মাত্র ছ’মাস আগেও মিসেস রহমানের জীবনটা একদম অন্যরকম ছিল। সেই জীবনটা হয়তো শতভাগ নিখুঁত ছিল না। নিত্যকার ঝুট-ঝামেলা, মান-অভিমান লেগেই থাকত। কিন্তু তবু তার মনে শান্তি ঠিকই বিরাজ করত। সারাদিনের সব দুঃখ-কষ্ট পাশে সরিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত মনেই ঘুমাতে পারতেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ছারখার হয়ে গেল তার জীবন। অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি, আর তারপর ডাক্তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিল, বেশিদিন আর সময় নেই হাতে। পুরোপুরি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো মিসেস রহমানের। বারবার শরীরে চিমটি কেটে দেখছেন না ঠিকই, তবু মনের মধ্যে বারবার একটা ক্ষীণ আশার রেখা দেখা দিচ্ছে- হয়তো ঘুমের মাঝে খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন তিনি, ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার এমনটাও মনে হচ্ছে যে, কোথাও হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। ডাক্তার অন্য কারও রিপোর্টের সাথে তার রিপোর্ট গুলিয়ে ফেলেছে। আরও ভালো কোনো ডাক্তারকে দেখালে সঠিক ফলাফল জানা যাবে।
কিন্তু এই সবকিছু করেও যখন ফলাফল অপরিবর্তিত থাকল, তখন মনের মধ্যে প্রচন্ড ক্রোধ জেঁকে বসলো তার। তিনি ভাবতে লাগলেন, আমার সাথেই কেন সবসময় এমন হয়? সৃষ্টিকর্তা আমাকেই কেন সবসময় এমন কঠিন শাস্তি দেন? সেই যে চার বছর বয়সে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে থুতনি কেটে ফেলেছিলেন, কিংবা এসএসসি পরীক্ষার সময় জ্বরে পড়ে কয়েকটা পরীক্ষা ভীষণ রকমের বাজে হয়েছিল, বিয়ের দিন পার্লার থেকে সেজে আসার পরও তাকে আপন ছোটবোনের চেয়ে কম সুন্দরী লাগছিল, অতীতের এমন সব স্মৃতি ‘দুঃসহ’ হয়ে তার মানসপটে উঁকি দিয়ে যেতে থাকল। আর তিনি নিজের ভাগ্যকে দুষতে লাগলেন। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষদের একজন বলে মনে হতে লাগল তার।
তবে বেশিদিন আর ভাগ্যকে দোষারোপ করে থাকতে পারলেন না তিনি। অনেকেই তাকে বললো, অমুক পীরের মাজারে গিয়ে মাথা ঠুকলে হয়ত ভাগ্য ফিরতে পারে। আবার কেউ কেউ বললো, বাইরে কোথাও গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আসলে হয়তো কিছুদিন বেশি বাঁচতে পারবেন। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায়, মিসেস রহমানের দশা এখন অনেকটাই তেমন। যে তিনি কোনোদিন কোনো মাজারমুখো হননি, সেই তিনিই এবার বিভিন্ন মাজারে গিয়ে ধরনা দিতে লাগলেন। দেশের বাইরে গিয়ে আরও উন্নতমানের ডাক্তারদেরও দেখিয়ে এলেন। কিন্তু তবুও অবস্থার কোনো উন্নতিই হলো না। সব জায়গার ডাক্তারদের মুখেই কেবল একটি কথা, “আমরা খুবই দুঃখিত”।
অন্যদের মুখে দুঃখের কথা শুনতে শুনতে, একপর্যায়ে নিজের দুঃখের কথা ভুলে গেলেন মিসেস রহমান। দুঃখবোধকে গ্রাস করল অপার শূন্যতা। কোনো কিছুতেই যেন আর কিছু আসে যায় না তার। কেমন একটা উদাসীন ভাব। ক’দিন আগে ছেলের পরীক্ষার ফল বেরোল। ছেলে অংকে ডাব্বা মেরেছে। তবু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না তিনি। ভাবখানা এমন যেন, আমার তাতে কী? আমার তো সব শেষই হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথেই কথাবার্তা কমিয়ে দিলেন। দিনের বেশিরভাগ ঘরের মধ্যেই কাটান। মাঝেমধ্যে ভালো কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু সফল হন না। দুই মিনিট ভালো কিছু চিন্তা করার পরই আবার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হতে থাকে তার। হাল ছেড়ে দেন তিনি। আত্মসমর্পণ করেন। ডুব দেন অবসাদের অতল গহীনে।
এমনভাবে চললো কয়েক সপ্তাহ। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে লাগল মিসেস রহমানের। যেকোনো দিনই হয়তো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে তাকে। তবু এখন আর আগের মতো অতটা অবসাদগ্রস্ত নন তিনি। সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে শুরু করেছেন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন, ছেলে পড়তে না বসলে বকাঝকা করছেন, টিভি সিরিয়ালে বউ-শাশুড়ির লড়াইয়ে বউ তথা নায়িকার পক্ষ নিচ্ছেন, এমনকি সবার আপত্তি সত্ত্বেও রান্নাঘরে গিয়ে টুকটাক রান্নাবাড়াও করছেন। তাকে দেখে সবাই যেন অবাক। মনেই হচ্ছে না, এই মানুষটা মৃত্যুপথযাত্রী। কয়েকজন আশাবাদী আত্মীয় তো এমনও বলতে লাগল, মিসেস রহমানের যে অসাধারণ মনের জোর, এই মনের জোরেই হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু না, প্রকাশ্যে যতই মানসিক দৃঢ়তা দেখান না কেন, মিসেস রহমানের শরীর কিন্তু ক্রমশই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে লাগল। এবং ডাক্তারদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, সত্যি সত্যিই একদিন মারা গেলেন তিনি। তবে মৃত্যুর আগে তার মুখটা হাসি হাসি ছিল বলেই অনেকের অভিমত।
ব্যবচ্ছেদ
এতক্ষণ যে মিসেস রহমানের কথা বললাম, তিনি সম্পূর্ণই কাল্পনিক একজন চরিত্র। তবে তাই বলে এমন মানুষের অস্তিত্ব যে পৃথিবীতে নেই, তা কিন্তু নয়। গণ্ডায় গণ্ডায় আছে। একটু দেখার মতো মন নিয়ে, চোখ মেলে আশেপাশে তাকালেই তাদের খোঁজ পাব আমরা। কিংবা কে জানে, হয়তো আমরা নিজেরাও এমনই!
শোক এমন একটি জিনিস, যা সবার জীবনেই কমবেশি আছে। কারও শোকের মাত্রা কম, কারও বেশি, এটুকুই যা তফাৎ। কেউ হয়তো ফেসবুক স্ট্যাটাসে পর্যাপ্ত লাইক না পেয়ে হতাশায় শোক করে, আবার কেউ মোবাইল হারিয়ে ফেলার দুঃখে শোক করে। কেউ পরীক্ষায় ফেলের লজ্জায় শোক করে, আবার কেউ প্রিয়জনকে হারানোর কষ্টে শোক করে। মূল কথা হলো, দুঃখ-কষ্ট আমাদের সবার জীবনেই কমবেশি আছে, আর সেই দুঃখ-কষ্টের একটি খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো শোক পালন।
সবাই যে একইভাবে শোক করবে, এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি যেমন ভিন্ন, তেমনই ভিন্নতা রয়েছে আমাদের শোক করার ধরনেও। কোনো একজন হয়তো পছন্দের ফুটবল দলের পরাজয়েই কেঁদে বুক ভাসায়, আবার অন্য একজন ডাক্তারের মুখে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা জারি হলেও মুখে হাসি বাঁধিয়ে রাখতে পারে।
শোকের পাঁচটি পর্যায়
শোকের নির্দিষ্ট কিছু পর্যায় থাকবে, এই ধারণাটা অনেকের কাছে অবাস্তব ও হাস্যকর ঠেকতে পারে। তবে সত্যি সত্যিই শোকের পাঁচটি পর্যায় খুঁজে বের করেছেন সুইস-আমেরিকান মনোচিকিৎসক এলিজাবেথ কুবলার রস। সর্বপ্রথম ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত On Death and Dying বইয়ে তিনি The five stages of grief হিসেবে শোকের পাঁচটি পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেন। একে কুবলার রস মডেল হিসেবে অভিহিত করা হয়। মূলত মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের সাথে কথা বলে, তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্থাৎ যখন তারা তাদের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথা জানতে পারলেন, এবং তারপর থেকে কেমন মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছেন, এগুলোর উপর ভিত্তি করে তিনি শোকের পাঁচটি পর্যায় নির্ধারণ করেন। তার মতে, স্বাভাবিকভাবে শোকসন্তপ্ত মানুষ এই পাঁচটি পর্যায় অতিক্রম করে:
- Denial (অস্বীকার)
- Anger (রাগ)
- Bargaining (দর কষাকষি)
- Depression (অবসাদ)
- Acceptance (মেনে নেওয়া)
আদ্যক্ষর অনুসারে এদেরকে অনেকে DABDA নামেও ডাকে।
Denial (অস্বীকার): প্রথমে ব্যক্তি কিছুতেই তার সাথে হওয়া খারাপ ঘটনাটিকে মেনে নিতে পারে না। সে আশা করতে থাকে, কোথাও হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে। শীঘ্রই হয়তো সে ভুলের অবসান ঘটবে।
Anger (রাগ): যখন আর বাস্তবতাকে অস্বীকার করে থাকা যায় না, তখন হতাশা গ্রাস করে ব্যক্তিকে। কিন্তু হতাশার চেয়েও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রাগ। এই রাগ নির্দিষ্ট কারও ওপর নয়, এই রাগ তার ভবিতব্যের উপর। কেন আমার সাথেই এমন হয়, আমি কী দোষ করেছি- এই ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায়।
Bargaining (দর কষাকষি): এই পর্যায়ে অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘হয়তো’র আগমন ঘটে। যদি আমি এটা না করে ওটা করতাম, তাহলে হয়তো আমাকে এমন বিপদে পড়তে হতো না; আমার সাথে যা হয়েছে, তা মেনে নিচ্ছি, কিন্তু কোনোভাবে তো এর প্রভাব প্রশমিত করা যেতে পারে; অমুক কাজটা করলে হয়তো বা আমার অবস্থা কিছুটা হলেও ফিরবে- এমন ভাবতে থাকে শোকগ্রস্ত ব্যক্তিটি।
Depression (অবসাদ): এই পর্যায়ে সব আশা হারিয়ে পুরোপুরি বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় ব্যক্তির মন। এমন অবস্থায় ব্যক্তি অনেক বেশি উদাসীন হয়ে পড়ে, শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়, অনেকটাই নীরব ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সামনে আর কোনো আশার আলো নেই, এই চরম সত্যের যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে।
Acceptance (মেনে নেওয়া): এই পর্যায়ে ব্যক্তি আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে। তার সাথে যা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যা তার জন্য অপেক্ষা করছে, সেসবকে এবার মেনে নিতে আরম্ভ করে। তবে এই মেনে নেয়া মানে যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যক্তির সন্তুষ্ট হওয়া, তা নয় মোটেই। বরং বাস্তবতাকে পরিবর্তন করা সম্ভব না, তাই একেই মেনে নিতে হবে, এমন আত্মোপলব্ধিই ঘটে এই পর্যায়ে।
যেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
প্রাথমিকভাবে কুবলার কেমন মৃত্যুপথযাত্রীদের ক্ষেত্রেই শোকের এই পাঁচটি পর্যায়ের কথা বলেছিলেন। তবে মানুষ তো কেবল মৃত্যুশোকেই মূহ্যমান হয় না, তার জীবনে আরও অনেক শোকেরই আগমন ঘটতে পারে। আবার মৃত্যুশোক বলতেও কেবল যে মারা যাবে, তার মানসিক অবস্থাকেই নির্দেশ করে না। বরং যে মারা যাবে বা গেছে, তার কাছের মানুষদেরও মৃত্যুশোক একইভাবে প্রভাবিত করে। এসব কথা মাথায় রেখে কুবলার ডেভিড কেসলারের সাথে যৌথভাবে একটি বই রচনা করেন, যেটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
২০০৫ সালে প্রকাশিত On Grief and Grieving নামক বইটিতে কুবলার দাবি করেন, তিনি যে মডেলটি প্রণয়ন করেছেন তা কেবল মৃত্যুশোকেই সীমাবদ্ধ নয়, সেটির বিস্তৃতি যেকোনো শোকের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। নিজের আসন্ন মৃত্যু তো রয়েছেই, এর পাশাপাশি প্রিয়জনের মৃত্যু, কোনো মূল্যবান জিনিস খোয়া যাওয়া, চাকরি হারানো, শারীরিক অসুস্থতা, মাদকাসক্তি, সম্পর্কে বিচ্ছেদ, কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষাক্ষেত্রে অসফলতা এমন যেকোনো কারণেই মানুষ শোকাহত হতে পারে, এবং সকল ক্ষেত্রেই তাকে উপরিউক্ত ধাপগুলো পার হতে হয়।
সমালোচনা
কুবলার রস মডেলের বেশ কিছু সমালোচনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমালোচনাটি হলো, এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেবল অনুমানের ভিত্তিতে এই মডেলটি দাঁড়া করানো হয়েছে। তাছাড়া সকল মানুষের ক্ষেত্রেই যে এই সবগুলো পর্যায়েরই দেখা পাওয়া যাবে, এমনটাও তো নয়। অনেকে তো প্রথম পর্যায়ের পরেই পঞ্চম পর্যায়ে চলে যেতে পারে। কেউ আবার প্রথম দুটি পর্যায়ের অভিজ্ঞতা না পেয়েই সরাসরি তৃতীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ব্যক্তিভেদে এই বিষয়গুলোর পরিবর্তন হতে থাকে। তাই কুবলার রস মডেলটিকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয়ার কোনো সুযোগই নেই।
তবে তার মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন স্বয়ং কুবলার রসও। তাই শেষ জীবনে তিনি স্বীকার করে গেছেন যে, শুরুতে তিনি যেভাবে মডেলটি সাজিয়েছিলেন, তাতে অনেকেরই ভুল বোঝার অবকাশ ছিল। মৃত্যুপথযাত্রী কীভাবে শোক পায়, সেটি দেখানো তার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং তারা কীভাবে ক্রমান্বয়ে শোক কাটিয়ে ওঠে তথা মেনে নেওয়ার শক্তি অর্জন করে, সেটি দেখানোই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।
শিক্ষা
কুবলার রস মডেল সম্পর্কে জেনে যে আমরা আমাদের বর্তমান শোক কাটিয়ে উঠতে পারবো, কিংবা ভবিষ্যতে শোককে পরাভূত করার কৌশল আয়ত্ত করতে পারবো, তা মোটেই নয়। কিন্তু তারপরও কুবলার রস মডেল থেকে আমরা মানবমনের গতিবিধির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারি। যেমন:
- শুরুতে কারও পক্ষেই করুণ বাস্তবতাকে পুরোপুরি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তি যত বড় বাস্তববাদীই হোক না কেন, বিপদের মুখে সে কিছুটা বিভ্রান্তিকর আচরণ করবেই। অনেকেই হয়তো বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে, যা হয়েছে তা মেনে নিতে পারে, কিন্তু তাই বলে কেউ যদি শুরুতে অসংলগ্ন আচরণ করেও বসে, সেটিকে অস্বাভাবিক ভাবার কোনো অর্থ নেই।
- বিপদে পড়ে মানুষ কিছুটা অবুঝও হয়ে পড়ে, ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করতে থাকে। বিপদ তো আর বলে-কয়ে আসে না, আর যে কেউই বিপদে পড়তে পারে। কারও হয়তো বিপদে পড়ার প্রবণতা বেশি, কারও আবার কম। যাদের বিপদে পড়ার প্রবণতা বেশি, নতুন কোনো বিপদে পড়লে তাদের ‘হোয়াই অলওয়েজ মি!’ মনে হতেই পারে। আবার যে হয়তো কোনোদিনই বিপদে পড়ে না, সে-ও বিপদের মুখে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা মনে করতে পারে।
- বিপদ মানুষের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়। একজন মানুষ হয়তো সারাজীবন একধরনের আদর্শের চর্চা করে এসেছে। সেটা সে পেরেছে, কারণ তখন তার নিজের কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু নিজে তেমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পর তার নিজের বিশ্বাস-আদর্শ-চেতনায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি হয়তো আজীবন ভেবে এসেছে, আমি কখনও ঘুষ খাব না। কিন্তু পরে দেখা যেতে পারে অর্থাভাবে সেই মানুষটিই প্রচণ্ড রকমের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, যে মানুষটি কোনোদিন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেনি, বিপদে পড়ে সেই মানুষটিই প্রবল মাত্রায় ধর্মপরায়ণ হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ বিপদ মানুষের বিশ্বাসকে ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক দু’ভাবেই বদলে দিতে পারে।
- অবসাদ বা বিষণ্নতা মোটেই হালকা কোনো বিষয় নয়। সাধারণ দুঃখবোধের সাথে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। যাদের মন নরম, তারা হয়তো অল্পেই কাহিল হয়ে পড়তে পারে, দুঃখ পেতে পারে। কিন্তু যারা অবসাদগ্রস্ত, তাদের দুঃখবোধের শেকড় অনেক গভীরে। জীবনে অনেক বড় কোনো আঘাত পেলে, বা ক্রমাগত দুর্ভাগ্যের স্বীকার হতে হতেই একজন মানুষ চূড়ান্ত রকমের অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, জীবনের প্রতি তার ঔদাসীন্য দেখা দেয়। যখন একজন মানুষ এমন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন সেটিকে একদমই হালকাভাবে নেয়া যাবে না। তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে, মানসিক সমর্থন যোগাতে হবে, প্রয়োজনে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যেতে হবে।
- মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই তার মানসিক শক্তি অতুলনীয়। যত কঠিন পরিস্থিতিই আসুক, জীবন যত কঠিনই হয়ে পড়ুক না কেন, মানুষ যদি ধৈর্য ধরে থাকতে পারে, তাহলে একসময় না একসময় সে অবশ্যই মেনে নেওয়ার মত দৃঢ়চেতা হয়ে উঠবে। তাই শোকগ্রস্ত মানুষের মধ্যে যদি আগের চার রকমের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তাহলেই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে চলবে না, বা তার পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব নয় বলে ধরে নেয়া যাবে না। শোকগ্রস্ত মানুষকে যদি তার প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সময়টুকু দেয়া যায়, তাহলে সে নিজেই একসময় বিদ্যমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারবে, স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে। ভুলে গেলে চলবে না, সময়ই সবচেয়ে বড় চিকিৎসক!
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/