গবেষণা; ছোট্ট এ শব্দটির জন্য একজন গবেষককে সইতে হয় কতই না যাতনা! পোহাতে হয় পেরেশানি, কাটাতে হয় অগণিত বিনিদ্র রজনী। হবেই না বা কেন? শব্দটি ছোট হলেও এর গুরুত্ববহ কাজ নীল গ্রহ পৃথিবীকে ছাড়িয়ে দূরবর্তী গ্রহ-নক্ষত্রেও পৌঁছে গেছে আজ। কল্পনাশক্তির এমন অভাবনীয় সৃজনকর্মে সমাজ-সভ্যতায় লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। নাগরিক জীবনে এসেছে স্বাচ্ছন্দ ও স্বস্তিবোধের উচ্ছ্বাস। এই যেমন সকালের পেস্ট থেকে রাতের এসি রুমে রেস্ট পর্যন্ত সবই এই গবেষণার ফসল।
প্রাচীর প্রস্তর যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত কয়েক ধাপে বিবর্তন ঘটেছে গবেষণা পরিচালনায়। অনুমাননির্ভর লিটারেচার রিভিউও রূপান্তরিত হয়েছে সুনিপুণ এআই টুলস, সফটওয়্যার ও ওয়েবসাইটের আধুনিকতায়। চলুন, আজ জেনে আসা যাক তেমনই পাঁচটি দারুণ টুল ও ওয়েবসাইটের চমকপ্রদ কাজ নিয়ে।
সায়েন্সডিরেক্ট
লিটারেচার রিভিউয়ের প্রাথমিক ধাপ গবেষকের ফিল্ড অব ইন্টারেস্টের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রাসঙ্গিক লিটারেচার বা আর্টিকেল সংগ্রহ করা। বেশিরভাগ গবেষক ও শিক্ষাবিদরা এসব লিটারেচার সংগ্রহে প্রাধান্য দেন গুগল স্কলার কিংবা রিসার্চগেইটকে। কিন্তু, এদের পাশাপাশি এমন আরও কতক ওয়েবসাইট আছে যেগুলো গবেষণার লিটারেচার সংগ্রহে হতে পারে বেশ সহায়ক। এই যেমন সাইলিট, পাবমেড কিংবা সায়েন্সডিরেক্ট-এর মতো সাইটগুলো। এসব ওয়েবসাইটের এডভান্স সার্চ আপনাকে সাহায্য করবে মূহুর্তের মধ্যে চমৎকার সব ফিল্ড রিলেটেড লিটারেচার সংগ্রহে।
স্কোপাসের অধীনস্থ বিশ্বস্ত এই ওয়েবসাইট ব্যবহারের জন্য সাইন আপের প্রয়োজন নেই। তবে, আপনি চাইলে সাইন আপ ও লগইন করেও নিতে পারেন। অতঃপর, দেখতে পাবেন ইন্টারফেস। খুঁজে নিবেন এডভান্স সার্চ অপশন। ক্লিক করবেন এর উপর। আসবে নতুন ইন্টারফেস। বিভিন্ন টার্ম, জার্নালের নাম, ইয়ার কিংবা অথর স্পেসিফাইড ওয়ার্ড ইনপুট করে মুহুর্তেই খুঁজে নিতে পারবেন রিসেন্ট এবং মোস্ট সাইটেড ফিল্ড রিলেটেড আর্টিকেলসমূহ। এসব সার্চ অধিকতর কার্যকর করতে কী-ওয়ার্ডসমূহকে রাখতে পারেন কোটেশনের ভেতর, ব্যবহার করতে পারেন বুলিয়ান অপারেটর।
জেডলাইব্রেরি
লিটারেচার সংগ্রহের পাশাপাশি একজন গবেষকের প্রয়োজন পড়ে ফিল্ড রিলেটেড রেফারেন্স বই পড়া এবং তা সংগ্রহে রাখা। কেননা, গবেষণার ক্ষেত্র সম্পর্কে জানার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। তৈরি হয় অজানার শূন্যতা পূরণের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু, দেশি বইয়ের পাশাপাশি বিদেশি বইগুলোর চড়ামূল্যে সে আগ্রহে ভাটা পড়ে অনেকেরই। তবে, তাদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রিতে ১২ কোটি বই ও ৮৪ কোটি জার্নাল আর্টিকেলের সুবিশাল ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হয়েছে জেড লাইব্রেরি।
বছর দুয়েক পূর্বে অজানা কারণে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক বন্ধ রাখা হয় লাইব্রেরির মূল ওয়েবসাইটটি। তবে, সম্প্রতি নতুন মোড়কে পুনরায় ফিরে এসেছে এটি। এখান থেকে আপনি ফ্রিতে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন দেশি-বিদেশি চড়ামূল্যের দুর্লভ সব বই। হাতের নাগালে পাবেন হাজারো গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল।
সংগ্রামের নোটবুক
মনে করুন আপনি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করতে চান। তাহলে, এসবের জন্যও সংগ্রহ এবং রিভিউ করতে হবে সেকেন্ডারি জার্নাল আর্টিকেল। খুঁজে বের করতে হবে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের পুরনো সব দলিল দস্তাবেজ। প্রয়োজন হবে সেসময়কার পত্র-পত্রিকাও। আর তাই, সংগ্রহের এই অসম্ভব কাজকে সহজিকরণে আপনাকে সাহায্য করবে সংগ্রামের নোটবুক। এখানে আপনি ১৯৪০ কিংবা তারও পূর্ব থেকে ২০০৯ পর্যন্ত প্রকাশিত দ্য হিন্দু, অমৃত বাজার, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক যুগান্তরসহ আরও নানাবিধ পত্রিকা পাবেন ছবি ও পিডিএফ আকারে।
এসব পত্রিকা সংগ্রহের জন্য চলে যাবেন সংগ্রামের নোটবুক ওয়েবসাইটে। উপরে দেখতে পাবেন অনেকগুলো ক্যাটাগরি। পছন্দমতো ক্যাটাগরি সিলেক্ট করবেন। সিলেক্ট করবেন কাঙ্ক্ষিত সালের পত্রিকাটিও। ক্লিক করবেন এর উপর। অতঃপর, খুব সহজেই ডাউনলোড করে নিবেন।
সাইস্পেইস
পর্যাপ্ত লিটারেচার ও জার্নাল আর্টিকেল সংগ্রহের পর শুরু করবেন লিটারেচার রিভিউয়ের কাজ। কেননা, একটি ভালো গবেষণা সম্পাদনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এই লিটারেচার রিভিউ। এর মাধ্যমে একজন গবেষক পূর্বে প্রকাশিত প্রাসঙ্গিক আর্টিকেলসমূহ পড়েন। অতঃপর, খুঁজে বের করেন এদের অমীমাংসিত গবেষণা কাজ। আর তাই, গবেষণার এই ধাপটি মোটেও সহজ নয়। কঠিন এই পেপারগুলো পড়ে বোঝার জন্য ব্যয় করতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা সময়। দিতে হয় ধৈর্যশীলতার পরিচয়।
আচ্ছা, যদি এমন হয় কেউ একজন ধরে ধরে বুঝিয়ে দেবে এসব আর্টিকেলের খুঁটিনাটি বিষয়। তুলে ধরবে অসমাধিত গবেষণা কাজ। তাহলে কেমন হবে বলুন তো? দারুণ, তাই না? পেপার পড়ে বোঝার, সারাংশ বের করার কিংবা লিটারেচার রিভিউয়ের কঠিন কাজটি সহজ করতে আপনাকে সাহায্য করবে এআই টুল সাইস্পেইস।
টুলটি ব্যবহারের জন্য প্রথমবার সাইন আপ করে নিবেন। অতঃপর, লগ-ইন। লগইনের পর সামনে আসবে ছিমছাম এক ইন্টারফেস। উপরে ডানপাশে দেখতে পাবেন মাই লাইব্রেরি নামক অপশন। ক্লিক করবেন সেখানে। আপনার কম্পিউটারে এক্সটেনশন হিসেবে থাকা রেফারেন্সিং সফটওয়্যার জুটেরো কিংবা কম্পিউটারের নিজস্ব ড্রাইভ থেকে আপলোড করবেন পেপারটি। ক্লিক করবেন এর উপর। ডাউনলোড হবে। দেখতে পাবেন পেপারটি।
পেপারের ডানপাশে আরও দেখতে পাবেন একটি চ্যাটবক্স। পেপারটি সম্পর্কে কী জানতে চাচ্ছেন লিখবেন সেখানে। মূহুর্তেই সে আপনাকে চমকপ্রদ ভাষায় জানিয়ে দেবে সেই বিষয়ে। উপরে পাবেন কতগুলো জানতে চাওয়ার সাজেশনও। এসবের যেকোনোটির উপর ক্লিক করা মাত্রই দেখতে পাবেন তা। যেমন ধরুন- আপনি দু’লাইনে পেপারটির অ্যাবস্ট্রাকট জানতে চান। তাহলে লিখুন বা সাজেশন থেকে ক্লিক করুন। অতঃপর, দেখুন মজা। এরকম আরও দুটি টুল হলো হুমাটা ও এক্সপ্লেইন পেপার।
এলিসিট
লিটারেচার রিভিউয়ের সময় কিংবা পরবর্তীতে একজন গবেষকের মাথায় ঘুরপাক খায় হাজারো প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঘাটতে হয় অসংখ্য ওয়েবসাইট। দ্বারস্থ হতে হয় প্রফেসর ও সুপারভাইজরের। তবে, ব্যস্ত শিডিউলে কখনও কখনও সুপারভাইজরের দেখা পাওয়াই হয়ে যায় অমাবস্যার চাঁদ। আর তাই, কখনো উত্তর পাওয়া যায় তো কখনো যায় না। তখন উপায়? উপায় হলো গবেষণা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেবে এমন এআই টুলস ও ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া। এই যেমন- আপনার হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে এআই রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট টু্ল এলিসিট। ১৭৫ মিলিয়ন আর্টিকেল থেকে গুরুত্বের সাথে টুলটি খুঁজে বের করবে আপনার উত্তর।
টুলটি ব্যবহারের জন্য ইমেইল, নাম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সাইন আপ করে নিবেন। আসবে ইন্টারফেস। দেখতে পাবেন প্রশ্ন করার একটি বক্স। বক্সে প্রশ্ন লিখে সার্চ করার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাবে নতুন এক ইন্টারফেসে। দেখতে পাবেন অনেকগুলো নতুন বিষয়। সর্ববামে দেখতে পাবেন আপনার উত্তর সম্বলিত চারটি টপ সাইটেড পেপারের সারাংশ। মাঝখানে পেপারগুলোর টাইটেল ও সর্বডানে অ্যাবস্ট্রাকট সামারি। উপরে ডানপাশে থাকা ফিল্টার, সর্ট বাই এবং এক্সপোর্ট এজ থেকে উপযুক্ত কী-ওয়ার্ড, ইয়ার, স্টাডি টাইপ, সাইটেশন ইত্যাদি কাস্টমাইজ করে নিতে পারবেন পছন্দ অনুসারে। এমনকি আপনার সংগ্রহে থাকা নির্দিষ্ট পেপারও এখানে সাবমিট করে জেনে নিতে পারবেন সুনির্দিষ্ট বিষয়। একই ধরনের লিটারেচারও খুঁজে পাবেন এখানে।
লিটারেচার রিভিউ কিংবা গবেষণার পূর্ণ-পরিচালনা, উভয় ক্ষেত্রেই মোহনীয় এসব এআই টুল ও সফটওয়্যার রাখবে মাহাত্ম্যপূর্ণ কার্যক্ষমতা। মজার বিষয় হলো, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও এসব সরঞ্জাম তৈরির পেছনের অবদানও হবে এই গবেষণার। ফলশ্রুতিতে, আরো সহজ-সরল, সুন্দর ও উপভোগ্য হবে গবেষণা কাজ।