করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক লকডাউনে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসে সেটা খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। আগামীতেও এর প্রভাব খুব সামান্যই পড়বে বলে বিজ্ঞানীদের করা নতুন এক সমীক্ষায় তথ্য মিলেছে।
গত মে মাসে বিজ্ঞানী সাময়িকী ‘নেচার’-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। লকডাউনের কারণে প্রায় ১৭ শতাংশ হারে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল প্রতিবেদনটিতে৷ গত বছর একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭ মিলিয়ন টন কম কার্বন নিঃসরণ হয়েছে লকডাউন কার্যকর থাকার দিনগুলোয়।
তবে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট প্রকাশিত নেচারেরই আরেক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এবং বায়ু দূষণের ভয়াবহতা আগের চেয়ে অনেক কমলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এসবের খুব একটা প্রভাব পড়েনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা বাড়ার যে প্রবণতা ছিল, সেটির মাত্র ০.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হেরফের হতে পারে। এটিও যে একেবারেই প্রভাব রাখবে না, তা নয়, তবে বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার চেয়ে সেটি অনেকাংশেই হতাশাজনক৷
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে সরকার ও রাষ্ট্রগুলো যদি ব্যাপক হারে সবুজায়ন করতে পারে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনায় সচেষ্ট হয়, তবে এ শতকের মাঝে তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৃদ্ধিতে আটকে রাখা অসম্ভব নয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন লাগামছাড়া হওয়ার আগেই এর রাশ টেনে ধরতে বিজ্ঞানীরা তাই সরকারগুলোর সদিচ্ছা এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টার দিকে তাকিয়ে আছেন।
কীভাবে করা হলো গবেষণাটি?
তিন দেশের বিজ্ঞানীদের করা যৌথ এই গবেষণাটি মূলত গুগল এবং অ্যাপল ম্যাপ থেকে পাওয়া গতিশীলতার তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এটি ভ্রমণ এবং কাজের নিদর্শনগুলো সম্পর্কে সময়ের সাথে বাস্তবিক তথ্য দেয়। তাই নির্গমন সম্পর্কিত ধারণা পাওয়াটা এক্ষেত্রে সহজ। গবেষণায় পরিবহন, অফিস এবং কারখানার কাজের ধরনে পরিবর্তন এবং ১০টি বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বায়ু দূষণকারী পদার্থের নির্গমন বিশ্লেষণ করা হয়। উপাত্ত বিশ্লেষণে ১২৩টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; এরাই মূলত একসাথে প্রায় ৯৯ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানী নিঃসরণের জন্য দায়ী। গবেষকরা দেখেছেন যে, ২০২০ সালের এপ্রিলে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ২৫ শতাংশের বেশি এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
এ হ্রাসের হার এটাই দেখায় যে, মানুষের আচরণের দ্রুত পরিবর্তনগুলো স্বল্প মেয়াদে নির্গমনকে বড় পার্থক্য করে দিতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন, এ জাতীয় লকডাউন বজায় রাখা অসম্ভব। এতে করে দেশ ও অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিজ্ঞানীরা তাই শূন্য-নির্গমনে জোর দিতে চাচ্ছেন।
কেন কমল না উষ্ণায়ন?
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিশ্ব জুড়ে কার্বন ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসহ অন্য নিঃসরণগুলোর পরিমাণ ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে এপ্রিলেই হ্রাসের হার সবচেয়ে কম ছিল। কিন্তু এ নিঃসরণ হ্রাস একযোগে ঘটায় তা তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমানোয় তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ হিসেবে গবেষকরা বলছেন, কোনো একটি গ্যাসের পরিমাণ কমায় যদি উষ্ণায়ন কমে, তবে উষ্ণায়ন কমাতে সহায়ক অন্য একটি গ্যাসের উপাদানের পরিমাণ কমলে উষ্ণায়ন বেড়ে যায়। করোনার সময়ে দেখা যাচ্ছে, এ দুই ধরনের উপাদনের নিঃসরণই কমছে। এতে করে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কিছুটা কমে আসলেও উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রভাবকে বাতিল করে দিচ্ছে। আর এ কারণেই সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বড়সড় অবনমন হওয়ার তেমন সম্ভাবনা দেখছেন না বিজ্ঞানীরা।
উদাহরণ হিসেবে গবেষকরা বলেন, যানবাহন থেকে নির্গত নাইট্রোজেন অক্সাইড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আবার কয়লা পোড়ালে সেখান থেকে সালফার ডাই–অক্সাইড নির্গত হয়। এই সালফার ডাই–অক্সাইড আবার বায়ুমণ্ডলে একটি আবরণ তৈরিতে সহায়তা করে, যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে মহাশূন্যে ফেরত পাঠায় এবং পৃথিবীকে শীতল রাখতে সহায়তা করে। ফলে একধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। এখন লকডাউনের মধ্যে এই দুই–ই কমে যাওয়ায় নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে বাড়তি উষ্ণায়ন না হলেও সালফার ডাই–অক্সাইডের ইতিবাচক প্রভাবটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাপমাত্রাও আর কমছে না কমছে না।
কী বলছেন গবেষকেরা?
১৪ জনের গবেষণা দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়ার্স ফরস্টার। গবেষক দলটিতে ফরস্টারের মেয়ে যুক্তরাজ্যের কুইন মারগারেট স্কুলের এ লেভেল পরীক্ষার্থী হ্যারিট ফরস্টারও ছিলেন। গবেষক দলের অন্য ১২ জনের মধ্যে যুক্তরাজ্যের নয়জন, জার্মানির দু’জন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী ছিলেন।
ফরস্টার বলেন,
এই সময়ের অভিজ্ঞতা ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে সবুজ অর্থনীতির দিকে পরিচালিত করতে পারি। পরিবেশবান্ধব শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারি। আর এটি আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জলবায়ুর ওপর অনেক বড় প্রভাব রাখবে।
তার মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি এড়ানো সম্ভব, যদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, সবুজ উদ্দীপনা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি বিনিয়োগ হ্রাসে সচেষ্ট হওয়া যায়। সংকটের সময়ই মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে শেখে, এই বিজ্ঞানী তাই সংকট মোকাবেলায় এই সময়টাকেই সবচেয়ে ভালো সময় মানছেন।