানো হচ্ছে জন ডেনভারের গান। তখন গানটি শব্দ তরঙ্গ হিসেবে আপনার কানের পিনাতে এসে আঘাত করবে। তারপর তা কানের ছিদ্রপথ বা বহিঃঅডিটরি মিটাস দিয়ে টিম্পেনিক পর্দায় আঘাত করবে। ফলে টিম্পেনিক পর্দায় একটি কম্পনের সৃষ্টি হবে। যেহেতু টিম্পেনিক পর্দার সাথে আমাদের মধ্যকর্ণের হাড় ম্যালিয়াস লাগানো অবস্থায় থাকে, ফলে টিম্পেনিক পর্দা থেকে কম্পন ম্যালিয়াসে চলে যায়। এভাবে সবগুলো কর্ণাস্থি কেঁপে উঠে। স্টেপিসের সাথে আবার কানের ছিদ্র ফেনেস্ট্রা ওভালিস সংযুক্ত থাকে। এভাবে শব্দ তরঙ্গ কানের ভেতর প্রবেশ করতে থাকে। বহিঃকর্ণ এবং মধ্য কর্ণে প্রবেশ করার পর শব্দ তরঙ্গ এবার অন্তঃকর্ণে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত। নীচের ভিডিওতে আপনি কর্ণাস্থির কম্পন দেখতে পাবেন।
আমরা জানি, অন্তঃকর্ণের স্যাকুলাস অংশটি কেবল আমাদের শ্রবণে সাহায্য করে। ফেনেস্ট্রা ওভালিস পর্যন্ত আসা সেই শব্দ তরঙ্গ স্যাকুলাসের তিনটি স্তরকেই আন্দোলিত করে। ফেনেস্ট্রা ওভালিস থেকে সে কম্পন স্ক্যালা ভেস্টিবুলিতে ছড়িয়ে যায়। স্ক্যালা মিডিয়ার উপরের ঝিল্লীকে রেসনার ঝিল্লী এবং নিচের ঝিল্লীকে বেসিলার ঝিল্লী বলে। স্ক্যালা ভেস্টিবুলি থেকে কম্পন স্ক্যালা মিডিয়াতে আসে এবং তা বেসিলার ঝিল্লীকে আন্দোলিত করে। বেসিলার ঝিল্লীর সাথেই অবস্থান করে অর্গান অব কর্টি। অর্গান অব কর্টি আমাদের শোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। অর্গান অব কর্টিতে রোম থাকে যা আন্দোলিত হলে ভেস্টিবুলার স্নায়ুর মাধ্যমে সে সিগন্যাল মস্তিষ্কে চলে যায়। মস্তিষ্ক এই সিগন্যালকে শব্দ হিসেবে আমাদের শোনায়।। এভাবেই আমরা শব্দ শুনতে পাই।
ভারসাম্য কৌশল
ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইউট্রিকুলাস কাজ করে। ইউট্রিকুলাসের অর্ধবৃত্তাকার নালীর ভেতরের ফোলা অংশকে অ্যাম্পুলা বলে। অ্যাম্পুলার ভেতরে সংবেদী রোম থাকে। এই সংবেদী রোমগুলোই কান আমাদের দৈহিক অবস্থানের বার্তা দিতে সাহায্য করে । সংবেদী রোমের চারদিকে ঘিরে থাকে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ওটোলিথ দানা। সংবেদী রোমের চারদিকে ওটোলিথ দানা যুক্ত এই আবরণকে ক্যুপুলা বলে । এখন যদি আপনি হাঁটার সময় পা পিছলে কোনো একদিকে হেলে যান, ক্যুপুলাও সেদিকে হেলে যাবে। ফলে সংবেদী রোমও বেঁকে যায়। তখন এটি সিগন্যাল আকারে ভেস্টিবুলার স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। তখন আপনি যেদিকে হেলে গিয়েছেন মস্তিষ্ক তার অপর পাশের পেশীকে সঙ্কুচিত হওয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে আপনি পড়ে যান না। এভাবেই কান আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে। এভাবেই আমাদের শ্রবণ ও ভারসাম্য রক্ষায় নিরবে কাজ করে যাচ্ছে কান। তাকে একটি ধন্যবাদ তো দিতেই পারেন।
ফিচার ইমেজ: Video Blocks