মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ দাবি করি। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে সবকিছুই যেন আমাদের হাতের মুঠোয়। যেকোনো সমস্যা সমাধানের বুদ্ধিমত্তাই প্রমাণ করে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু এত কিছুর পরও কিছু দিক দিয়ে আমরা যেন খুবই অসহায়। পৃথিবী আর মানবসভ্যতার বয়স দিনকে দিন যত বাড়ছে, আমরা ততই কিছু অমীমাংসিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলছি, যার সমাধান বের করতে গিয়ে প্রায়শই আমাদেরকে অনেক জটিলতার বাঁধা পেরোতে হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় নেতৃবৃন্দ আজ নিজেদের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে সবাই একসাথে হাত মেলাচ্ছেন। আর সেই প্রধান সমস্যা, যা কি না আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা হলো “জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা”।
জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে দন্ডায়মান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়- এসব যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। আজকের লেখায় প্লাস্টিক পদার্থ কী করে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনে বিকট প্রভাব ফেলছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা হবে।
গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিকের প্রভাব
এ জিনিসটি বোঝার আগে আমাদের সর্বপ্রথম বুঝতে হবে প্লাস্টিক পদার্থগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়। সাধারণত প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থগুলো তৈরি করা হয় জীবাশ্ম জ্বালানী, যেমন- তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাসকে ব্যবহার করে। আমরা যখন তেল বা খনিজ পদার্থ ভূ-ত্বক হতে নিষ্কাশন করি, তখন বিপুল পরিমাণ দূষিত পদার্থের নির্গমন ঘটে। এসব পদার্থের ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, ওজোন, বেনজিন এবং মিথেন। এসব পদার্থ গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী।
আমরা সবাই জানি, গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যে কারণে হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচে অবস্থানরত দেশগুলোর প্রায় অনেক অঞ্চলই সমুদ্রের তলদেশে চলে যাবে। প্লাস্টিক পদার্থ কীভাবে এখানে ভূমিকা রাখবে তা একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। আমরা যে প্লাস্টিক বোতলগুলো ব্যবহার করে থাকি সেগুলোর মূল উপাদান পলিইথিলিন। একটি গবেষণায় দেখা যায়, এক আউন্স পরিমাণ পলিইথিলিন প্রস্তুত করলেই প্রায় ৫ আউন্স পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এর মানে দাঁড়ায়- আমরা যতটুকু প্লাস্টিকদ্রব্য তৈরি করছি তার থেকে বেশি পরিমাণ দূষিত পদার্থ বায়ুতে নির্গমন করছি। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিকের চাহিদা ব্যাপক। তাহলে ভাবুন তো, শিল্পায়নের নামে কী পরিমাণ পরিবেশ দূষণ চলছে উন্নত দেশগুলোতে?
সামুদ্রিক জীবনে প্লাস্টিকের প্রভাব
২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল The seattles Time (দ্যা সিটলস টাইম) নামক দৈনিকে একটি খবর খুব সাড়া দেয়। সীটল সমুদ্র সৈকতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি বিশাল তিমিকে। পরে যখন সেই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন দেখা যায় তিমির পাকস্থলীতে পাওয়া গিয়েছে বহু প্লাস্টিক পদার্থ। সেসব প্লাস্টিককেই সেই তিমির মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এসব জলজ প্রাণীর মৃত্যু কিন্তু মোটেও নতুন কিছু নয়। প্রায়শই আমরা সংবাদপত্রে দেখতে পাই এরকম সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর খবর। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে একটি ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরা হয়, যেখানে বলা হয়- প্রতি বছর প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রযানের বর্জ্য পদার্থ দিয়ে আক্রান্ত হয়, আর এসবের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য, যা নিতান্তই আমাদের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রায় অর্ধেক সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতিবছর প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করছে, যে কারণে এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকদ্রব্য তাদের প্রজননেও বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই সামুদ্রিক কচ্ছপগুলোর অস্তিত্বই হুমকিই ভেতরে পড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিদের উপর প্লাস্টিকের প্রভাব
বাংলাদেশে একটি বিশেষ মৌসুমে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি অনেক দূর দূরান্ত থেকে আসে। এসব পাখি আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সরকার সেসব মৌসুমে পাখি শিকার নিষিদ্ধ করেছে শুধু তাদের অবাধ প্রজননের জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এতকিছুর পরেও দিনকে দিন এসব অভিবাসী পাখির সংখ্যা মারাত্মক হারে কমে যাচ্ছে। এ বছর ৯-১০ মে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে তুলে ধরা হয় এ চিত্রের ভয়াবহতা।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে। এখনই এসব পরিযায়ী পাখির প্রায় ৯০% এর পাকস্থলীতেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৯% এ, যা এসব পাখির অস্তিত্বের পথে বিরাট বড় এক বাঁধা। এ পাখিরা বাঁচার জন্য সামুদ্রিক প্রাণীদের খেয়ে থাকে। যেহেতু সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ অত্যধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে, তাই সেসব সামুদ্রিক প্রাণী গ্রহণের সাথে সাথে সেসব পাখির পাকস্থলীতেও চলে যাচ্ছে প্লাস্টিক পদার্থগুলো।
প্লাস্টিক এবং পরিবেশ বিপর্যয়
প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য পরিবেশের জন্য কী পরিমাণ হুমকিস্বরুপ তা সহজেই অনুমেয়। প্লাস্টিক পদার্থের বিয়োজন খুবই কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। কিছু প্লাস্টিক পদার্থের বিয়োজিত হতে প্রায় হাজার বছরও লেগে যায়। যে জিনিসের বিয়োজিত হতে যত সময় লাগে সে জিনিসটি পরিবেশের জন্য তত বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের দেশে আমরা এর প্রভাব খুব ভালভাবেই বুঝতে পারি প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর। বিভিন্ন ডোবা, নালা, খাল-বিল, ড্রেনে গিয়ে প্লাস্টিক পদার্থগুলো জমা হয়। যেহেতু এসব পদার্থ সহজে বিয়োজিত হয় না, তাই বৃষ্টির পর এসব পদার্থ পয়ঃনিষ্কাশনে প্রভাব ফেলে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে, সেই সাথে বাড়ে রোগের প্রাদুর্ভাব। ডায়রিয়া, কলেরাসহ অনেক রোগে আক্রান্ত হয় শহরবাসী। জীবনযাপন হয়ে ওঠে আরো কষ্টসাধ্য। চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, এসবের জন্য দায়ী কে বা কারা?
বাংলাদেশের নদী দূষণে প্লাস্টিকের ভূমিকা
আমরা সকলেই জানি, আমরা একটি নদীমাতৃক দেশে বাস করি। অসংখ্য নদীতে ভরপুর আমাদের এই দেশ। যেহেতু আমাদের দেশ প্রধানত কৃষিনির্ভর, তাই ধান আর ফসলের ফলনে আমাদের নদীর পানি খুবই দরকার। এমনটা না হলে আমরা তীব্র খাদ্য সংকটের ভেতর দিয়ে যাব। কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাই আমাদের নদীগুলোর নাজেহাল অবস্থা। এককালে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী ছিল আমাদের গর্ব। কিন্তু এখন আমরা সেই নদীর কাছেই যেতে পারি না। এসব নদী দূষণে একটি মূল ভূমিকা পালন করে প্লাস্টিক দ্রব্য। যেহেতু প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য সহজে বিযোজিত হয় না, তাই এগুলো নদীর নিচে গিয়ে জায়গা ধারণ করে, ফলে নদীর পানির উচ্চতা হ্রাস পায়। অনেক সময়ই আমরা খবরের কাগজে দেখতে পাই যে, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার দরুন নদীতে জাহাজ আর লঞ্চের চলাচল আপাতত স্থগিত। আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা এভাবেই প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যগুলো কমিয়ে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা আমাদের নদীগুলোকে হারিয়ে ফেলছি, অর্থনৈতিকভাবে হচ্ছি বিপর্যস্ত। তাই এখনই আমাদের এসব ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এতকিছুর পর আমাদের একটি ব্যাপার নিয়ে ভাবা উচিত। আমরা এখন বিরাট বড় জলবায়ু সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যার ফলে আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। পরিবেশগত,অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উপর বিরাট এক ভূমিকা রেখে চলছে। এখনই যদি আমরা এসব নিয়ে ভাবতে না শিখি তাহলে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে যাবে। তাহলে আমরা কী করতে পারি?
১) আমাদের উচিত প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ বর্জন করা।
২) আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সীমিত করা।
৩) পাটজাত দ্রব্যের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশের হারানো ঐতিহ্য পাটশিল্পকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা। সব জায়গায় প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
৪) জনগণকে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা।
৫) পাটজাতীয় পদার্থ ব্যবহারের কারণে সরকারীভাবে ভোক্তা এবং উদ্যোক্তাদের পুরষ্কৃত করে তাদেরকে এসবের ব্যবহারে আরো উৎসাহিত করা।
৬) যেখানে সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার কারণে পর্যাপ্ত শাস্তি এবং জরিমানার ব্যবস্থা করা।
৭) প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের উপর অত্যাধিক শুল্কারোপ করে পাটজাত পদার্থের মূল্য কমিয়ে পাটজাত পণ্যকে আরো সহজলভ্য করে তোলা।