দৃশ্যপট ১
মায়ের আদেশে সকাল সকাল বাজার করতে রওনা দিল রওনক। মা বলেছিলেন, “দাঁড়া, একটা লিস্ট করে দিই। অনেক কিছু আনতে হবে। সব তোর মনে থাকবে না।” জবাবে রওনক বক্র হাসি দিয়ে বলেছিল, “তুমি মুখেই বলো না। সামান্য কয়টা নাম, তা-ও আমার মনে থাকবে না!” মা আর কথা না বাড়িয়ে বলতে শুরু করেছিলেন, “চাল, ডাল, তেল, নুন, মুরগি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনেপাতা, বিস্কুট, চানাচুর, ডিটারজেন্ট পাউডার, সাবান, শ্যাম্পু।”
এখন বাজারে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আফসোস করছে রওনক। মায়ের কথা শুনে লিস্ট নিয়ে এলেই বুঝি ভালো হতো। কেননা শুরুর দিকে বলা চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদির কথা তার মনে আছে। আরো ভালোভাবে মনে আছে বিস্কুট, চানাচুর, ডিটারজেন্ট পাউডার, সাবান, শ্যাম্পুর কথাও। কিন্তু মাঝামাঝি যে মা কী বলেছিলেন, তা কিছুতেই স্মরণ করতে পারছে না রওনক।
দৃশ্যপট ২
দূর থেকে দেখেই তামিমকে হাত নেড়ে ডাকল রাশেদ। রাশেদের সাথে অপরিচিত একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তামিম কাছাকাছি যেতেই রাশেদ ছেলেটির সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল, “এই হলো আরিফ। আমাদের ক্লাসে নতুন এসেছে। খুবই ভালো ছেলে। চটপটে, সাহসী, বুদ্ধিমান, আর একটু বদমেজাজি।”
রাশেদের কথা শেষ হতে তামিমের মাথায় আরিফ সম্পর্কিত একটি বিশেষণই ঘুরপাক খেতে লাগল: বদমেজাজি। তাই রাশেদের প্রথম কথা অনুযায়ী আরিফকে ভালো মনে হলেও, তাকে ‘পুরোপুরি ভালো’ লাগাতে পারল না সে। অথচ ‘ভালো’র পর আরিফের সম্পর্কে আরো যেসব ইতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার করেছে রাশেদ, সেগুলো তামিমের আর মনেই পড়ল না।
উপরের দুটি দৃশ্যপটে আমরা একটি চমৎকার সাদৃশ্য লক্ষ্য করছি। তা হলো: রওনক ও তামিম দুজনেই তাদেরকে বলা তালিকার মাঝের অংশ ভুলে গেছে। অথচ শুরুর অংশ ও শেষের অংশ তারা ঠিকই মনে রেখেছে। এবং তুলনামূলকভাবে শেষের অংশই তারা বেশি ভালোভাবে মনে রেখেছে, কিংবা শেষের অংশ দ্বারা তারা অপেক্ষাকৃত বেশি প্রভাবিত হয়েছে।
এটি কিন্তু কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে বিশেষ মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। রিসেন্সি ইফেক্ট (Recency effect) নামে অভিহিত করা হয় ব্যাখ্যাটিকে। কোনো তথ্যের শেষ বা অধিক সাম্প্রতিক অংশ বেশি ভালোভাবে মনে থাকার যে প্রবণতা, তাকেই বলা হয়ে থাকে রিসেন্সি ইফেক্ট। অর্থাৎ আপনি যদি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে একটি লেখা পড়েন, তারপরও সেই লেখার সর্বশেষ অংশটিই আপনার সবচেয়ে ভালোভাবে মনে থাকবে। কিংবা আপনাকে কেউ যদি কোনো কথা বলে, এবং আপনি পুরোটাই খুব কান খাড়া করে শোনেন, তবু শেষের অংশটিই আপনি অপেক্ষাকৃত বেশি স্মরণ করতে পারবেন।
রিসেন্সি ইফেক্টের একটি দৃষ্টান্তের দেখা মিলেছিল সেই ১৯৬২ সালে, মনোবিদ বেনেট মারডক প্রণীত গবেষণা প্রবন্ধে। সেখানে মারডক খতিয়ে দেখেছিলেন, কোনো তালিকার শব্দ-ক্রমধারা কীভাবে আমাদের স্মরণশক্তিকে, অর্থাৎ আমরা ওই তালিকার কতটুকু মনে রাখতে পারি, সে বিষয়টিকে প্রভাবিত করে। এই বিষয়টির নাম সিরিয়াল পজিশন ইফেক্ট (Serial position effect)।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীকে জোরে জোরে বিভিন্ন শব্দ-তালিকা পড়ে শোনানো হয়েছিল। গবেষণার বিভিন্ন মাত্রা অনুযায়ী, কোনো অংশগ্রহণকারীকে হয়তো মাত্র গোটা দশেক শব্দ শোনানো হয়েছিল, আবার কোনো অংশগ্রহণকারীকে হয়তো ৪০টি পর্যন্ত শব্দও শোনানো হয়েছিল। এবং শব্দ শোনানোর পর তাদেরকে দেড় মিনিট সময় দেয়া হয়েছিল একটি কাগজে তালিকার যতগুলো সম্ভব শব্দ মনে করে লিখে ফেলতে।
মারডক আবিষ্কার করেছিলেন, একটি শব্দ অংশগ্রহণকারী তথা শ্রোতার মনে থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে তালিকায় শব্দটির অবস্থানের উপর। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, তালিকার প্রথম দিকে বলা কয়েকটি শব্দ শ্রোতারা বেশ ভালোভাবেই মনে রাখতে পেরেছে। এর নাম প্রাইমেসি ইফেক্ট (Primacy effect)। এরপর অবশ্য তালিকার মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে শব্দ মনে রাখার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, যার নাম ইন্টারমিডিয়েট ইফেক্ট (Intermediate effect)। তবে তালিকার শেষভাগে এসে (শেষ আটটি শব্দের ক্ষেত্রে) আবারো শব্দ মনে রাখার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। এবং তালিকার সর্বশেষ শব্দটি মনে রাখার হার সবথেকে বেশি।
মারডক এরপর একটি লেখচিত্রের সাহায্যে ফলাফলগুলোকে সাজিয়েছিলেন। x অক্ষে তিনি বসিয়েছিলেন শব্দের ক্রমধারাকে, অর্থাৎ শব্দগুলো শুরুতে, মাঝামাঝিতে, নাকি শেষে বলা হয়েছে। আর y অক্ষে তিনি বসিয়েছিলেন অংশগ্রহণকারীর শব্দ মনে রাখার শতকরা হার।
এই লেখচিত্রের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে ইংরেজি ‘U’ আকৃতির সিরিয়াল পজিশন কার্ভ (Serial position curve): কোনো তালিকার শুরুর দিকের শব্দগুলো মনে রাখার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এরপর, তালিকাটি যদি লম্বা হয়, তবে মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে শব্দ মনে রাখার সম্ভাবনা হ্রাস পেতে থাকে। এবং তালিকার শেষভাগে এসে শব্দ মনে রাখার সম্ভাবনা আবারো বেড়ে যায়।
তবে বেনেট মারডকই কিন্তু এই বিষয়ে কাজ করা প্রথম ব্যক্তি নন। তারও অনেক আগেই জার্মান মনোবিদ হেরমান ইব্বিনউস মানুষের স্মৃতিশক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিরিয়াল পজিশন ইফেক্টের বিষয়টি উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
কোনো তালিকার শেষ দিকের বিষয়গুলো সবচেয়ে ভালোভাবে মনে থাকে, এবং প্রথম কিছু বিষয় মাঝখানের বিষয়গুলো অপেক্ষা ভালোভাবে মনে থাকে।
রিসেন্সি ও প্রাইমেসি ইফেক্টের পেছনে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করে, যেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সাইমন লাহাম ও জোসেফ ফোরফাস। তাদের মতে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে রিসেন্সি ও প্রাইমেসি ইফেক্ট।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা বেশি মাত্রায় রিসেন্সি ইফেক্ট প্রত্যক্ষ করব, যদি আমাদেরকে কোনো বিষয়ে একটি লম্বা তালিকা দেয়া হয়, কিংবা কোনো তালিকা সমৃদ্ধ তথ্য প্রদানের সাথে সাথেই সে বিষয়ে নিজেদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করতে বলা হয়। তবে একটি বিশেষ অবস্থায় প্রাইমেসি ইফেক্টও বেশি শক্তিশালী মাত্রায় ক্রিয়া করতে পারে। সেটি হবে, যদি আমাদেরকে আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয় যে তথ্যগুলো জানানোর পর সে বিষয়ে আমাদের পরীক্ষা নেয়া হবে।
যেহেতু রিসেন্সি ও প্রাইমেসি ইফেক্ট স্মৃতিশক্তির সাথে সম্পর্কিত, তাই এ কথা বলাই বাহুল্য যে আমাদের জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় বিশেষ সহায়ক হতে পারে এই দুই ইফেক্ট, যদি আমরা সঠিকভাবে এদেরকে কাজে লাগাতে পারি। বিশেষ করে পরীক্ষার আগের কয়েকদিন, যখন বিশালাকার সিলেবাস দেখে আমরা অনেকেই চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন আমাদের পড়ার ধরনকে সহজ করে দিতে পারে রিসেন্সি ও প্রাইমেসি ইফেক্ট।
এক্ষেত্রে আমাদেরকে যে ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে:
- আমরা অনেকেই সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলো পরে পড়ার জন্য ফেলে রাখি। সেটি একদমই উচিৎ নয়। বরং শুরুতেই ওই কঠিন বা গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো যদি আমরা পড়ি, তবে প্রাইমেসি ইফেক্টের দরুণ ওই পড়াগুলোর পুরোটা না হলেও, বেশ ভালো একটা অংশ আমাদের দখলে চলে আসবে।
- মাঝামাঝি পর্যায়ে যেহেতু স্মৃতিশক্তি প্রতারণা করতে শুরু করে, তাই এই পর্যায়ে এসে কোনো নতুন পড়া শুরু না করাই উত্তম। বরং এই সময়টুকুকে কাজে লাগানো যেতে পারে সেইসব পড়ায় একবার চোখ বুলিয়ে নিতে, যেগুলো আমাদের ইতিপূর্বে পড়া হয়েছে। যেহেতু বিষয়গুলো আমাদের জানা, তাই সেগুলো পড়তে আমাদের খুব বেশি পরিশ্রম করা লাগবে না, এবং সেগুলো ভুলে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকবে না।
- পরীক্ষার ঠিক আগের মুহূর্তে আমাদেরকে আবারো ফিরে যেতে হবে শুরুর সেই কঠিন বা গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পড়ায়। আগে পড়া থাকায় কিছু অংশ আমরা ইতিমধ্যেই জানি। এবার আমাদেরকে বাকি অংশগুলোও আয়ত্তে আনার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে যদি ওই বিষয়গুলোর অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ আয়ত্তে এনেও পরীক্ষার হলে ঢোকা যায়, এবং পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়ে, তাহলে পরীক্ষা ভালো হওয়ার নিশ্চয়তা তৈরি হবে।
প্রাইমেসি ও রিসেন্সি ইফেক্ট কিন্তু কোনো পণ্যের মার্কেটিংয়েও ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। একজন সম্ভাব্য ক্রেতা একটি পণ্য কিনবে কি না, তা মূলত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। প্রথমত, পণ্যটির First impression তথা প্রথম দেখায় ভালো লাগা বা মন্দ লাগা (প্রাইমেসি ইফেক্ট); দ্বিতীয়ত, পণ্যটি সম্পর্কে সর্বশেষ শোনা অভিমত (রিসেন্সি ইফেক্ট)। এর মানে হলো, একজন সম্ভাব্য ক্রেতা পণ্যটি কেবল তখনই কেনার সিদ্ধান্ত নেবে, যদি পণ্যটিকে প্রথম দেখায়ই তার ভালো লেগে যায়, এবং পণ্যটি সম্পর্কে তার সর্বশেষ শোনা মন্তব্যও সন্তোষজনক হয়।
ধরুন, একটি পণ্য দেখতে খুবই রঙচঙে, আকর্ষণীয়। পণ্যটির মোড়কও বেশ মনোগ্রাহী। তার মানে পণ্যটি সম্পর্কে শুরুতেই ক্রেতার মনে একটি ভালো লাগা তৈরি হলো। কিন্তু পণ্যটি কেনার আগমুহূর্তে সে কোথাও থেকে শুনল, পণ্যটি নাকি আদতে খুব একটা ভালো না। তখন কিন্তু ক্রেতার মনে পণ্যটি কেনার আগ্রহ কমে যাবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রাইমেসি ইফেক্ট ইতিবাচক হলেও রিসেন্সি ইফেক্ট ইতিবাচক হলো না। তাই ক্রেতা ওই পণ্যটি আর কিনল না।
আবার ধরুন, একটি পণ্য দেখতে মোটেই সুবিধার না। ফলে পণ্যটি সম্পর্কে ক্রেতার মনে ইতিবাচক কোনো প্রাইমেসি ইফেক্ট সৃষ্টি হলো না। এখন বিক্রেতা বা অন্য কেউ যতই তার সামনে পণ্যটির গুণাগুণ বর্ণনা করুক, অর্থাৎ রিসেন্সি ইফেক্ট ইতিবাচক করার চেষ্টা করুক, তারপরও ক্রেতার ওই পণ্যটি না কেনার সম্ভাবনাই বেশি। তার মানে, রিসেন্সি ইফেক্ট ইতিবাচক হলেও প্রাইমেসি ইফেক্ট ইতিবাচক না হওয়ায় পণ্যটি বিক্রি হলো না।
পণ্যের কাটতি বৃদ্ধির জন্য তাই উৎপাদক বা বিক্রেতার প্রাইমেসি ও রিসেন্সি ইফেক্টের প্রয়োজনীয়তা স্মরণে রাখা প্রয়োজন। প্রাইমেসি ইফেক্ট ইতিবাচক করার লক্ষ্যে তাদের উচিৎ পণ্যটিকে আকর্ষণীয়ভাবে প্রস্তুত করা, কিংবা পণ্যটি বাজারে আনার পূর্বেই সেটির ব্যাপক আকারে বিজ্ঞাপন প্রচার করা। আর রিসেন্সি ইফেক্ট ইতিবাচক করতেও ক্রমাগত পণ্যটির বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি পণ্যের সর্বোচ্চ গুণগত মানও নিশ্চিত করা উচিৎ।
বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/