থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় মেশিন নিয়ে দেওয়া সেই সংলাপের কথা মনে আছে? সেটিকেই একটু ভিন্নভাবে বলা যায়, “আমাদের চারপাশের সবকিছুতেই রয়েছে বিজ্ঞানের অবদান, প্যান্টের জিপার থেকে মাথার উপরে ফ্যান পর্যন্ত।” বিজ্ঞানের অসাধারণ সব আবিষ্কার আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করছে সহজ থেকে সহজতর। স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জেনেছি অনেক বিজ্ঞানী সম্পর্কে, জেনেছি তাদের আবিষ্কারের কথা। কিন্তু এমন কিছু ঘটনার কথা হয়তো আমরা জানি না; যেখানে কোনো একটি বিখ্যাত বিষয়ের আবিষ্কারক হিসেবে আমরা যাদেরকে চিনি, তারা আসলে সেই আবিষ্কারের কৃতিত্বের একক ভাগীদার নন। কিন্তু অন্য আবিষ্কারকদের ছাপিয়ে তারাই শুধু পাদপ্রদীপের আলোয় অবস্থান করে আছেন। এমন কিছু বিখ্যাত আবিষ্কারের অনালোচিত আবিষ্কারকদের নিয়েই আজকের লেখা।
১) ডাবল হেলিক্স
বিজ্ঞানের ইতিহাসে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত আবিষ্কারের একটি। কেননা এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অবশেষে বুঝতে সক্ষম হন যে, ডিএনএ আসলে কীভাবে কাজ করে, তারা কীভাবে পরস্পরের সাথে আবদ্ধ থাকে। এটি জীববিজ্ঞানে এতটা মূল্যবান ভূমিকা রাখে যে, আবিষ্কারের প্রায় চার বছর পর ১৯৬২ সালে বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং মরিস উইলকিন তাদের এই অসামান্য অবদানের জন্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
বেশ ক’জন বিজ্ঞানীর সহযোগিতাপূর্ণ প্রচেষ্টার ফলেই এই আবিষ্কার সম্ভব হয়েছিল, সেটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এর পেছনে যার অবদান অনেক বেশি ছিল, সেই রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের নামই তখন জনসমক্ষে আসেনি। বিজ্ঞানে অবদানের ক্ষেত্রে নারীর অবদানকে অগ্রাহ্য করার ঘটনা নতুন নয়। ওভারিয়ান ক্যান্সারের কারণে রোজালিন্ডের অকালমৃত্যুর চার বছর পরে এই তিন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। রোজালিন্ড যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো সেদিন বাকিদের সাথে তার নামও এই আবিষ্কারের সাথে উচ্চারিত হতো। রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন আর মরিস উইলকিন একই বিষয়ে, একই গবেষণাগারে কাজ করলেও তাদের কাজের প্রকল্প ছিল আলাদা। তাদের ব্যবহৃত গবেষণাগারটি ছিল সেই সময়কার প্রথম গবেষণাগার, যেখানে ডিএনএ পর্যবেক্ষণের জন্য ‘এক্স-রে ইমেজিং’ ব্যবহার করা হয়। আগে কখনও ডিএনএর গঠন এতটা পরিষ্কারভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়নি।
ব্যাপার হচ্ছে, সেই সময়ে নারীদের গবেষণাগারে সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার ছিল না। তাছাড়া, রোজালিন্ড আর মরিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল এবং তাদের পদমর্যাদা সমান হওয়া সত্ত্বেও মরিস তার সাথে সহকারীর মতো আচরণ করতেন। এছাড়া কিছু বিপত্তির কারণে রোজালিন্ডের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহারের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াটসন ও ক্রিক তার আগেই বৈজ্ঞানিক জার্নালে তাদের ডিএনএ’র গঠন তত্ত্বটি প্রকাশ করে দেন। ফ্রাঙ্কলিন তার একক প্রচেষ্টায় এই জটিল তত্ত্বের উপর কাজ করতে থাকেন। দিন শেষে তার অগ্রগতি দেখে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যান। কারণ, একক প্রচেষ্টায় এই তত্ত্বের উপর এমন অসাধারণ বিশ্লেষণ তৈরি করা এক কথায় অসম্ভব! তবে তার ধারণাটি সঠিকভাবে প্রমাণ করার জন্য, সেটিকে গাণিতিক এবং রাসায়নিকভাবে সুনির্দিষ্ট মডেলে রূপান্তর করতে হতো। তিনি সেটি করে দেখানোর আগেই ওয়াটসন ও ক্রিক তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যান। আর এদিকে মরিস উইলকিন তাদের কাছে যেই তথ্য পাঠিয়েছিলেন তাতে তিনি ফ্রাঙ্কলিনের নাম উল্লেখ করেননি। পরে ওয়াটসন ও ক্রিক জানতে পারেন যে, উইলিকিনের পাঠানো তথ্য মূলত ফ্রাঙ্কলিনের থিউরি থেকে তৈরি করা। ক্রিক তার ব্যক্তিগত বিবৃতিতে বলেন, “উইলকিন নোবেলের যোগ্য ছিলেন। তিনি রাতদিন খেটেছেন এই তত্ত্বের উপর। শুরুর দিকের কাজটার জন্য হলেও তিনি পুরষ্কারটির যোগ্য দাবিদার। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তার কাজের খুঁটিনাটি তথ্যগুলো সবই ছিল রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের কাছ থেকে পাওয়া।”
২) মানবদেহে এইডস
এইডসের প্রথম প্রাদুর্ভাবেই বিজ্ঞানীরা এর জাত চিনে ফেলেছিলেন। সবার মাঝে একটা চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। কেউই বুঝতে পারছিলেন না এই রোগটা প্রকৃতপক্ষে কেমন। পরবর্তীতে এই ভীতি সাধারণ মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে গেলো। অনেকে মনে করছিলেন এটি সম্ভবত একটি বায়ুবাহিত রোগ। কিন্তু জোর গলায় কোনোকিছু নির্দিষ্ট করে বলার মতো পর্যাপ্ত তথ্য তাদের কাছে ছিলো না। একদিকে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের প্রকৃতি বের করতে হিমশিম খাচ্ছেন আর অপরদিকে ভাইরাসও নিজের নতুন নতুন সংস্করণ বের করতে থাকে। শুরু হয় নতুন ধরনের প্রাদুর্ভাব। তার উপরে বিজ্ঞানীরা নিজেরা নিজেদের আবিষ্কার নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠেন।
১৯৮৩ সালে ফরাসি গবেষক লুক মন্টেগনিয়ের লিম্ফাডেনোপ্যাথি রেট্রোভাইরাস আবিষ্কার করেন। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এর সাথে এইডসের যোগসূত্রতা থাকার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তার এই আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটিকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু তিনি ভুলে এই ভাইরাসের বদলে ভিন্ন এবং আরও শক্তিশালী একটি সংস্করণ পাঠিয়ে দেন। ঐ সময়েই, অন্য আরেকজন বিজ্ঞানী, রবার্ট গ্যালো আরেকটি ভাইরাস আবিস্কার করেন যেটা এইডসের জন্য দায়ী বলে তিনি ধারণা করেন। ততদিনে মন্টাগনিয়ের ও তার সহকর্মী ফ্রাসোয়া তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরষ্কার জিতে নিয়েছেন। অথচ গ্যালোর আবিস্কৃত ভাইরাসটি মন্টাগনিয়ের প্রদত্ত ভাইরাসের একপ্রকার অনুরুপই ছিল বলা যায়। তাই গ্যালোর মনে হতে থাকে এই কাজের জন্য তারও অনুরূপ স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল।
৩) টেলিফোন: আগে আসলে আগে পাবে!
টেলিফোন কে আবিষ্কার করেছে বলতে পারেন? হ্যাঁ জানি, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের নামটিই বলবেন। অথচ শুধুমাত্র প্রকাশ্যে তার নামে আগে এসেছে বলেই আজ আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলকে টেলিফোনের আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার অনেক আগে থেকেই অভেরলিন কলেজের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার এলিশিয়া গ্রে এর ধারণা নিয়ে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার আইনজীবী কয়েক ঘণ্টা পরে পেটেন্ট অফিসে পৌঁছার কারণে বেলকেই টেলিফোন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়।
দিনটি ছিল ১৮৭৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। বেল তার আইনজীবীকে প্যাটেন্ট অফিসে পাঠিয়েছেন টেলিফোনের আবিষ্কারের সম্মানটি নিজের নামে করে নেওয়ার জন্যে। একই দিন এলিশিয়া তার আইনজীবীকে পাঠিয়েছেন একই কারণে। কিন্তু সমস্যা হলো বেলের আইনজীবী সেখানে পৌঁছান কয়েক ঘণ্টা আগে এবং লাইনে তার অবস্থান ছিল ৫ নম্বরে। এদিকে বেশ খানিকক্ষণ পরে পৌঁছানোয় এলিশিয়ার আইনজীবী ছিলেন ৩৯তম স্থানে। অবশ্য অনেকে বলেন ঘটনাটি পুরপুরি সত্য নয় এবং সরকারি কর্মচারীদের গাফিলতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ, এই তারিখের আগেই গ্রে টেলিফোনের ব্যাপারটি ঘোষণা করেছিলেন এবং পেটেন্ট অফিসের উচিৎ ছিল তখনই তাকে সম্মানিত করা।
৪) বৈদ্যুতিক বাতি
বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের দৌড়ে থমাস এডিসন একা ছিলেন না, তার পাশাপাশি আরও বেশ কজন বিজ্ঞানী সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জোসেফ সোয়ান। কে কার আগে কাজ শেষ করবে তা নিয়ে এই দুজনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে যায়। এমনকি এডিসনের অনেক আগে থেকে সোয়ান বাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি না থাকার কারণে তিনি বেশ কিছুদিন আটকে ছিলেন। বাতির ভেতরের অবস্থা বায়ুশূন্য রাখার জন্যে তার বিশেষ ধরনের ভ্যাকুয়াম পাম্পের প্রয়োজন ছিল, যা কিনা আবিষ্কার হয় তিনি কাজ শুরু করার প্রায় আরও দশ বছর পর।
সোয়ান তার বানানো প্রাথমিক বাতিগুলোর কাজ শেষ করেন ১৮৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখনও এডিসন তার কাজ শেষ করেননি। যা-ই হোক, সোয়ানের তৈরি বাতিগুলো জ্বালাতে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হতো এবং সেগুলো তেমন একটা টেকসই ছিল না। বাতিগুলো এতো জলদি নষ্ট হয়ে যেতো যে দৈনন্দিন ব্যবহারে জন্যে সেগুলো মোটেও সুবিধাজনক ছিল না। তার ব্যবহৃত ফিলামেন্টগুলো ভারী হওয়ার কারণে ফেটে যাওয়ার সাথে সাথে বাতিটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতো। এদিকে এডিসন সোয়ানের ধারণাটাই আরেকটু উন্নত করলেন। তিনি তার বাতিতে খুবই হালকা এবং উচ্চ বৈদ্যুতিক ক্ষমতা সম্পন্ন ফিলামেন্ট ব্যবহার করেন। এতে করে সোয়ানের সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যায় এবং বাতি আবিষ্কারের খ্যাতি চলে যায় এডিসনের কাছে।
৫) পারমাণবিক বোমা
‘প্রথম’ খেতাব পাবার জন্য যখন দেশগুলো প্রতিযোগিতায় নামে, বিতর্ক তখন তার পিছু ধাওয়া করে। আর যুদ্ধের সময় হলে তো আর কথাই নেই, অবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এমনই একটি ব্যাপার ঘটেছিল পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পারমাণবিক বোমা বানানোর কৌশল জানার জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় উঠেপড়ে লেগেছিল।
তারা একের পর এক গুপ্তচর পাঠাতে শুরু করে সেই তথ্য উন্মোচনের লক্ষ্যে। তাদের অনুসন্ধান ১৯৪১ সালে ব্রিটেন থেকে শুরু হয়। সেখানে সোভিয়েত স্পাইরা কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই বেশ ক’বছর তাদের গুপ্তচরগিরি চালিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সামরিক তথ্যাদি সংগ্রহ করার জন্য, ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পাঠানো গুপ্তচরদের মধ্যে অন্যতম দুজন ছিলেন ক্লজ ফুকস এবং ডেভিড গ্রিনগ্লাস।
রেকর্ড সময়ের মধ্যে মাত্র চার বছর পরেই যখন সোভিয়েত তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বোমা তৈরি করে, তখন এটা স্পষ্ট ছিল যে তাদের কাছে কিছু ‘ধার করা’ তথ্য ছিল। সোভিয়েতরা ব্রিটিশ ও মার্কিন গুপ্তচরদের কাছ থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল ঠিকই, তবে এখানে একটি ব্যাপার ঘটে। ধারণা করা হয় যে, কিছু গুপ্তচর গোপনে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা বিশ্বাস করতো, যদি উভয় দেশের সমান ক্ষমতা ও প্রযুক্তি সমান থাকে, তাহলে ধ্বংসের পরিমাণ কমে যাবে।