কেমন হবে যদি আপনি একটা ট্যাবলেট খাওয়ার সাথে সাথেই আইনস্টাইনের মতো সুপার জিনিয়াস টাইপের কেউ হয়ে যান! কথাটা হলিউড মুভির প্লটের মতো শোনাতে পারে, কিন্তু ‘স্মার্ট ড্রাগ’ নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণা কিছুটা হলেও সফলতার মুখ দেখেছে বলে বিশ্বাস গবেষকদের। এই চেতনাবর্ধক বা স্মার্ট ড্রাগগুলোকে বলা হয় নুট্রপিক (Nootropic)। যদিও এই নুট্রপিকগুলো আসলে কতটা কাজের, সেটা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোর ইতিবাচক ফলাফল বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে। ফলস্বরূপ ২০১৫ সালেই এই ড্রাগগুলোর বিক্রয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
মোডাফিনিল
গত শতাব্দী থেকে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক ঔষধ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে কেবলমাত্র মোডাফিনিল (Modafinil) সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রে ঘুম সংক্রান্ত সমস্যা, যেমন: ঘন ঘন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, নিদ্রাহীনতা, অনিয়মিত ঘুম ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় এর অন্যান্য সুফলও দেখা যায়, কিন্তু এগুলোতে অনেক অসামঞ্জস্যতা ছিল। এই জটিলতা দূর করার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ২৪টি গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করেন। সেখানে দেখান কীভাবে মোডাফিনিল ব্রেইনের চেতনাকে প্রভাবিত করে। ফলে ২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান নিউরোসাইকোফার্মাকোলজি থেকে প্রকাশিত হয় একটি রিভিউ পেপার। দেখা গেছে, দৈনন্দিন সাধারণ কাজ, যেমন: কোনো একটি রঙ দেখে নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দেয়া, এ ধরনের কাজে মোডাফিনিলের তেমন কোনো প্রভাব নেই।
পরবর্তীতে মোডাফিনিল সেবন করে তাদের কঠিন এবং জটিল কাজের দক্ষতা পর্যালোচনা করা হয়। এবারের ফলাফল হয় সন্তোষজনক। এখান থেকে ধারণা করা হয়, এটি মনোযোগ এবং চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
যদিও সব চিকিৎসকই মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য যেকোনো ধরনের মাদক বা ওষুধ সেবনকে নিরুৎসাহিত করেন, কিন্তু ২০০৮ সালে নেচার সাময়িকীর একটি জরিপে দেখা যায়, এর পাঠকদের মধ্যে প্রতি ৫ জনের মাঝে ১ জন মস্তিষ্ক উদ্দীপক ড্রাগ (Brain Boosting Drug) সেবন করে। আর এদের মধ্যে অর্ধেকই গ্রহণ করেন মোডাফিনিল। তবে এটুকু শুনেই ফার্মেসিতে দৌড় দেয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি যদি ভেবে থাকেন স্মার্ট ড্রাগ আপনাকে স্মার্ট করবে, সেক্ষেত্রে একটু সমস্যা আছে। কারণ অনেক গবেষণা মোডাফিনিলের নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করলেও অনেক গবেষণা এটাও দেখায় যে আদতে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে এর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে।
ক্যাফেইন
ক্যাফেইন একটি স্নায়ু উত্তেজক। সাধারণভাবে একে নুট্রপিক বলা যায় না। এটি শত শত বছর ধরে চলে আসা সবচেয়ে জনপ্রিয় চেতনা উদ্দীপকও। কফি মানেই কিন্তু ক্যাফেইন নয়। কফিতে আছে অসংখ্য উপাদান, ক্যাফেইন তার একটি। এটি আপনাকে চাঙ্গা রাখবে, মনোযোগ এবং স্মরণশক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে। এছাড়া বিষণ্ণতার ঝুঁকি কমাবে। তবে এর প্রভাব খুবই স্বল্প সময়ের জন্য থাকে। আমাদের দেহ খুব দ্রুতই এর সাথে মানিয়ে নেয়।
নিকোটিন
নিকোটিন শব্দটি শুনলেই মাথায় আসে সিগারেটের কথা। কিন্তু আদতে সিগারেট মানেই নিকোটিন না। এটি হাজার বছর ধরে স্নায়ু উত্তেজক হিসাবে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে। তবে নিকোটিনের অনেক বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এবং এটি আসক্তি তৈরি করে। তাই সেবন না করাই উত্তম।
অ্যামফেটামিন
প্রথম তৈরি হয় ১৮৮৭ সালে। বেঞ্জেড্রিন হলো প্রথম ড্রাগ, যা শিশুদের হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। অ্যামফেটামিন মস্তিষ্কে নরাপিনেফ্রেইন এবং ডোপামিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে মনোযোগ এবং এপিসোডিক মেমোরি উন্নত করতে সহায়তা করে। তবে নিকোটিনের মতো এটিও আসক্তি তৈরি করে এবং খাবারে অরুচি, নিদ্রাহীনতা থেকে মানসিক রোগ পর্যন্ত হতে পারে।
মিথাইলফেনিডেট
এটি রিটালিন নামে পরিচিত। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে আসে ১৯৬০ সালে, হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডারে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সাল থেকে এটি এডিএইচডি (ADHD)-র জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শুধু যুক্তরাজ্যেই মিথাইলফেনিডেট প্রেসক্রিপশন ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। অনেক শিক্ষার্থীই তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়াতে এটি ব্যবহার করেন। যদিও চিকিৎসকগণ সুস্থ-স্বাভাবিক কাউকে এ ধরনের ড্রাগ নিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন।
কারা স্মার্ট ড্রাগ সেবন করেন?
প্রকৃতপক্ষে এটি একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে কাজ করে। মানব মস্তিষ্ক খুবই জটিল। একজনের ক্ষেত্রে যদি এটি দক্ষতা বাড়ায়, অন্যজনের সেটি ক্ষতিও করতে পারে। তাই সামগ্রিকভাবে এ ধরনের ওষুধ সবার সেবন করা উচিত কিনা, সেটি একটি যৌক্তিক প্রশ্ন। চেতনা উদ্দীপক ড্রাগগুলো মস্তিষ্কের গঠন এবং বৃদ্ধিতে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই শিশুদের জন্য এগুলো গ্রহণ খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যদিও বেশ কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় শিশুদের এডিএইচডির চিকিৎসায় মোডাফিনিলকে নিরাপদ বলে মনে হয়েছে, কিন্তু পরীক্ষাগুলো ছিল কয়েক মাসের জন্য। তাই দীর্ঘ পরিসরে এর প্রভাব এখনও অজানা। ২০১৪ সালের একটি রিভিউ আর্টিকেলে ডেলাওয়্যার এবং ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক মোডাফিনিল এবং অন্যান্য স্মার্ট ড্রাগগুলোর ব্যাপারে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, এ ধরনের ড্রাগ নিয়মিত সেবনে মস্তিষ্কের কোনো নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার যে ক্ষমতা, সেটি নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া এগুলো সেবনকারীর জন্য নেশার মতো হয়ে যায়।
এ ড্রাগগুলোর সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া গেছে স্বল্প এবং মাঝারি আইকিউ-এর মানুষের ক্ষেত্রে। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এগুলো কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। মিথাইলফেনিডেট (রিটালিন), যেটি কিনা অল্প বয়সী বা তরুণদের মনোযোগ এবং স্মরণশক্তি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে, সেই একই ড্রাগ বয়স্কদের বেলায় কোনো প্রভাব ফেলেনি।
এই নুট্রপিকগুলো বেশি সেবন করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। একটি জরিপে দেখা গেছে, ৩-১১ শতাংশ আমেরিকান এবং ০.৭-৪.৫ শতাংশ জার্মান শিক্ষার্থীই এ ধরনের চেতনাবর্ধক সেবন করে। ডাইমিথাইল অ্যামিনামিন এবং মিথাইলফেনিডেট কলেজ ক্যাম্পাসে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশের ৫-৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এডিএইচডির চিকিৎসায় ব্যবহৃত উত্তেজকগুলো সেবন করে থাকে।
স্মার্ট ড্রাগ কি আসলেই আপনাকে স্মার্ট করে তুলবে?
মার্কেটিং ট্রেন্ড অনুসরণ করলে বলতে হয়, স্মার্ট ড্রাগ আপনাকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখবে। কিন্তু আসলে কতটা সত্য তাদের এই দাবি? অনেকেই হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন, এই স্মার্ট ড্রাগগুলো অ্যাথলেটদের স্টেরয়েডের মতো। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি তেমন নয়। বরং এটি আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন কেমিক্যালের একটি ভারসাম্য তৈরি করে কাজে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
অনেক ক্ষেত্রেই এই ড্রাগ কেবলমাত্র সেবনকারীর আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, প্ল্যাসিবো ইফেক্টের মতো। আর চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ধরনের ড্রাগ গ্রহণ রীতিমত বিপজ্জনক, যেমন: অ্যাডেরাল মনোযোগ বৃদ্ধিতে বেশ কার্যকর হলেও এটি উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া স্মার্ট ড্রাগগুলোর অধিকাংশই মাদকের মতো নেশা সৃষ্টি করতে পারে। বেশ কিছু গবেষণা প্রমাণ করে যে, কেবলমাত্র রাতের ভালো ঘুম এবং দৈনন্দিন ব্যায়াম এই স্মার্ট ড্রাগগুলোর থেকে কার্যকর ফলাফল এনে দেয়।
তাহলে কীভাবে আমরা এগিয়ে থাকবো সবার থেকে? স্মার্ট ড্রাগ গ্রহণ করবো? বিশেষজ্ঞরা কিন্তু আমাদের সেই পুরনো পরামর্শই দিচ্ছেন। নিজে নিজে সমস্যার সমাধান করা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করা। যদিও স্মার্ট ড্রাগ এখনও এতটা স্মার্ট হয়ে উঠতে পারে নি, তবে আমরা আশাবাদী যে বিজ্ঞানের কল্যাণে হয়তো শুধু মাত্র একটি ঔষধ খেয়েই পরীক্ষায় অসাধারণ গ্রেড পাওয়া যাবে!
তথ্যসূত্র:
১। Diller, Lawrence (1999). Running on Ritalin