ব্যস্ত নগরীর রাজপথে চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায় অসংখ্য চার চাকার যান, পাল্লা দিয়ে সবাই যেন ছুটছে অবিরত। এমন ব্যস্ত রাস্তার দিকে মাত্র একবার তাকালেও একটা ব্র্যান্ডের নাম কিন্তু চোখে পড়বেই। সে নামটি সবার জানা। টয়োটা (Toyota)।
আজ থেকে ৮১ বছর আগে যে যাত্রা শুরু করেছিল এই ব্র্যান্ডটি, এই দীর্ঘ সময়ে সে যাত্রার পথে পথে তৈরি হয়েছে অজস্র ইতিহাস। তাঁতশিল্পের কাজ থেকে দুনিয়াজুড়ে রাজত্ব করা গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা- এমন অনন্য গল্প দিয়েই সমৃদ্ধ টয়োটার পথচলা। আজ আমরা ঘুরে আসব সেই পথেরই অদেখা বাঁকগুলো থেকে।
এক কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন সাকিচি টয়োডা, যিনি বড় হয়ে পরিচিত পেয়েছিলেন জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত উদ্ভাবক হিসেবে। শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবেও পরিচিতি ছিল তার। এই মানুষটির হাত ধরেই বড় হয়ে ওঠে পারিবারিক টয়োডা ব্যবসাগুলো। তার মাঝে একটি ছিল টয়োডা অটোমেটিক লুম ওয়ার্কস (Toyoda Automatic Loom Works), যেটি তিনি শুরু করেছিলেন ১৯২৬ সালে। জাপানের শিল্প বিপ্লবের শুরু কিন্তু আসলে এর হাত ধরেই। ‘জাপানী উদ্ভাবকদের সম্রাট’ খ্যাত টয়োডা এই তাঁতশিল্পের কোম্পানির জন্য বিভিন্ন রকমের যুগান্তকারী যন্ত্রও আবিষ্কার করেন।
১৯৩০ সালে অবসান হয় সাকিচির কর্মবহুল জীবনের। তার অন্তর্ধানের পর তার ছেলে কিচিরো টয়োডা তাঁতশিল্প অর্থাৎ টেক্সটাইল ব্যবসা থেকে যখন মনোযোগ গাড়ির দিকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার বয়স ৩৬। তিনি তার ভাইকে বুঝিয়ে রাজি করান এ ব্যাপারে, কারণ তার ভাই-ই আসলে পারিবারিক ব্যবসার প্রধান ছিলেন তখন। তাই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কিচিরোর পরামর্শে তার ভাই তাঁত ছেড়ে গাড়ি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। কিচিরোকে তার সহকর্মীরা ডাকতেন ‘জাপানের থমাস আলভা এডিসন‘ বলে। উদ্ভাবনের প্রতিভাটা তার মাঝে ছিল বাবার মতোই। তা না হলে তো গাড়ির ব্যবসায় আসার মতো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তে তিনি আসতেন না, যেই সিদ্ধান্তটি পাল্টে দিয়েছিল বিংশ শতকের ইতিহাস!
কিচিরো টয়োডা ১৯২৯ সালে ইউরোপ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেড়িয়ে আসেন, দেখে আসেন সেখানকার গাড়ি বাজারের হালচাল। ১৯৩০ সালে তিনি নিজেই গ্যাসোলিন-চালিত ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। জাপানের সরকারও তখন চাইছিল যেন জাপানেই গাড়ি উৎপাদন শুরু হয়, কারণ সেসময় চলছিল প্রবল চীন-জাপান যুদ্ধ।
১৯৩৪ সালে টয়োডার গাড়ি উৎপাদন শাখা প্রথমবারের মতো টাইপ-এ ইঞ্জিন নির্মাণ করে। তাদের প্রথম গাড়ি মডেল এ-ওয়ানে (A1) সেই ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। ১৯৩৫ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু হয় সেই মডেলের। আর একই ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় জি-ওয়ান ট্রাকেও, যা রাস্তায় নামে একই বছরের আগস্টে। আর এর পরের মডেল এএ (AA) চলে আসে পরের বছর। সবকটি গাড়িই দেখিয়েছিল দারুণ পারফর্মেন্স।
টয়োডার গাড়ির এমন সাফল্য দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একে আলাদা একটি কোম্পানি হিসেবে তৈরি করার। মূল টয়োডা কোম্পানির নাম বদলে এবার রাখা হয় কাছাকাছি উচ্চারণের নাম ‘টয়োটা’। উচ্চারণের সুবিধা একটা কারণ তো ছিলই, আরেকটি কারণ ছিল, টয়োটা লিখতে সে ভাষায় আটটি ছোপ প্রয়োজন হয়; আর ‘আট’ পূর্ব এশীয় সংস্কৃতিতে একটি সৌভাগ্যের সংখ্যা। সেকারণের এই নতুন নামকরণ। সেটি ছিল ১৯৩৭ সালের কথা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টয়োটা প্রধানত ট্রাকই বানাতো জাপানী বাহিনীর জন্য। কিন্তু জাপানে তখন কাঁচামালের এতই অভাব যে, সামরিক ট্রাকগুলোকে খুবই সাদামাটাভাবে তৈরি করতে হয়েছিল। এমনকি দুটো হেডলাইটের বদলে গাড়ির সামনে মাঝামাঝি মাত্র একটাই হেডলাইট দিতে হয়েছিল তাদের। ভাগ্য ভালো, যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, নতুবা আরও ক’দিন চললে মিত্রবাহিনীর পরিকল্পিত আইচিতে অবস্থিত টয়োটার ফ্যাক্টরিতে বোমা হামলাটা হয়েই যেত!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে গিয়েছিল, সেটা বলাই বাহুল্য। যুদ্ধ শেষ হবার দু’বছর পর টয়োটা আবার সাধারণ যাত্রীদের জন্য প্রাইভেট কার বানানোর কাজ শুরু করে। ১৯৪৭ সালে মডেল এসএ (SA) বাজারে আসে। তবে কোম্পানির অবস্থা ভালো চলছিল না। ১৯৪৯ সালে পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে যায় যে, দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে আসে তারা! কিন্তু নানা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ায় সেই যাত্রায় বেঁচে যায় টয়োটা।
পরের বছর আবারও বিপদ। মাত্র ৩০০টি ট্রাক বানিয়ে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে যায় টয়োটার। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোম্পানিটির তখন কর্মী ছাঁটাই আর বেতন কমানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না, ফলাফল হিসেবে পড়তে হয় শ্রমিক আন্দোলনের মুখে। শ্রমিকদের শান্ত করে ১৯৫০ সালের সেই ঝড়ও সামাল দিতে সক্ষম হয় কোম্পানিটি।
সেবছরই কিচিরো অবসর নেন দায়িত্ব থেকে। টয়োডা অটোমেটিক লুম কোম্পানি অর্থাৎ তাঁত কোম্পানির সিইও তাইজো ইশিদা তখন আসেন টয়োটার প্রেসিডেন্ট হয়ে। ইশিদা দায়িত্ব নেবার পর আরেকটি যুদ্ধ যেন শাপে-বর হয়ে আসে টয়োটার জন্য। কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হওয়ায় মার্কিন মিলিটারি পাঁচ হাজার গাড়ির অর্ডার দেয় টয়োটার কাছে। প্রায় মরতে বসা কোম্পানিটি এবার যেন বেঁচে ওঠে, শক্ত হাতে সব সামাল দেন তাইজো ইশিদা। ১৯৫৭ সালে যাত্রীবাহী প্রাইভেট কার হিসেবে প্রথম জাপানী গাড়ি রপ্তানি হয় মার্কিন মুলুকে, একইসাথে ব্রাজিলেও। ফলে টয়োটার মার্কিন (Toyota Motor Sales Inc.) ও ব্রাজিলীয় শাখা (Toyota do Brasil S.A.) সৃষ্টি হয় তখন। ১৯৫৯ সালে মোতোমাচি প্ল্যান্ট নির্মাণ করেন ইশিদা, যার ফলাফল হিসেবে ষাটের দশকে সেসময়ের বিখ্যাত ব্র্যান্ড নিসান (Nissan) গাড়ির চেয়েও টয়োটার বিক্রি ছিল অনেক বেশি!
জাপান, আমেরিকা, ব্রাজিলের সাফল্যের পর বৈশ্বিক বিস্তৃতি আরও বাড়াবার পরিকল্পনা করে টয়োটা। নতুন গবেষকদের দলে টেনে ষাটের দশকে শুরু হয় সেই বিস্তৃতি। থাইল্যান্ড দিয়েই শুরু হয় সেটা। টয়োটার এক কোটিতম গাড়িটি তখন বানানো হয়। জাপানের ডেমিং পুরস্কার (Deming Prize) জিতে নেওয়ার পাশাপাশি হিনো (Hino) ও দাইহাতসুর (Daihatsu) সাথে পার্টনারশিপে যায় টয়োটা।
১৯৬২ সালে ইউরোপে (ফিনল্যান্ডে) পা রাখে টয়োটার গাড়ি, দুটো টয়োপেট টিয়ারা, কিন্তু বিক্রি অবশ্য তেমন হয়নি। ডেনমার্ক, নরওয়ে আর সুইডেনে ১৯০টি ক্রাউন মডেল আমদানি করা হয়, তখন বিক্রি শুরু হয় দারুণভাবে।
জাপানের বাইরের টয়োটার কারখানায় প্রথম বানানো গাড়িটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। আমেরিকা নয়, বরং অস্ট্রেলিয়াই ছিল টয়োটার সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, অন্তত ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। আর ইউরোপে পর্তুগালে প্রথম টয়োটার গাড়ি বানানো হয় ১৯৬৮ সালে। এভাবে ষাটের দশকের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে টয়োটা জানিয়ে দেয় নিজেদের উপস্থিতির কথা। তবে ষাটের দশকেই যাত্রা শুরু হয় ‘বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়ি’ হিসেবে পরিচিত টয়োটা করোলা’র।
১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘পারিবারিক গাড়ি’-র উপযোগিতা শুরু হয়ে যায় বড় হারে। সে বছরের নভেম্বরেই জাপানের বাজারে ছাড়া হয় প্রথম করোলা, আর খুব দ্রুতই গাড়িটি পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সেই যে শুরু হলো, সারা দুনিয়াজুড়ে আজও রাস্তায় তাকালে সবচেয়ে বেশি যে গাড়ি চোখে পড়বে, সেটি হলো টয়োটা করোলা! সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এ মডেলটি ১৯৭৪ সালের মাঝে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্রিক্রিত গাড়ির খেতাব পেয়ে যায়, আর ১৯৯৭ সালে পার করে যায় ভোক্সওয়াগন বিটলকেও। ২০১৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে ৪০ মিলিয়ন টয়োটা করোলা বিক্রির নজির ছিল পিলে চমকে দেয়ার মতো। ঠিক নামের মতোই যেন টয়োটার একচ্ছত্র মুকুট ধরে রাখে টয়োটা করোলা, কারণ লাতিন ভাষায় করোলা মানে যে ‘ফুলের মুকুট’!
টয়োটার ইতিহাসে অনেককাল ধরে আরেক সফল গাড়ি হলো ল্যান্ড ক্রুজার। ১৯৫১ সালের টয়োটা জীপ বিজে (Toyota Jeep BJ) থেকে আসলে এর যাত্রা শুরু, তবে ল্যান্ড ক্রুজার নামখানা প্রচলিত হয় ১৯৫৫ সাল থেকে টুয়েন্টি-সিরিজ বাজারে আসার সাথে সাথে। বর্তমানে তিনটি সিরিজ চলছে পুরোদমে- হেভি ডিউটি, ওয়্যাগন আর লাইট ডিউটি। ল্যান্ড ক্রুজারের দশম সংস্করণ বর্তমানের ২০০২ ১২০ (লাইট ডিউটি প্রাডো) এখনও গাড়ির দুনিয়ায় আছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে। টয়োটার সমস্ত গাড়ির মধ্যে দীর্ঘতম ইতিহাসের মালিকানা এই ল্যান্ড ক্রুজারেরই।
ষাটের পরে চার থেকে পাঁচ দশক আসলে টয়োটার সাফল্যেরই গল্প। আশির দশকে জাপানে প্রথমবারের মতো কোয়ালিটি কন্ট্রোল অ্যাওয়ার্ড (Japanese Quality Control Award) জেতার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলে টয়োটা। আর নব্বইয়ের দশকে এসে টয়োটা শুরু করে বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণ- পিকআপ, টিওয়ান-হানড্রেড (T100), এসইউভি ইত্যাদি। স্পোর্টসকারে নির্মাণেও তারা নাম লেখায় তখন।
২০০২ সালে ফর্মুলা ওয়ানের সাথে জড়িত হয় টয়োটা, আর সেইসাথে দুটো ফরাসি কোম্পানির সাথেও (Citroën ও Peugeot) যৌথ উদ্যোগে যায়। ২০০৫ সালে ফোর্বস ২০০০ তালিকায় অষ্টম স্থানে ছিল টয়োটা! ২০০৮ সালের প্রথম কোয়ার্টারে বিশ্বজুড়ে বিক্রির হিসেবে এক নম্বর কোম্পানির নাম ছিল টয়োটা।
২০০৮ সালে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে সেখানে টয়োটার বিক্রি হ্রাস পায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই মন্দা চলেছিল। টয়োটাকেও সামাল দিতে হয় সেই মন্দার সব ঝড়ঝাপটা। ২০১১ সালের সুনামিতে অবশ্য জাপানি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ওদিকে থাইল্যান্ডেও বন্যা হওয়াতে আক্রান্ত হয় থাই টয়োটা। সুনামি আর বন্যার কারণে প্রায় চার লাখ গাড়ির উৎপাদন ব্যহত হয়েছিল তাদের। কিন্তু ইতিহাসের শুরু থেকে কখনোই হার মানেনি টয়োটা, এবারও তারা সামলে উঠে এই বিশাল ধাক্কাটি।
এরপর আবারও নিজেদের ট্র্যাকে ফেরত আসতে শুরু করে তারা। ২০১৪ সালের প্রথম তিন মাসে বিক্রয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা কোম্পানি ছিল টয়োটা। এই অগ্রযাত্রায় টয়োটার হাইব্রিড গাড়ি প্রিয়াসের কথা না বললেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রিত সমস্ত গাড়ির মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গাড়ি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে প্রিয়াস। ১৯৯৭ সালে প্রথম এই হাইব্রিড গাড়ি নিয়ে এসেছিল টয়োটা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয় প্রিয়াস-এর বিভিন্ন জেনারেশনের ৬১ লাখের বেশি গাড়ি!
২০১৪ সালেরই নভেম্বরে লস অ্যাঞ্জেলেসে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল গাড়ি টয়োটা মিরাই এর পর্দা উন্মোচন করা হয়, যা পরের তিন বছরে বিক্রি হয় ৫৩০০ ইউনিট। বলে রাখা ভালো, এই ‘মিরাই’ এর অর্থ জাপানি ভাষায় ‘ভবিষ্যৎ’। পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল গাড়িগুলোর একটি টয়োটা মিরাই। সত্যিই মোটরগাড়ির ইতিহাসের ভবিষ্যৎই যেন নির্মিত হচ্ছে টয়োটার হাত ধরে।
২০১৫ সালে টয়োটা ঘোষণা দেয়, কোম্পানিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক গবেষণায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। পরের বছর উবারেও বিনিয়োগ করে টয়োটা, তবে অংকটা কত সেটি তারা জানায়নি। তবে ২০১৮ সালের আগস্টে উবারের স্বনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে বিনিয়োগ করে টয়োটা, এবার অংকটা অবশ্য তারা জানিয়েই দেয়, ৫০০ মিলিয়ন ডলার!
সমসাময়িক সময়ে টয়োটার সবচেয়ে যুগান্তকারী ক্যাম্পেইন হলো ‘স্টার্ট ইয়োর ইম্পসিবল’ (Start Your Impossible) ক্যাম্পেইন। ২০১৮ সালে টয়োটা ঘোষণা দেয়, তারা অটোমোবাইল কোম্পানি থেকে পরিণত হতে যাচ্ছে ‘মোবিলিটি কোম্পানি’-তে, যার মাধ্যমে টয়োটা সাহায্য করবে সকল স্তরের সকল রকমের সক্ষমতার মানুষকে চলাচলে। আর এ সূত্র ধরেই ২০২৪ সাল পর্যন্ত অলিম্পিক গেমসের স্পন্সর পার্টনার হিসেবে ঘোষিত হয় টয়োটার নাম।
আমাদের দেশে প্রাইভেট কার হিসেবে টয়োটার যে জয়জয়কার দেখা যায়, সেটার শুরুও কিন্তু অর্ধ-শতাব্দীরও আগে! বাংলাদেশে টয়োটার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৪ সালে। আর যার হাত ধরে টয়োটা আসে বাংলাদেশে, সেই কীর্তিমান উদ্যোক্তার নাম আলহাজ জহুরুল ইসলাম। তিনি ১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেন নাভানা লিমিটেড কোম্পানি, যা টয়োটা মোটর কর্পোরেশনের সাথে দীর্ঘকালের একটি পার্টনারশিপে যায়। তখনই প্রথম বাংলাদেশি বাজারে প্রবেশ করে টয়োটা করোনা (Toyota Corona)। এরপর তিনি ইসলাম গ্রুপ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে বিস্তৃত করতে থাকেন টয়োটার বাজার। ১৯৯৫ সালে জহুরুল ইসলাম পরলোকগমনের পর তার কনিষ্ঠ ভাই শফিউল ইসলাম কামাল একটু ভিন্নপথে হাঁটেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নাভানা গ্রুপ, যার অন্যতম শক্তি হয়ে উঠে নাভানা লিমিটেড ও আফতাব অটোমোবাইলস লিমিটেড।
নাভানার পথচলার শুরু থেকেই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন। সেকারণেই তারা এমনভাবে গাড়ির মডেলগুলো বাছাই করতে শুরু করে যেন দীর্ঘ সময়ের জন্য সেগুলো টেকসই হয়। প্রথম দিকে মডেল লাইন-আপ তৈরির ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও, ধীরে ধীরে প্রচণ্ড নিষ্ঠা আর গ্রাহকদের সাথে নিয়ে নাভানা গড়ে তোলে একটি দারুণ মডেল লাইন-আপ। এখন তাদের রয়েছে তিনটি সেডান ব্র্যান্ড- ‘ইয়ারিস’, ‘আলটিস’ আর ‘ক্যামরি’। আছে পাঁচটি এসইউভি ব্র্যান্ড- ‘রাশ’, ‘র্যাভ ফোর’, ‘ফরচুনার’, ‘প্রাডো’ এবং ‘ল্যান্ড ক্রুজার’। সেইসাথে পিক-আপ হিসেবে ‘হাইলাক্স’ এবং ‘ডায়না’, মিনিবাস ব্র্যান্ড ‘কোস্টার’ আর মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স ব্র্যান্ড হিসেবে ‘হায়েস’ আছে নাভানার লাইন-আপে। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত এই নাভানা লিমিটেডের হাত ধরেই বাংলাদেশের গাড়ির বাজারে অবিসংবাদিত আধিপত্য ধরে রেখেছে টয়োটা।
মজার ব্যাপার হলো, টয়োটার যাত্রা যে তাঁতশিল্প থেকে শুরু হয়েছিল, তা কিন্তু কখনোই বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। আজও চলছে সেই শিল্প, পার্থক্য কেবল এই- তখন কম্পিউটারের অস্তিত্ব ছিল না, আর আজ তাদের সেই তাঁতশিল্পের সবই কম্পিউটারচালিত। সেই তাঁতের সৌভাগ্য থেকেই তো টয়োটার জন্ম, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের প্রিয় ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার সূচনা। গুণগত মান হোক, কিংবা দাম- সবদিক থেকেই টয়োটা যেন দুনিয়াজুড়ে গাড়ির বাজারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। মানুষ ভালোবাসবেই না বা কেন? পরিবারের সবাইকে সাথে নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে অবিরাম ছুটে চলার সাথী হিসেবে টয়োটার জুড়ি খুঁজে পাওয়াই যে ভার!