অন্য সব ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার মতো গ্রহণও সবসময় জনসাধারণের কাছে এক অপার রহস্যের আধার হয়ে থেকেছে। সূর্য বা চাঁদ চোখের সামনে একটু একটু করে আড়াল হতে থাকা, দিনের বেলা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া, চাঁদ লালচে রং ধারণ করা, ভৌতিক সবুজাভ জ্যোতির্বলয় তৈরি হওয়া ইত্যাদি সবকিছুই হাজার বছর ধরে মানুষকে অভিভূত করে এসেছে। আর এই রহস্যময় ঘটনার পেছনের প্রকৃত কারণ না জানার কারণে জন্ম নিয়েছে অনেক মনগড়া কাহিনী আর কুসংস্কার।
গ্রিকরা মনে করতো, সূর্যগ্রহণ হচ্ছে স্রষ্টার রাগ এবং আসন্ন মৃত্যু ও ধ্বংসের পূর্বাভাস। গ্রহণের ইংরেজি পরিভাষা Eclipse এসেছেও গ্রিক শব্দ Ekleipsis থেকে, যার অর্থ রহস্যময় বা পরিত্যক্ত। এদিকে চীনের লোকেরা বিশ্বাস করতো, স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গ্রাস করে নেওয়ার ফলে সূর্যগ্রহণ হয়। গ্রহণ বা Eclipse এর চীনা পরিভাষা হচ্ছে chih বা shih, যার অর্থ খাওয়া।
ভিয়েতনামের বাসিন্দারা ভাবতো, বিশাল আকারের একটি ব্যাঙ সূর্যকে গিলে ফেলার কারণে সূর্যগ্রহণ হয়। ওদিকে ইনকা সভ্যতার লোকদের বিশ্বাস ছিল যে, একটি চিতাবাঘ চাঁদকে গ্রাস করার কারণে চন্দ্রগ্রহণ হয়। চাঁদের ওপর আক্রমণ শেষ হলে সে পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষদের ওপর আক্রমণ করবে। তাই তারা চাঁদের দিকে বর্শা তাক করে কল্পিত এই চিতাবাঘকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতো। এমনকি আশপাশের কুকুরদের গায়ে তারা আঘাত করতো, যাতে কুকুরের আর্তচিৎকারে ঐ চিতাবাঘ ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় এবং পৃথিবীতে আর আক্রমণ না করে।
প্রকৃতপক্ষে গ্রহণ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত বা আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এটি তখনই ঘটে, যখন সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ একই সরলরেখায় অবস্থান করে। পৃথিবী ও চাঁদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে কখনো সূর্যগ্রহণ হয়, কখনোবা চন্দ্রগ্রহণ। সহজভাবে বলতে গেলে, চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ করতে করতে যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে চলে আসে, তখন এটি সূর্যের আলোকে পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে বাধা দেয়। ফলে সূর্যগ্রহণ ঘটে।
আবার যখন পৃথিবী নিজ কক্ষপথে আবর্তন করতে করতে চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে, তখন এটি সূর্যের আলোকে চাঁদের ওপর আপতিত হতে বাধা দেয় এবং পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ আচ্ছাদিত হয়। একে বলা হয় চন্দ্রগ্রহণ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন লোকজ বিশ্বাস ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, গর্ভবতী নারীদেরকে তাদের গর্ভস্থ শিশুর সুরক্ষার জন্যে গ্রহণের সময় অতিরিক্ত কিছু সাবধানতা মেনে চলতে বলা হয়। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণের সঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতির তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনই কিছু প্রচলিত কুসংস্কার এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে আজকে আলোচনা করা হলো।
“গর্ভবতী নারীরা সূর্যগ্রহণের সময় বাড়ির বাইরে গেলে এবং খালি চোখে গ্রহণ দেখলে গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ, অন্ধ বা দেখতে অসুন্দর হয়”
পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় যখন চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণরূপে আড়াল করে ফেলে, তখন এর উজ্জ্বল জোতির্বলয় থেকে তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ ঘটতে থাকে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, এই বিকিরণ সূর্যের আলোর তীব্রতার তুলনায় অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই এই বিকিরণ ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে, পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে এসে দর্শকের চোখে অন্ধত্ব সৃষ্টি করতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবে সূর্য পুরোপুরি আড়াল হয়ে যাওয়ার আগেই, অর্থাৎ আংশিক সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের উজ্জ্বল বিকিরণ চোখে পড়লে তাতে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি এর ফলে অন্ধত্বও (eclipse blindness) দেখা দিতে পারে। তাই সরাসরি সূর্যের দিকে না তাকানোর নিয়মটি শুধু গর্ভবতী নারী নয়, বরং সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি সানগ্লাস বা এক্স-রে ফিল্মও পুরোপুরিভাবে নিরাপদ নয়। সূর্যগ্রহণ দেখার জন্যে বিশেষভাবে তৈরিকৃত নিরাপদ চশমা (eclipse glass) পরে, তবেই সূর্যগ্রহণ দেখা উচিত।
“গ্রহণের সময় কোনো খাবার রান্না করা, খাবার খাওয়া বা পানি পান করা উচিত নয়”
মনে করা হয়, গ্রহণের সময় এক প্রকার বিকিরণ ঘটে, যা খাবারকে বিষাক্ত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এমন কোনো ক্ষতিকারক বিকিরণ ঘটে না, যা খাবারে বিষক্রিয়া করতে পারে। তবে সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যরশ্মি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে বাধা পায়। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ বেশ কমে যায়। কম তাপমাত্রা এবং সূর্যালোকের অভাবের কারণে খাবারে ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণ হতে পারে বলে আশঙ্কা থাকে। তাই জীবাণুজনিত বিষক্রিয়া এড়ানোর জন্যে, সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত খাবার ফেলে দিয়ে নতুনভাবে খাবার তৈরি করাকে যৌক্তিক ভাবা যেতে পারে।
গ্রহণের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্যে উপবাস পালন করা উচিত।
অনেকে চন্দ্রগ্রহণ শুরুর নয় ঘণ্টা এবং সূর্যগ্রহণ শুরুর বারো ঘণ্টা আগে থেকে এ উপবাস শুরু করেন। এ সময় উপবাস পালনকারীগণ রান্না করা খাবার এবং পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
আসলে গ্রহণের সময় এমন কোনো বিকিরণ ঘটে না, যা খাবারকে নষ্ট বা বিষাক্ত করতে পারে এবং গ্রহণের সঙ্গে অশুভ কোনো কিছু ঘটারও সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই এসময় খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
“গর্ভবতী নারীরা গ্রহণ চলাকালে ছুরি, কাঁচি বা অন্য কোন ধারালো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবে না। কোনো ধাতব অনুষঙ্গ বা গহনা ব্যবহার করা যাবে না”
এসব নিষেধাজ্ঞা না মানলে গর্ভস্থ শিশু ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করবে, এমন একটি কুসংস্কার ভারতে প্রচলিত রয়েছে। আবার মেক্সিকোতে ঠিক উল্টোটা ঘটে। সেখানে গ্রহণের কুপ্রভাব থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য গর্ভবতী নারীরা ধাতব অনুষঙ্গ (যেমন- সেফটিপিন) পরা, পেটের কাছে ছুরি ধরে রাখা, লাল রঙের অন্তর্বাস পরা- এসব নিয়ম পালন করে থাকেন।
প্রকৃতপক্ষে জন্মগত ঠোঁট বা তালু কাটার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না পাওয়া গেলেও, বংশগত, পরিবেশগত কারণ কিংবা কিছু ঔষধ বা রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে এটি হতে পারে বলে জানা যায়। তবে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সাথে শিশুর এ ধরনের ত্রুটি নিয়ে জন্মানোর ঘটনার সম্পর্ক নিয়ে কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মানব ভ্রূণের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম সপ্তাহ বয়সে তার নাক, মুখের তালু এবং ঠোঁট তৈরি হয়। এসময় ছবিতে সবুজ এবং হলুদ রঙে নির্দেশিত অংশগুলো ডান ও বাম- দু’পাশ থেকে এসে মাঝ বরাবর মিলিত হয় এবং মুখের তালু ও ঠোঁট গঠন করে। কোনো কারণে দু’পাশের অংশগুলো মাঝে এসে মিলিত হতে বাধা পেলে ঐ অংশে ফাঁকা থেকে যায়। তখন একে আমরা ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা বলে থাকি। এর সঙ্গে গ্রহণের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
“গর্ভবতী নারীদেরকে গ্রহণ চলাকালে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে হবে, নইলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিতে পারে”
এটি একদমই বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন একটি বিশ্বাস। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় দীর্ঘসময় একইভাবে শুয়ে থাকা অস্বস্তিকর এবং কষ্টদায়কও বটে। তাই একজন গর্ভবতী মহিলা অন্য সময়ে যেভাবে চলাচল করেন বা শুয়ে থাকেন, গ্রহণের সময়েও ঠিক সেভাবেই চলতে পারবেন। তার শিশু তার জরায়ুর ভেতরেই সুরক্ষিত আছে। সুতরাং বিকলাঙ্গতা ঘটানোর মতো অন্য কোনো কারণ না থাকলে, শুধু গ্রহণের প্রভাবে শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে- এমন আশঙ্কা অমূলক।
“গ্রহণ শেষ হওয়ার পর গোসল করে এর সকল অশুভ প্রভাব শরীর থেকে দূর করে ফেলতে হবে”
গ্রহণ কেন হয়, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে আমরা জেনেছি যে, এটি সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক একটি ঘটনা। সুতরাং এর ওপর কোনো কিছুরই মঙ্গল বা অমঙ্গল নির্ভর করে না। তাই গোসল করে এর অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার আদতে কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
মূল কথা এটিই যে, গর্ভস্থ শিশুর ওপর গ্রহণের প্রভাব সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর পক্ষে বৈজ্ঞানিকভাবে শক্ত কোনো প্রমাণই নেই। সুতরাং গর্ভাবস্থায় গ্রহণ দেখা দিলে এ নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই। কোনো কারণে এগুলো পালন করা সম্ভব না হলে সন্তানের বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে, এমনটা ভেবে দুশ্চিন্তায় ভোগার সময় শেষ হয়ে গেছে, বিজ্ঞান এখন মানুষের অজ্ঞতার চোখ খুলে দিয়ে এনেছে জ্ঞানের আলো।