চাঁদে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাদের অভিমত অনেক আগেই প্রকাশ করেছেন। চাঁদে প্রাণ টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মানুষ যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা চিন্তা করল এবং তা নিয়ে আশংকা করল, তখন বুঝতে পারল যে এমন একটা সময় আসবে যখন একটি মাত্র পৃথিবী এত মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে না।
সে চিন্তা থেকে বিকল্প বাসস্থান খুঁজতে মানুষের প্রথম পছন্দ ছিল চাঁদ। পৃথিবীরই উপগ্রহ। পৃথিবীর সাথেই থাকে সবসময়। ১৯৬৯ সালে মানুষ পাঠানোর পর এবং সেখান থেকে কিছু নমুনা নিয়ে আসার পর চাঁদ ও চাঁদে বসবাস করা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এরপরেও কয়েকবার চাঁদে অভিযান করা হয়েছে, এসব অভিযান থেকে চাঁদ সম্পর্কে অনেক তথ্যও পাওয়া গেছে। সেগুলো নিয়েও গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণা থেকেই বোঝা গেছে বসবাস করার জন্য চাঁদ একদমই উপযুক্ত নয়। যদি বসবাস করতেই হয় তাহলে কৃত্রিমভাবে পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে কোনোভাবে।
কেন চাঁদে বসবাস করা সম্ভব নয়? প্রথমত চাঁদের পরিবেশ পৃথিবীর মতো নয়। মানুষের জীবন ধারণের জন্য অনুকূল আবহাওয়া সেখানে নেই। পানির কোনো উৎস নেই। ক্ষতিকর সৌরবাতাস এবং মহাজাগতিক বিকিরণ রোধ করার জন্য পৃথিবীর মতো বিশেষ কোনো কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো রাসায়নিক পলিমার নেই। চাঁদে তাপমাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত বেশি; যখন তখন তাপমাত্রার ব্যাপক উঠানামা হয়। এরকম পরিবেশের সাথে মানুষ একদমই অভ্যস্ত নয়।
এত প্রতিবন্ধকতার পরও মাঝে মাঝে ভিন্ন কথা শোনা যায়। গত সপ্তাহে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যেখানে চাঁদে প্রাণ থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। Astrobiology নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধটির শিরোনাম হচ্ছে– Was there an early habitability window for earth’s moon?
মজার কথা হচ্ছে, এই গবেষণা যখন সংবাদ মাধ্যমে আসে তখন শিরোনাম পরিবর্তন হয়ে যায়। ফিজ ডট ওআরজি-র মতো সংবাদমাধ্যম এর শিরোনাম দেয় Researcher sees possibility of moon life। দুই শিরোনামে আকাশ পাতাল পার্থক্য। প্রথমটিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, পূর্বে চাঁদে এমন কোনো পরিবেশ ছিল কি না যা বসবাসের জন্য উপযোগী ছিল। আর সংবাদমাধ্যমে এসেছে গবেষকরা বলছেন চাঁদে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা আছে। এই প্রবন্ধ সংবাদ হিসেবে প্রকাশ পাওয়ার পর সবার মধ্যে একটি চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। কারণ এতদিন জানা ছিল চাঁদে জীবন থাকার সম্ভাবনা একদম শূন্যের কাছাকাছি। আর এখন আবার এমন কী আবিষ্কার হল যা চাঁদে প্রাণ থাকার দিকে ইংগিত দিচ্ছে?
Astrobiology- সাময়িকীতে যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে তার লেখক ছিলেন লন্ডনের বারবিক কলেজ এবং জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের দুই গবেষক। তারা আসলে পুরো প্রবন্ধটিতে কোথাও বলেননি যে চাঁদে জীবন থাকতে পারে। এই গবেষণায় প্রথমে তারা চাঁদে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধকে একত্রিত করেন এবং সেগুলো খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন। এরপর তাদের নিজেদের একটি মতামত দেন। তারা বলেন, আগে হয়তো কখনো চাঁদে কিছু সময়ের জন্য প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। তারা সরাসরি অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলেননি।
চাঁদ নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা প্রবন্ধে এর সমর্থন আছে। সেসব প্রবন্ধে বলা হয়েছে, চাঁদ গঠনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটা সময় এর পরিবেশ একরকম ছিল না। এই সময়ে চাঁদের পরিবেশে কিছু ভিন্নতা তৈরি হয়েছিল। যা সেখানে প্রাণ থাকার সম্ভাবনায় কিছুটা আশা জাগায়।
চাঁদে অগ্ন্যুৎপাত হতো, এমন প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। সেখান থেকে তারা চাঁদে প্রাণ থাকার একটি অনুমাননির্ভর মতামত প্রকাশ করেন। তারা চাঁদে প্রাণ থাকার পর্যায়কে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটি পর্যায় ছিল চার বিলিয়ন বছর আগে যখন চাঁদের উৎপত্তি হয় তার কিছু সময় পর পর্যন্ত এবং আরেকটি পর্যায় হচ্ছে ৩.৫ বিলিয়ন আগে। এই দুই সময়ের মধ্যে চাঁদে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত দৃঢ়।
চাঁদে আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তার কারণে সেখান থেকে আগ্নেয় গ্যাস তৈরি হয়েছিল। এই গ্যাসের কারণে পানির বাষ্প চাঁদের পৃষ্ঠে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিল। এমনটি ধারণা করার আরেকটি কারণ হচ্ছে ২০০৮ সালে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পায় যেখানে বলা হয়েছিল যে চাঁদ থেকে নিয়ে আসা নমুনার ভেতর পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
এর উপর ভিত্তি করে আরো বেশ কয়েকটি গবেষণায় এরকম তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রস্তাবনার সাথে যদি একমত হই তাহলে আমরা একটি অনুমান দাঁড় করাতে পারি, এই বাষ্পীভূত পানির কারণে চাঁদের বায়ুমণ্ডল অনেক বেশি ঘন এবং পুরু হয়ে পড়েছিল। যদি এমনটি আসলেই হয়ে থাকে তাহলে হয়তো সৌর বিকিরণ কিংবা মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বাঁচার প্রক্রিয়া চাঁদেও তৈরি হয়েছিল। হোক সেটা কম সময়ের জন্য।
যদি বিজ্ঞানীদের এই অনুমান সঠিক হয় তাহলে একটু সম্ভাবনা মেনে নেয়া যায়, হয়তো চাঁদে প্রাণের অস্তিত্ব কোনো একসময় ছিল। তবে এখন আর নেই। বিজ্ঞানীদের অভিমত- এখন চাঁদে তাপমাত্রার যে তারতম্য দেখা যায় ওই সময়টাতে তাপমাত্রা হয়তো স্থিতি অবস্থায় ছিল। তবে এই ব্যাপারগুলো খুব বেশি নিশ্চিত নয়। এগুলো নিয়ে সন্দেহ আছে।
তবে প্রাণ তৈরির জন্য যে পলিমার রসায়ন দরকার, যে এমিনো এসিড দরকার এবং আরও কিছু রাসায়নিক উপাদান দরকার সেগুলোর অস্তিত্ব চাঁদের অভিযান থেকে প্রাপ্ত নমুনা থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, হয়তো চাঁদে এসব উপাদান ছিল তবে মিশ্র অবস্থায় ছিল এবং অল্প সময়ের জন্য ছিল। অথবা কোনো গ্রহাণুপুঞ্জের আঘাতে চাঁদে রাসায়নিক উপাদান তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এখন আর নেই।
চাঁদে যে আগ্নেয় উৎপাত আগে হতো সেগুলোর তলানি বা পলিগুলোর নমুনা বিশ্লেষণ করলে কিংবা সেসব উপাদানের কার্বন ডেটিং করলে বিজ্ঞানীদেরে এমন অনুমানের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। তবে এসব সম্ভাবনার উপর ভর করে কোনোভাবেই এটা দাবি করা যাবে না যে চাঁদে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। আমরা বড়জোর উপরের আলোচনার পর এরকম অনুমান করতে পারি যে কোনো একসময় অল্প কিছু সময়ের জন্য এখানে হয়তো প্রাণ তৈরির অনুকূল একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেখানে আদৌ প্রাণ উৎপন্ন হয়েছিল কিনা সেটা নিয়ে কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই এধরনের খবরের ব্যাপারে অল্পতেই উচ্ছসিত হওয়া উচিত নয়। তবে বিজ্ঞান একদিন এগিয়ে যাবে, প্রযুক্তি উন্নত হবে, একদিন হয়তো মানুষ সেখানে কৃত্রিমভাবে বসবাসের পরিবেশ তৈরি করে নেবে এবং পৃথিবীর মতো করে বসবাস করবে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: luigiswayze.deviantart.com