১.
গতবছর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিলো স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং ক্যামেরুন ব্যানক্রফটের বল টেম্পারিংয়ের কারণে নিষিদ্ধ হওয়া, যার প্রভাব অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলে ভালোভাবেই পড়েছিল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ জয়ের পর বেশ ছন্দে ছিলো অজিরা। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে বল টেম্পারিং করে ফেঁসে যান দলের নিয়মিত তিন সদস্য। এর মধ্যে ডেভিড ওয়ার্নার এবং স্টিভেন স্মিথ হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপের মূল স্তম্ভ। সেই সাথে দলের নেতৃত্বের ভারও তাদের কাঁধে ছিলো।
নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়া অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দীর্ঘদিন পর দলে জায়গা পাওয়া টিম পেইন। স্টিভেন স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নারের নিষেধাজ্ঞার পর ওয়ানডে দলের দায়িত্বও টিম পেইনকে দিয়েছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু পাঁচ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে মাত্র ৩৬ রান সংগ্রহ করা টিম পেইনের মূল একাদশে থাকা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল, যার ফলে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান অ্যারন ফিঞ্চের হাতে।
অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া অ্যারন ফিঞ্চের সময়টাও ভালো কাটছে না। গতবছর নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তিন ম্যাচে যথাক্রমে ৫, ৪১ এবং ১১ রান করেছিলেন। ভারতের বিপক্ষে চলতি ওয়ানডে সিরিজেও ব্যাট হাতে রানের দেখা পাচ্ছেন না সাদা বলে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ফিঞ্চ। প্রথম দুই ওয়ানডেতে ৬ রান করে মোট ১২ রান করেছেন। দুই ম্যাচেই বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা অ্যারন ফিঞ্চের হঠাৎ করে ফর্মহীনতার কারণে চিন্তায় পড়ে গেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। এমনিতেও দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যান নিষিদ্ধ। এখন যদি অ্যারন ফিঞ্চও ছন্দে না ফেরেন, তাহলে আসন্ন বিশ্বকাপে একাদশ সাজাতে হিমশিম খেতে হবে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের।
২.
অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে স্টিভেন স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নারের অনুপস্থিতিতে টপ-অর্ডারে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের শূন্যতা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া দলের নিয়মিত সদস্য অ্যারন ফিঞ্চকে টেস্ট দলে ডাক দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। সাদা বলের ক্রিকেটে বোলারদের তুলোধুনো করা এই ৩২ বছর বয়সী ওপেনার প্রথমবারের মতো টেস্ট দলে সুযোগ পান গতবছর পাকিস্তানের বিপক্ষে।
দুবাইয়ে ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া টেস্ট ম্যাচ দিয়ে দিয়ে তার সাদা পোশাক এবং লাল বলের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। অভিষেক ম্যাচে অবশ্য টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করেছিলেন তিনি। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১৬১ বলে ৬২ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৯ বলে ৪৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপর আবুধাবিতেও রানের দেখা পেয়েছিলেন ফিঞ্চ। দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৩৯ এবং ৩১ রান তুলেছিলেন তিনি। ফলে ভারত বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেও দলে জায়গা করে নেন তিনি।
ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় সাদা বলের ক্রিকেট খেলা অ্যারন ফিঞ্চ লাল বলে ভারতীয় পেসারদের সামলাতে ব্যর্থ হন। সিরিজের প্রথম তিন ম্যাচে মাত্র একবার অর্ধশত রানের ইনিংস খেলার পর চতুর্থ টেস্টে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যর্থ হওয়ার পর ওয়ানডেতেও ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন ২০১৮ সালের শুরুতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ফিঞ্চ।
৩.
অ্যারন ফিঞ্চের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল তার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই টি-টোয়েন্টিতে মিডল অর্ডারে ব্যাট করে অপরাজিত ১৫ এবং অপরাজিত ৫৩ রানের ইনিংস খেলে জানান দেন, এই ফরম্যাটে রাজত্ব করতেই তিনি এসেছেন। নিজের ৭ম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই শতক হাঁকান ফিঞ্চ। শুধুমাত্র শতক হাঁকিয়েই থেমে থাকেননি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এদিন ৬৩ বলে ১১টি চার এবং ১৪টি ছয়ের মারে ১৫৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ইনিংসের ১৬ বল বাকি থাকতে সাজঘরে না ফিরলে তার নামের পাশে যে আরও রান যোগ হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অ্যারন ফিঞ্চ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট। এর আগে ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিলো তার। ওয়ানডে ক্রিকেটে শতক হাঁকাতে বেশি সময় নেননি তিনি। নিজের ৮ম ওয়ানডেতে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৪ বলে ১৬টি চার এবং ৭টি ছয়ের মারে ১৪৮ রানের ইনিংস খেলেন।
এই ডানহাতি বিধ্বংসী ওপেনার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার আগেই ওয়ানডেতে ১১টি এবং টি-টোয়েন্টিতে দুটি শতক হাঁকিয়েছেন। টি-টোয়েন্টিতে দুটি শতকের মধ্যে দুটিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। গতবছর টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে ৭৬ বলে ১৬টি চার এবং দশটি ছয়ের মারে ১৭২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। আর মাত্র ৩ রান করতে পারলেই সবধরনের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড গড়তেন। ইনিংসের দুই বল বাকি থাকতে আউট হওয়ার আগে ক্রিস গেইলের ১৭৫ রানের ইনিংস থেকে ৩ রান দূরে ছিলেন।
৪.
অ্যারন ফিঞ্চ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া শতক হাঁকিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট শুরু করেছিলেন। এরপর ঘরের মাঠে আবারও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর এবং অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন এই ওপেনার। এখন পর্যন্ত ৯৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন তিনি, যার মধ্যে ১১টি শতক এবং ১৮টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৬.৮৮ ব্যাটিং গড়ে ৩,৪৩০ রান করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার আগে ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং গড় ছিলো ৩৮.১৯।
ফিঞ্চ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর সেখানেও তিনি রানের দেখা পাচ্ছেন না। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর টি-টোয়েন্টিতে তার ইনিংসগুলো যথাক্রমে ১, ০, ৩, ১, ৭, ২৭, ০ এবং ২৮ রানের। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের আগে তিনি কখনও টি-টোয়েন্টিতে শূন্য রানে আউট হননি। কিন্তু টেস্টে অভিষেকের পর দুবার শূন্য রানে আউট হয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে তার প্রথম ছয়টি টি-টোয়েন্টি ইনিংস ছিলো যথাক্রমে ২০*, ৩৬*, ১৮* ৮৪, ৬৮* এবং ১৭২ রানের। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর আট ইনিংসে তার মোট রান মাত্র ৬৭। টেস্টে অভিষেকের পর তিনি তার প্রিয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ১৩ ইনিংসে মাত্র ১০.৪৬ ব্যাটিং গড়ে ১৩৬ রান সংগ্রহ করেছেন।
তবে তার এই ফর্মহীনতার কারণে খুব একটা চিন্তিত নন কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার। তার মতে, ফিঞ্চের কিছুদিন বিশ্রাম দরকার। তাহলেই তিনি পুনরায় ছন্দে ফিরে আসবেন। অ্যারন ফিঞ্চও ফর্মে ফেরার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। নিজের ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য আসন্ন আইপিএলের আসর থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে ১১১ দিনের মধ্যে ৪২ দিন খেলায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। এর মধ্যে পৃথিবীর দুই প্রান্তে সফর সহ মোট ১৫টি শহর এবং সাতবার ফরম্যাট পরিবর্তন করতে হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটানো বিরাট কোহলিও এই সময়ের মধ্যে ফিঞ্চের চেয়ে দু’বার কম, তথা পাঁচবার ফরম্যাট পরিবর্তন করেছেন।
সাদা বলের ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা অ্যারন ফিঞ্চ হঠাৎ করে লাল বলের ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়ে উল্টো নিজের চেনা ফরম্যাটে রান খরায় ভুগতে শুরু করলেন। আশাবাদী কোচের মতো অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ভক্তরাও আশা করতে পারেন, কিছুদিন বিশ্রাম পেলেই আবারও রঙিন পোশাকে সাদা বল মাঠের বাইরে সহজেই উড়িয়ে পাঠাবেন এই মারকুটে ব্যাটসম্যান।