সমগ্র পৃথিবীব্যাপী মহামারির এই সময়ে করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই। অনেকেই আতঙ্কের সাথে বলতে চাইছেন, মিউটেশন ঘটছে COVID-19 এর জন্য দায়ী SARS-CoV-2 করোনাভাইরাসের। সম্প্রতি ন্যাশনাল সায়েন্স রিভিউ এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে একদল বিজ্ঞানী দাবি করছেন, মিউটেশনের ফলে উদ্ভূত হয়েছে SARS-CoV-2 এর দুটি পৃথক স্ট্রেইন, যাদের নামকরণ করা হয়েছে ‘S-স্ট্রেইন’ এবং ‘L-স্ট্রেইন’ হিসেবে। করোনাভাইরাসের ১০৩ জিনোম নিয়ে এই গবেষণাটি চালানো হয়, যেখানে দেখা যায় ৭০% করোনাভাইরাস বহন করছে L-স্ট্রেইন এবং ৩০% করোনাভাইরাস বহন করছে S-স্ট্রেইন।
প্রথম যখন ভাইরাসটি কোনো প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় তখনকার ভাইরাসগুলোতে খুঁজে পাওয়া গেছে S-স্ট্রেইন, অর্থাৎ এটি এই ভাইরাসের আদি-স্ট্রেইন। পরবর্তীতে মিউটেশনের মাধ্যমে উদ্ভব ঘটেছে L-স্ট্রেইনের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, L-স্ট্রেইনটি তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী এবং এর সংক্রমণ প্রক্রিয়াও বেশ দ্রুত।
তাহলে এই মিউটেশন কি নতুন কোনো শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে? উত্তর হলো, না। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয় ‘মিউটেশন’ মানেই বুঝি খুব ক্ষতিকর কোনো কিছু। কিন্তু বাস্তবে যেকোনো সিঙ্গেল-স্ট্র্যান্ড RNA ভাইরাসের ক্ষেত্রেই মিউটেশন একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং নতুন এই করোনাভাইরাসও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী এই মিউটেশন? সহজ ভাষায় বলতে গেলে, DNA বা RNA-র জিনোমে নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্সে কোনো ধরনের পরিবর্তন এলেই তাকে মিউটেশন বলা হয়। যেকোনো ভাইরাস-দেহের গঠন লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এর ক্যাপসিড বা বহিরাবরণের ভেতরে থাকে DNA বা RNA। ভাইরাস এই DNA বা RNA কে অন্য কোনো হোস্ট বা বাহকের দেহে প্রবেশ করায় এবং সেখানে রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমে এরা বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। রেপ্লিকেশনের সময় যদি নিউক্লিওটাইড বেইজ পেয়ারের কোনো অংশ মুছে যায় বা নতুন করে কোনো অংশের সংযোজন হয় কিংবা কোনো অংশ পুনঃসজ্জিত হয়, তাহলেই আমরা একে মিউটেশন বলে থাকি।
বলা হয়ে থাকে, RNA-ভাইরাসের রেপ্লিকেশন ঘটে অনেক কম সময়ে এবং এদের মিউটেশনের হার অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এর কারণ হলো, রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরির সময় ভাইরাসগুলো ‘প্রুফ-রিড’ করে না। অর্থাৎ প্রতিলিপি তৈরি বা পুরাতন RNA-স্ট্র্যান্ড থেকে নতুন স্ট্র্যান্ড তৈরির সময় কোনো ভুল হচ্ছে কি না, তা এই ভাইরাস খতিয়ে দেখে না। ফলে দেখা যায়, পরিবর্তিত এই নতুন স্ট্র্যান্ড থেকেই তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন স্ট্র্যান্ড এবং সেখানেও আবার ঘটতে পারে নতুন কোনো মিউটেশন।
মিউটেশন মারাত্মক কোনো ভুল নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভুল ভাইরাসের বেঁচে-থাকা কিংবা কার্যকারিতায় তেমন কোনো ভূমিকা পালন করে না বললেই চলে। তবে RNA-র যেসব জিনোম সরাসরি ভাইরাসের সংক্রমণ-ক্ষমতা এবং রোগের তীব্রতা প্রকাশের জন্য দায়ী, সেসব অংশে মিউটেশন ঘটলে দুই ধরনের ফলাফল হতে পারে। মিউটেশন যদি ভাইরাসের নিজের জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে প্রাকৃতিক-নির্বাচন তত্ত্বের মতো এরা নিজেরাই নিজেদের বিস্তার রোধ করে। আর মিউটেশন যদি এমন হয় যা এদের সংক্রমণ ক্ষমতাকে ত্বরান্বিত করে, তাহলে অবশ্যই তা ভয়ংকর। আবার অনেক সময় হোস্ট বা বাহকের দেহে অভিযোজিত হবার জন্য এরা নিজেরাই নিজেদের জিনে মিউটেশন ঘটায়, যেমনটি করেছে SARS মহামারির জন্য দায়ী SARS-CoV ভাইরাসটি। একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, এই ভাইরাসটি মানুষের দেহে সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে নিজের জিনোমের ২৯ নিউক্লিওটাইড বেইজ পেয়ারের ছোট্ট একটি অংশ মুছে দিয়েছিল।
সে যা-ই হোক। এখনকার এই নতুন করোনাভাইরাসটির সেই মিউটেশন তত্ত্ব নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অনেক গবেষক সেই গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ প্রস্তাবিত সেই S এবং L স্ট্রেইনের ৯৯.৯৯৩% ই অভিন্ন।
ভাইরাসবিদ এন্ড্রু র্যাম্বাউট এর মতে, “তারা মূলত মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট দুটি ভিন্ন শাখা দেখেছেন এবং তুলনামূলক বড় শাখাটিকে বলতে চাইছেন বেশি শক্তিশালী।” ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগো এর চারজন বিজ্ঞানী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, “গবেষণাপত্রটিতে যা দাবী করা হচ্ছে তা একেবারেই পরিষ্কার নয়, মহামারির এই সংকটময় মুহূর্তে এ ধরনের ভুল তথ্য প্রমাণ করা বরং ঝুঁকিপূর্ণ।” এছাড়াও সংক্রমণের পর এত কম সময়ের মধ্যে কোনো ভাইরাসকে মিউটেশনের মাধ্যমে শক্তিশালী কোনো পরিবর্তন আনতে সাধারণত দেখা যায়নি।
তবে মজার ব্যাপার হলো, ছোটখাট যে মিউটেশনগুলো হচ্ছে তা থেকে ভাইরাসটি সংক্রমণের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যেই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম GISAID-এ এই ভাইরাসটির ৩৫০টিরও বেশি জিনোম সিকোয়েন্স শেয়ার করা হয়েছে।
ছোট্ট একটি উদাহরণের মাধ্যমে বলা যাক। বার্লিনের এক ভাইরাসবিদ ইতালিতে আক্রান্ত এক জার্মান রোগীর দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এর জিনোম সিকোয়েন্স বের করলেন। দেখা গেল, সেই নমুনা এক মাসে আগে জার্মানির মিউনিখে সংগৃহীত এক নমুনার সাথে পুরোপুরি মিলে গেল। দুটি নমুনাই একই ধরনের মিউটেশন বহন করছে, যা চীনে সংক্রমিত ভাইরাস নমুনায় অনুপস্থিত। ক্রিস্টিয়ান ড্রস্টেন বলেন,
এখান থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, ইতালিতে ছড়িয়ে পড়া মহামারির বীজ হয়তো সুপ্ত ছিল জার্মানিতেই, অথবা হতে পারে একই ধরনের মিউটেশন ঘটিয়ে ভাইরাসটি দুটি ভিন্ন পথে একই সাথে দুই দেশে প্রবেশ করেছে।
আবার বলা হয়, এখনকার করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2 এর সাথে ২০০২-২০০৩ সালের SARS মহামারির জন্য দায়ী SARS-classic বা SARS-CoV এর জিনগত গঠন প্রায় ৭৯.৬% মিলে যায়। তবে নতুন এই করোনাভাইরাস কেন এত শক্তিশালী তার ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে এর গঠনগত দিক থকে।
গঠন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, SARS-classic এবং SARS-CoV-2 দুটি ভাইরাসের বহিরাবরণেই রয়েছে স্পাইক বা সূচালো অগ্রভাগের মতো অংশ। কিন্তু SARS-CoV-2 এর ক্ষেত্রে প্রতিটি স্পাইকের মাথা আবার দুটি-সংযুক্ত অর্ধাংশে বিভক্ত।
মানুষের দেহ কোষের উপরিভাগে থাকে ACE2 নামক একধরনের প্রোটিন, যার সাথে যুক্ত হয় এই স্পাইকগুলো। এটি দেহকোষে ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ধাপ।
SARS-classic এর তুলনায় SARS-CoV-2 এর স্পাইকের রেখা বিন্যাস বা ভাঁজগুলো আরও বেশি সুনির্দিষ্ট, যা একে ACE2 এর সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হতে সাহায্য করে। সংযুক্তি যত দৃঢ়, সংক্রমণ তত গভীর।
দ্বিতীয় ধাপে, ফিউরিন নামক একটি এনজাইমের সংস্পর্শে এলে স্পাইকের সংযুক্ত অর্ধাংশ দুটি পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং স্পাইকগুলো দেহকোষের ভেতরে প্রবেশের জন্য সক্রিয় হয়। এই ফিউরিন কিন্তু আমাদের দেহকোষ স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হতে থাকে। অপরদিকে SARS-classic এর ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি কিছুটা জটিল। ফলে কোষের ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রেও SARS-classic এর তুলনায় SARS-CoV-2 বেশি সুবিধা পায়।
SARS-CoV-2 ঊর্ধ্ব-শ্বাসযন্ত্রের ACE2 বহনকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে নিম্ন-শ্বাসযন্ত্র এবং ফুসফুসের দিকে। মৃত কোষগুলো জমা হতে থাকে শ্বাসনালী আর ফুসফুসে।
শুধুমাত্র শ্বাসযন্ত্র নয়, অন্ত্র এবং বেশ কিছু রক্তনালীতেও রয়েছে ACE2 বহনকারী কোষ। অনেক গবেষকের মতে, সেসব স্থানেও অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারে SARS-CoV-2।
আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিন্তু চুপ করে বসে থাকে না, পাঠায় তার সৈন্য-সামন্ত। ম্যাক্রোফেজ সক্রিয় করে ‘টি-সেল’কে, শুরু হয় অচেনা আগন্তুককে ধ্বংসের জন্য সাইটোকাইন উৎপাদন। কোষের ভেতরে চলতে থাকা এই যুদ্ধ-বিগ্রহকেই আমরা বাহ্যিকভাবে দেখতে পাই জ্বর, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা কিংবা অন্য কোনো প্রাথমিক উপসর্গের মাধ্যমে।
কখনো জয়ী হয় আমাদের ইমিউন সিস্টেম, আমরা সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু অপরিচিত এই ভাইরাসের সাথে ইমিউন সিস্টেম যখন একেবারেই পেরে ওঠে না, তখন দিনে দিনে আগ্রাসী রূপ ধারণ করতে থাকে সে, রোগতত্ত্বের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সাইটোকাইনের ঝড়’। নির্দিষ্ট টার্গেটের বদলে শুরু হয় এলোপাথাড়ি আক্রমণ। আক্রান্ত স্থানে সৈন্য পাঠানোর জন্য একের পর এক খুলে দিতে থাকে রক্তনালীর মুখগুলো, আর তাতে হিতে বিপরীত হয়। ফুসফুস ভরে উঠতে থাকে তরলে, বুক ভরে শ্বাস নেওয়াই তখন অসাধ্য হয়ে পড়ে।
আর রোগী যদি আগে থেকেই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস কিংবা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত থাকেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সাইটোকাইনের এই ঝড়ের কবলে পড়ে আক্রান্ত হতে থাকে অন্য কোনো অঙ্গ, সংক্রমণ ঘটতে থাকে আরও নতুন ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার। আর একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে আমরা হয়তো মৃত্যুর কাছে হার মানি।
সবশেষে বলা যায়, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের আর কিছুই করার নেই। আসুন, যে যেভাবে পারি সচেতন করি অন্য সবাইকে, অবস্থান করি নিরাপদে। মনে রাখবেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো ছোট্ট একটি পদক্ষেপে হয়তো বেঁচে যাবে হাজারো প্রাণ।