মহাকাশ নিয়ে কম বেশি সবার মধ্যেই বিস্ময় আর জানার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। আমরা ছোটবেলা থেকে বইপত্রে মহাকাশ সংক্রান্ত অসাধারণ তথ্যাবলী পড়েছি। আমাদের জ্ঞানের পরিসীমা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। মহাকাশযান পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরাও নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে লাগলেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত আধুনিক হচ্ছে, মহাকাশ নিয়ে কৌতূহল কিংবা গবেষণার পরিমাণও ততো বাড়ছে। বাড়ছে মহাকাশযাত্রার সংখ্যা, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে নভোযান উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অদৃশ্য প্রতিযোগিতা।
২০১৯ এর পুরো বছর জুড়ে থাকছে অসাধারণ সব ঘটনাপ্রবাহ যা মহাকাশপ্রেমীদের জন্য বেশ উত্তেজনাকর ব্যাপার বটেই। গত বছর, ২০১৮ সালও ছিল তেমনই উত্তেজনা আর আবিষ্কারের বছর। স্পেসএক্স গত বছর তাদের প্রথম ফ্যালকন হেভি রকেট মহাশূন্যে পাঠায়। পাশাপাশি একটি লাল টেসলা গাড়ি মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের দিকে পাঠানো হয়।
একটি গাড়ি মহাশূন্যে ভাসছে, ভাবতেই কেমন লাগে, তাই না? এদিকে নাসাও বসে থাকেনি। পৃথিবীর মতো বসবাসোপযোগী গ্রহ খুঁজে বের করতে নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তারাও। সূর্যকে ছুঁতে একটি প্রোব পাঠিয়েছে নাসা। তাদের ইনসাইট রোবট মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেছে এবং সেটি মঙ্গলের অসাধারণ সব ছবি পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। ২০১৯ এর পুরোটা সময় জুড়ে ব্যস্ত থাকবেন মহাকাশ নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেই সাথে পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে একেকটি বিস্ময়কর মহাজাগতিক ঘটনা। কী কী ঘটবে ২০১৯ সালে?
আলটিমা থিউলি
এই বছরের প্রথম দিনে নাসার নিউ হরাইজন নামক মহাকাশযান একটি বিশাল মাইলফলকের জন্ম দিয়েছে। এটি আলটিমা থিউলি নামক একটি পাথর খন্ডের কাছে গিয়েছে যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন মাইল দূরে এবং যাকে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরা হচ্ছে। মহাকাশযানটি ২০১৫ সালে প্লুটোর কাছে গিয়ে থেমে থাকেনি বরং আরো দূরে যেতে থাকে। জানুয়ারির ১ তারিখে আলটিমা থিউলির কাছে পৌঁছায়। পাথর খন্ডটি প্রায় একটি শহরের সমান বড়।
কোয়াড্রানটিডস
জানুয়ারির নিকষ কালো আকাশে একধরনের উল্কা বৃষ্টির দেখা পাওয়া গিয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে কোয়াড্রানটিডস। এই বছরের জানুয়ারির ৩-৪ তারিখ রাতের আকাশে এই উল্কা বৃষ্টি উপভোগ করছে হাজার হাজার মানুষ। ঘণ্টায় ৫০-১০০টি উল্কা দেখা গিয়েছে এ সময়।
আংশিক সূর্যগ্রহণ
৬ জানুয়ারিতে পৃথিবীর আকাশে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছে। চাঁদ আংশিকভাবে সূর্যকে ঢেকে দেয়ায় এমনটা দেখা যায়। চীন, কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষজন এই আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখতে পেয়েছেন।
ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান
এলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স জানুয়ারির ১৭ তারিখ একটি পরীক্ষামূলক নিক্ষেপের পরিকল্পনা করছে। প্রথমবারের মতো পৃথিবীর কক্ষপথে ফ্লোরিডার কেপ কেনেভ্রাল থেকে ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান পাঠাবে স্পেসএক্স। তাদের লক্ষ্য নাসার মহাকাশ শাটল ফ্লিটের নির্দিষ্ট স্থান গ্রহণে সাহায্য করা ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশচারীদের যাতায়াতে সহায়তা করা।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ
আগামী জানুয়ারির ২০ তারিখে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আকাশে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে। পূর্ণিমার সময় পৃথিবী সূর্যকে ঢেকে ফেললে এই মহাকাশীয় ঘটনার দেখা মিলবে।
চন্দ্রযান-২
ভারতের আইএসআরও নামক মহাকাশ সংস্থা ২০০৮ সালে তাদের প্রথম মহাকাশযান চাঁদে পাঠায় যার নাম চন্দ্রযান-১। তারই ধারাবাহিকতায় এই বছরের জানুয়ারির ৩০ তারিখে তারা আবারও চন্দ্র অভিযানে পাঠাচ্ছে চন্দ্রযান-২। চাঁদের পৃষ্ঠ অন্বেষণ এই অভিযানের লক্ষ্য। তাই তারা একটি অক্ষীয় যান, একটি অবতরণকারী যান এবং ছয় চাকা বিশিষ্ট রোভার পাঠিয়েছে।
নাসার জুনো মহাকাশযান
২০১৬ সালে নাসার একটি মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহে পৌঁছায়। গ্রহটির অসাধারণ কিছু ছবি পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই পাঠিয়েছে সেটি। নাসা এই অভিযানে বেশ কিছু বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। যার মধ্যে একটি হলো বৃহস্পতির সেই অদ্ভুত লাল অংশটি (Great Red Spot) কেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আরো তথ্য পাবার জন্য নাসা জুনোর ভ্রমণকাল আরো কয়েক বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরো গ্রহের কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে মহাকাশযানটির সময় লাগে ৫৩.৫ দিন যাকে পেরিজোভে বলা হয়। ১৮তম পেরিজোভেটি হবে ১২ ফেব্রুয়ারিতে। এমন পেরিজোভ এইবছর আরো ৬ বার হবে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের স্প্যারো চন্দ্রযান
ইসরায়েলের একটি অলাভজনক বেসরকারি মহাকাশযান ১৩ ফেব্রুয়ারি চাঁদের উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে চড়ে রওনা হবে। রওনা দেওয়ার দুই মাস পর এটি চাঁদে অবতরণ করবে বলা ধারণা করা হচ্ছে। স্পেসআইএল নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং যানটি চাঁদে অবতরণ করার পর প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্পেসআইএল এর নাম ইতিহাসে স্থান পাবে। চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে অবতরণের খেতাব পাবে ইসরায়েল। ইসরায়েলের একজন ব্যবসায়ী এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে অর্থ ব্যয় করছেন বলে জানা যায়।
সিএসটি-১০০ স্টারলাইনার
স্পেসএক্স যেমন তাদের ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানের মাধ্যমে নাসার মহাকাশ শাটলের স্থান নিতে চাইছে সেভাবেই বোয়িং একটি স্টারলাইনার মহাকাশযান নিক্ষেপের পরিকল্পনা করছে; যা মহাকাশচারী পরিবহনের কাজ করবে। বছরের মার্চের দিকে এই যানটি পাঠানো হবে কিন্তু এটিও হবে পরীক্ষামূলক। এটিতে আপাতত কোনো মানুষ চড়বে না।
ফ্যালকন হেভি রকেট
এই বছরের শুরুর দিকে স্পেসএক্স দুটি ফ্যালকন হেভি রকেট মহাকাশে প্রেরণ করছে। প্রথমটি হচ্ছে মহাকাশ পরীক্ষা প্রোগ্রাম-২। এটির লক্ষ্য হলো কিছু সামরিক স্যাটেলাইট ও নাসার গভীর মহাকাশীয় পারমাণবিক ঘড়ি (Atomic clock) কক্ষপথে প্রেরণ করা। এই পারমাণবিক ঘড়িটি যোগাযোগ ও দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আরবস্যাট- ৬ এ হচ্ছে একটি স্যাটেলাইট যা ফ্যালকন হেভি রকেটের দ্বিতীয় সংস্করণ।
পার্কার সোলার প্রোব (পিএসপি)
মানুষের তৈরি সবচেয়ে দ্রুতগামী বস্তু হচ্ছে নাসার পার্কার সোলার প্রোব। সূর্যের কাছে গিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করাই এর কাজ। এটি এতটাই দ্রুতগতি সম্পন্ন যে গত বছরের নভেম্বরের ৫ তারিখ এটি প্রতি সেকেন্ডে ১২০ মাইল গতিতে সূর্যের কাছ দিয়ে উড়ে গেছে। এই গতিতে নিউ ইয়র্ক থেকে টোকিওতে এক মিনিটেরও কম সময়ে যাওয়া সম্ভব। এ বছর এপ্রিলের ৪ তারিখ ও সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ মোট দুইবার সূর্যের কাছে দিয়ে উড়ে যাবে এই যানটি।
ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান
জানুয়ারিতে হওয়া পরীক্ষামূলক যাত্রাটি যদি সফল হয় তাহলে স্পেসএক্স তাদের ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানটি নাসার দুজন মহাকাশচারী সহ ১৭ জুন মহাশূন্যে প্রেরণ করবে। এটি হবে তাদের যাত্রীসহ প্রথম ভ্রমণ। সেই দুজন ভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছেন ডাগ হারলি ও বব বেনকেন।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ
এই বছরের মাঝামাঝি, জুলাইয়ের ২ তারিখে একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ যাবে। এটি দেখতে হলে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছাকাছি থাকতে হবে এবং সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে চিলি, আর্জেন্টিনা ও প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু জায়গা।
নিউ জেনারেশন মহাকাশযান
পৃথিবীর এত এত সংস্থা মহাকাশ নিয়ে কত পরিকল্পনা করছে, রকেট পাঠাচ্ছে, মহাকাশযান পাঠাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে অনেকদূর। এসবের মধ্যে চীনের মতো দেশ তো আর বসে থাকতে পারে না। তাই এই বছরের মাঝামাঝিতে একটি মহাকাশযানের পরীক্ষামূলক যাত্রা করবে। যার নাম দিয়েছে নিউ জেনারেশন ম্যানড মহাকাশযান। প্রথমেই তারা কোনো মানুষ পাঠাচ্ছে না। কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য হলো ৪-৫ জন চীনা নভোচারীকে কক্ষপথে পাঠানো।
আংশিক চন্দ্রগ্রহণ
আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া থেকে জুলাইয়ের ১৬ তারিখে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে।
পারসিডস
বছরের অন্যতম আকর্ষণীয় উল্কা বৃষ্টি পারসিডস নামে পরিচিত যা এই বছরের ১২-১৩ আগস্ট পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঐ সময় পূর্ণিমা থাকবে তাই হয়তো ভালোভাবে উপভোগ করা যাবে না।
চাংই’-৫
গবেষণার জন্য চাঁদের মাটির স্যাম্পল নেয়ার জন্য চীন একটি চন্দ্রাভিযানে চাংই’-৫ কে পাঠাবে ২০১৯ এর শেষের দিকে। এতে তারা যদি সফল হয় তাহলে এটি হবে চীনের প্রথম চন্দ্র মাটি সংগ্রহণ।
জেমিনিডস
বছরের শ্রেষ্ঠ উল্কা বৃষ্টি হচ্ছে জেমিনিডস। এটি এতটাই আকর্ষণীয় যে রাতের আকাশে মিনিটে একাধিক উল্কার দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু আবারো দুর্ভাগ্যবশত এই সময়টাতে পূর্ণিমা থাকবে। তবুও চাঁদের আলোর কারণে উজ্জ্বল উল্কার ঝলকানি দেখতে ব্যঘাত হবে না খুব বেশি। এ বছর ১৩-১৪ ডিসেম্বরে জেমিনিডস উল্কা বৃষ্টি দেখা যাবে।
বলয়াকার সূর্যগ্রহণ
চাঁদ সবসময় পৃথিবীর চারিদিকে সমানভাবে প্রদক্ষিণ করে না। ফলে মাঝে মাঝে চাঁদকে অনেক ছোট ও দূরে দেখায়। এরকম অবস্থায় যদি চাঁদ সূর্যকে ঢেকে ফেলে তাহলে সূর্যের বৃত্তাকার পরিসীমা বাদে শুধুমাত্র মাঝের অংশ ঢাকা পড়ে। যার ফলে অদ্ভুত সুন্দর বলয়াকার সূর্যগ্রহণের সৃষ্টি হয়। ২০১৯ এর ২৬ ডিসেম্বর এই ঘটনাটি ঘটবে বলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন। ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার কিছু জায়গা এবং পাশাপাশি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু কিছু জায়গা থেকে এই সূর্যগ্রহণটি দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।